আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

পিস টিভি নিষিদ্ধকরণ কি বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?

ফরিদ আহমেদ  

গত সোমবার (জুলাই ১১, ২০১৬) বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এক প্রজ্ঞাপনে তথ্য মন্ত্রণালয় এই টিভির ডাউন লিংকের অনুমতি বাতিল করেছে বলে জানিয়েছে। এই টিভির উদ্যোক্তা হচ্ছেন ভারতের ইসলামি বক্তা ডাঃ জাকির নায়েক। ইনি বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এক শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।

প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, মন্ত্রীসভা কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ডাউন লিংকের শর্ত ভঙ্গ করায় বিদেশি ফ্রি-টু-এয়ার টিভি চ্যানেল পিস টিভির ডাউন লিংকের অনুমতি বাতিল করা হলো। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরে পিস টিভির সব ধরনের সম্প্রচার বন্ধের ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হয় প্রজ্ঞাপনে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও কেবল অপারেটরদের সংগঠন কোয়াবকেও পাঠানো হয়েছে এই প্রজ্ঞাপনের অনুলিপি।

শুধু বাংলাদেশে নয়, এর মাত্র দুই দিন আগে (জুলাই ৯, ২০১৬) ভারতীয় কর্তৃপক্ষও পিস টিভিকে নিষিদ্ধ করেছে। জাকির নায়েকের বক্তব্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ কিংবা হিংসা ছড়ানো নিয়ে কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার পর পিস টেলিভিশনের সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে ভারত সরকার।

বাংলাদেশ এবং ভারতে পিস টিভি প্রায় একই সময়ে নিষিদ্ধ হওয়াটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, বরং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ঘটনা।

গুলশানের হোলি আর্টিসান বেকারিতে যে নৃশংস সন্ত্রাসী আক্রমণ ঘটেছিল, তারই জের হিসাবে ভারত এবং বাংলাদেশ, এই রাষ্ট্রে পিস টিভি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। গুলশানে হামলাকারীদের মধ্যে একাধিকজন নিয়মিত জাকির নায়েকের বক্তব্য অনুসরণ করতেন বলেও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে তথ্য মিলেছে।

বাংলাদেশি জঙ্গিরা জাকির নায়েকের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে, এই সংবাদ বাংলাদেশি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হবার পরেই জাকির নায়ের জন্মস্থান মহারাষ্ট্রের সরকার এই ইসলামি ধর্মীয় বক্তব্য প্রচারকের বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্ত শুরু করে। ডেইলি স্টারের এক খবরে বলা হয় যে, গুলশান হামলার পাঁচ জঙ্গির এক জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ জাকির নায়েকের এক ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে সকল মুসলমানকে সন্ত্রাসী হবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। কারণ, সেই ভিডিওতে জাকির নায়েক আমেরিকার বিরুদ্ধে সকল মুসলমানকে সন্ত্রাসী হবার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন।

গুলশান হামলার পরপরই বাংলাদেশ সরকার জাকির নায়েকের বক্তব্যগুলোকে খতিয়ে দেখার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানায়। এই অনুরোধে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাদনাভিস জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে আইনগত তদন্তের আদেশ দেন এবং পুলিশকে পিস টিভির টাকা-পয়সার উৎস, সম্পত্তি এবং এর সম্প্রচার বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। জাকির নায়েকের ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বাইরে পুলিশি প্রহরাও বসিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ সরকার পিস টিভিকে বন্ধ করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছে, এই কথা জানার পরে জাকির নায়েক বেশ অহমিকার সাথেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, “পারলে করে দেখাক। বাংলাদেশে আমার লাখ লাখ ভক্ত রয়েছে।” তবে, তাঁর এই অহমিকা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার তাদের অবস্থানে সুদৃঢ়, এই পরিস্থিতি দেখতে পেয়ে সুর নরম করে ফেলেন তিনি। এক ভিডিও বিবৃতিতে গুলশানের সন্ত্রাসী ঘটনার নিন্দা করেন তিনি এবং তাঁর মাধ্যমে জঙ্গিরা অনুপ্রাণিত হয়েছে এই বক্তব্যকে অস্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, তিনি কখনোই সন্ত্রাসবাদকে কিংবা নিরীহ মানুষ হত্যাকে সমর্থন করেন নাই। তাঁর এই বক্তব্য সঠিক কিনা সেটা দেখার জন্য সরকারকে তিনি তাঁর সকল বক্তব্য পরীক্ষা করে দেখারও আমন্ত্রণ জানান। তারপরেও ওই জঙ্গিরা যদি তাঁর বক্তব্যের কারণে অনুপ্রাণিত হয়েও থাকে, সেখানে তাঁর দায় সেরকম কিছু নেই। কারণ, তিনি তাদের কাউকেই ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না। কাজেই, ঢাকার বর্বরোচিত হামলায় তাঁকে জড়ানোটা ঠিক নয় বলে তিনি যুক্তি দেখান।

