আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

৭/১-এর জঙ্গি হামলা: একটি সামষ্টিক দায়

বিজন সরকার  

জুলাইয়ের এক তারিখ। দিনটি ছিল শুক্রবার। সারা দিনের ব্যস্ততা ছেড়ে ফেসবুক খুলেছি মাত্র। বাংলাদেশের সময় প্রায় রাত নয়টার কাছাকাছি। বিবিসি বাংলা বিভাগের ফেসবুকের পাতায় বিবিসির একটি অনুরোধ দেখলাম। গুলশান এলাকায় গোলাগুলি হচ্ছে। দুটি মোবাইল নম্বর দিয়ে বিবিসি বাংলা অনুরোধ জানিয়েছে, কেউ যদি সেই এলাকায় উপস্থিত থাকেন বিবিসি বাংলা তাদের সাথে কথা বলতে চায়।

রাত নয়টার দিকে দেশের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলি গুলশান হামলার উপর অবিরাম সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। দেশে বিদেশে সকলেই জানল যে গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে। জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে এবং জঙ্গিদের হামলায় দুই পুলিশ অফিসার মারা গিয়েছেন এই পর্যন্ত সংবাদ আমাদের গণমাধ্যম গুলি দিতে সমর্থ হয়েছে। তারপরের সকল সংবাদের জন্য আমাদের গণমাধ্যমগুলি সেকেন্ডারি উৎসের উপর নির্ভরশীল ছিল। পুরো ঘটনাটির তাৎক্ষনিক তথ্যের জন্য সাইট ইন্টেলিজেন্স,বিবিসি ও সিএনএনের মত সংবাদ মাধ্যমের প্রতি নির্ভর করতে হয়েছে।

হামলা করেছে আইএস এবং মোট বিশ জনকে যে হত্যা করা হয়েছে, সেই সংবাদটিও আমরা প্রথম পাই রাত দেড়টা থেকে দুইটার নাগাদ সাইট ইন্টেলিজেন্স এবং বিবিসি থেকে। পরের দিন আইএসপিআরের সংবাদ সম্মেলনের আগ পর্যন্ত দেশীয় গণমাধ্যমগুলি নিশ্চিত করেনি জঙ্গিরা কতজনকে হত্যা করেছে কিংবা হামলায় কতজন জঙ্গি অংশ গ্রহণ করেছে।    

বেসরকারি টিভিগুলির সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশনের ক্ষেত্রেও ছিল অপরিপক্বতা।  টিভি চ্যানেল গুলি লাইভ সম্প্রচারের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। র‍্যাব প্রধানের সরাসরি সম্প্রচার না করার অনুরোধও অনেক টিভি উপেক্ষা করেছে। হোলি আর্টিজানের ভিতরেও যে জঙ্গিরা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান সম্পর্কে জানতে পারছে, তা আমাদের বিবেচনাতেই আসেনি। টিভিগুলির উদ্দেশ্যই ছিল ব্যবসা, টিআরপি বাড়ানো। অথচ বেসরকারি টিভির বয়স প্রায় দেড়যুগের উপরে। এখনো পেশাদারিত্বে পুষ্টিহীনতার ছাপ স্পষ্ট।

জঙ্গিবাদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মতই দেশের গণমাধ্যমগুলি তেমন সচেতন নয়। বাংলাদেশের প্রধান দুটি সমস্যার একটি হল জঙ্গিবাদ। আরেকটি হল দুনীতি। তৃতীয় বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলির মধ্