জাকির নায়েককে নিয়ে বিতর্ক এটাই প্রথম না বা তাঁকে নিষিদ্ধ করাও এটাই প্রথম নয়। গত বছর উসকানিমূলক কথাবার্তা বলার অভিযোগে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়৷ ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে জাকির নায়েকের ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন যুক্তরাজ্য ও কানাডায় নিষিদ্ধ। এমনকি মুসলিম প্রধান মালয়েশিয়াতেও জাকির নায়েকের বক্তব্য প্রচারের অনুমতি নেই।

২০১০ সালে লন্ডন এবং শেফিল্ডে জাকির নায়েকের বেশ কিছু বক্তব্য দেবার কথা ছিল। কিন্তু, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ব্রিটেনের সদ্য নিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সেই সময়ে হোম সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ অধিকার নয়, এটা একটা সুযোগ। হোম সেক্রেটারি হিসাবে আমি যদি মনে করি দেশের উপর হুমকি রয়েছে, কিংবা জন-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে অথবা নাগরিকদের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে, আমি লোকজনকে যুক্তরাজ্যের আসতে বাধা দিতে পারি। কারো মতামত যদি সন্ত্রাসবাদকে মহান করে তোলে, সহিংসতা ছড়াতে সহায়তা করে বা অন্য কোনো মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হতে সহায়তা করে তবে সেই সব লোকদের উপর আমি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারি।” তিনি বলেন, “জাকির নায়েকের অনেক বক্তব্যই আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে।”

একই সময়ে টরন্টোতে উত্তর আমেরিকার মুসলমানদের সবচেয়ে বড় কনফারেন্স ‘জার্নি অব ফেইথ কনফারেন্সে’ আসার কথা ছিল জাকির নায়েকের। মজার বিষয় হচ্ছে, তাঁর আগমনের বিষয়টা সরকারের কাছে প্রথম জানান দেন তারেক ফাতাহ। ইনি মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা। জাকির নায়েককে হেইট-মঙ্গার হিসাবে উল্লেখ করে তিনি ফেডারেল এমপিদের কাছে গণ-ইমেইল পাঠান এবং বলেন যে, তাঁকে তাঁরা ক্যানাডায় দেখতে চান না। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারী এজেন্সিগুলো পরবর্তীতে তাঁকে জানায় যে, জাকির নায়েক ক্যানাডায় আসলেও বিমানবন্দর থেকেই তাঁকে ফেরত পাঠানো হবে, ক্যানাডায় ঢুকতে দেওয়া হবে না।

তাঁর আগমন বন্ধ করার জন্য একটা ফেসবুক গ্রুপও খোলা হয়েছিল। সেখানে জাকির নায়েকের সন্ত্রাসে প্রতি সমর্থন এবং নানা ঘৃণামূলক বক্তব্যকে তুলে ধরা হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, জাকির নায়েক সমকামীদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির ফতোয়া দিয়েছেন, কেউ ইসলাম ত্যাগ করলে তাঁর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এ কথাও তিনি ঘোষণা করেছেন। ২০০৯ সালের এক ভিডিওতে তিনি স্ত্রীদের মৃদু প্রহার করার জন্য স্বামীদের অধিকার রয়েছে বলে ঘোষণা দেন। তবে, এক্ষেত্রে স্ত্রীকে মুখে আঘাত করা যাবে না বা শরীরের কোথাও দাগ ফেলা যাবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তবে, এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল তাঁর ২০০৭ সালের একটা ভিডিও। এই ভিডিওটা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। সেই ভিডিওতে তিনি বলেন, “ওসামা বিন লাদেন যদি ইসলামের শত্রুদের সাথে লড়াই করে থাকেন, তবে আমি তাঁর সাথে আছি। তিনি যদি একজন সন্ত্রাসীকে সন্ত্রস্ত করে তোলেন, তিনি যদি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী আমেরিকাকে সন্ত্রস্ত করে থাকেন, তবে আমি তাঁর সাথে আছি। প্রত্যেক মুসলমানেরই উচিত সন্ত্রাসী হওয়া।”

কলকাতা টোয়েন্টিফোরসেভেন নামের ভারতের একটা অনলাইন পত্রিকা জাকির নায়েকের সাতটা বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয় মূলত এসবের জেরে সমালোচনার মুখে পড়তে হল ভারতের এই ধর্ম প্রচারককে।
•    সকল মুসলিম পুরুষদের অধিকার রয়েছে মহিলা ক্রীতদাসের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হওয়ার।
•    বালিকাদের স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। স্কুলে থেকে বেরনোর সময় নষ্ট হয়ে যায় মেয়েদের নারীত্ব। স্কুলগুলি বন্ধ করে দেওয়া দরকার। ছাত্রীদের অলঙ্কার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত স্কুল কর্তৃপক্ষের।
•    পশ্চিমের দেশগুলিতে মহিলাদের স্বাধীনতার নামে মা ও মেয়েদের বিক্রি করা দেওয়া হচ্ছে।
•    বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে মান্যতা দেওয়া হয়েছে শরীয়া আইনে।
•    পত্নীর গায়ে হাত তোলা মুসলিম ধর্মে খারাপ কাজ নয়। যৌন সম্পর্ক স্থাপনকালে কনডম ব্যবহার মানুষ খুনের সমতুল কাজ।
•    কোরান এবং সুন্না অনুসারে সমকামীদের হত্যা করা উচিত।
•    ধর্মগুরুর উপদেশ মেনে আত্মঘাতী হামলা করা খারাপ কাজ নয়। ওসামা বিন লাদেন ৯/১১ কাণ্ডে জড়িত ছিল বলে মনে করেন না জাকির নায়েক। ওই ঘটনা আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বলে দাবি করেছেন মুম্বাই ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রধান জাকির নায়েক।

জাকির নায়েকের সালাফি ইসলামের প্রতি ভালবাসা এবং অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড উদারপন্থীদের কাছে তাঁকে প্রচণ্ড রকমের অ-জনপ্রিয় করে তুলেছে, এটা সত্যি কথা। কিন্তু, একই সঙ্গে এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, তাঁর এই অবস্থান, কোরান-হাদিসের উপর তাঁর জ্ঞান, এবং একজন সুবক্তা হিসাবে, তাঁকে বহু মানুষের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধাও পাইয়ে দিয়েছে। ইসলামের প্রতি তাঁর অবদানের জন্য সৌদি আরবের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কিং ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।

তাঁকে ভালবাসে এবং শ্রদ্ধা করে যে অংশ, সেই অংশ এবং নিরপেক্ষ অংশ বলে দাবিদার কিছু মানুষ, দাবি তুলেছে এই বলে যে পিস টিভি বন্ধের সরকারী এই সিদ্ধান্ত বাক-স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ। পিস টিভি বন্ধের ক্ষেত্রে এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। আমরা যারা বাক-স্বাধীনতার পক্ষের লোক, পিস টিভিকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি আর না করি, বাক-স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের এই অভিযোগের জায়গাটাতে নড়েচড়ে বসাই লাগে।

বাক-স্বাধীনতা হচ্ছে গণতান্ত্রিক যে সমস্ত স্বাধীনতাগুলো আছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা থাকলে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত থাকে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা ধরনের মতামত আসার সুযোগ থাকে, রাজনীতি, দর্শন, রাজনৈতিক নেতা এদেরকে সমালোচনা করা সম্ভব হয় এর মাধ্যমে। নানামুখী মতামত একসাথে আসতে পারে বলে, মানুষের সুযোগ থাকে সব অংশকে যাচাই-বাছাই করে দেখার। কিন্তু, আরো অনেক স্বাধীনতার মতোই বাক-স্বাধীনতারও একটা সীমারেখা আছে। চরম বাক-স্বাধীনতা বলে কোনো জিনিসের অস্তিত্ব পৃথিবীর কোথাও কোনো দেশেই নেই। প্রতিটা দেশই তার সমাজ, সংস্কৃতি এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে বাক-স্বাধীনতার  একটা সীমারেখা একে দেয়। কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে এই সীমারেখা ব্যাপক, কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে এটা সীমিত। বাক-স্বাধীনতার সর্বজনস্বীকৃত সুনির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা নেই। কোনো একটা দেশের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সীমারেখার মধ্যে থেকেই বাক-স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে হয়।  

জাকির নায়েক শুধুমাত্র যে মধ্যযুগীয় শিক্ষা এবং মানসিকতার প্রচার করছেন তাই নয়, তিনি সমকামী ব্যক্তি, ইসলামত্যাগী ব্যক্তিদের প্রতি চরম ঘৃণা প্রদর্শন করেছেন। সেই ঘৃণা এমনই চরম যে, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত এমন মতবাদও প্রচার করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নারীদের প্রতি এমন সব বৈষম্যমূলক বক্তব্য রাখছেন, যেগুলোকে অনায়াসে হেইট স্পিচ বা ঘৃণা ছড়ানোমূলক বক্তব্যের আওতায় ফেলে দেওয়া যায়। এর বাইরে জিহাদি হবার জন্য মুসলিমদের প্ররোচিত করাটাও আছে। এটার মাধ্যমে সমাজে সহিংসতা তৈরি হয়।

হেইট স্পিচ যেহেতু একটা নির্দিষ্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে সহিংসতা তৈরি করতে পারে বা তাদের বিরুদ্ধে পূর্ব-ধারণামূলক সংস্কার তৈরি করতে পারে, সে কারণে দেশে দেশে হেইট স্পিচকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পিস টিভিকে নিষিদ্ধ করাটাও তাই বাক-স্বাধীনতার উপর হুমকির কিছু নয়, বরং হেইট স্পিচকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা উপায় হিসাবেই বিবেচনা করতে হবে। পিস টিভি যদি এইসব ঘৃণা ছড়ানোর কাজটা না করতো, সেক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকে দোষারোপ করা যেত বাক-স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করার জন্য। কিন্তু, এক্ষেত্রে তা হয় নি।

জেনে হোক, কিংবা না জেনে হোক, বুঝে কিংবা না বুঝে হোক, জাকির নায়েক এবং তাঁর পিস টিভি আমাদের সমাজে ধর্মীয় ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, সেই সেই বিষবাষ্পের ফলাফল কতখানি ভয়াবহ, কতখানি রক্তাক্ত, কতখানি প্রাণহানিকর, সেটা আমরা গুলশানের ট্র্যাজিক ঘটনা  থেকেই কিছুটা অনুমান করতে পারি। এরকম মারাত্মক কিছু ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে, তার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সেটা সরকারকেই করতে হবে।

তারপরেও কথা হচ্ছে, পিস টিভির এই নিষিদ্ধকরণ কি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমি বলবো সম্ভব। যদি সরকারী ইচ্ছা পূর্ণমাত্রায় থাকে। এখানে সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চা কম হবার কারণে আইন বিভাগ খুব অল্প সময়ই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পায়। সেকারণে সরকার যদি চায়, তারা যদি মনে করে যে, পিস টিভি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর, এর মাধ্যমে সমাজে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, সন্ত্রাসীরা জিহাদে যাবার জন্য প্ররোচনা পাচ্ছে, সহিংসতা ঘটছে বা ভবিষ্যতে আরো ঘটার সম্ভাবনা আছে, তবে এখানে আইন আদালতের আশ্রয় নিয়েও জাকির নায়েক খুব একটা কিছু সুবিধা করতে পারবেন না বলেই আমার ধারণা। কিন্তু, ভারতের ক্ষেত্রে সেরকম নাও হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাস বাংলাদেশের তুলনায় বহু পুরনো এবং অনেক বেশি সমৃদ্ধ। গণতন্ত্রের বিকাশ শক্তিশালী করতে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের দরকার, তার সবই ভারতে আছে এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত বাইরের কোনো চাপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। এখন পিস টিভির নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের জন্য জাকির নায়েক যদি আদালতে যান, তবে ভারত সরকারের বেশ কঠিন একটা সময় যাবে এই নিষিদ্ধতার পক্ষে প্রমাণাদি দাখিল করার। কারণ, জাকির নায়েকের বেশিরভাগ কথাই দ্ব্যর্থবোধক এবং যদি শর্তমূলক। তিনি সরাসরি সহিংসতায় উস্কানি দিচ্ছেন, এটা তাঁর বক্তব্য থেকে প্রমাণ করাটা বেশ শক্ত কাজই হবে ভারত সরকারের জন্য।  

জাকির নায়েকের আইনজীবীরা তাঁর বক্তব্যের নানা দ্ব্যর্থবোধক অর্থ বের করে আইনের ফাঁক গলে তাঁকে বের করে নিয়ে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। তাঁদের প্রধান যুক্তিই হবে, পিস টিভির উপর সরকারী এই নিষেধাজ্ঞা বাক-স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করছে। এর বিরুদ্ধে ভারত সরকার পিস টিভিকে ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে কতখানি শক্তিশালী প্রমাণ নিয়ে হাজির হতে পারে, সেটাই হবে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতে জাকির নায়েক এবং পিস টিভি আদালতের মাধ্যমে পার পেয়ে গেলে, এটিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করে রাখাটাও নৈতিকভাবে  হুমকির মুখে পড়ে যাবে।

পিস টিভির অনুরাগীরা বা পিস টিভিকে নিষিদ্ধ করাটা বাক-স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ, এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী লোকজনের কণ্ঠস্বরও তখন আরো জোরালো এবং ধারালো হয়ে উঠবে।

ফরিদ আহমেদ, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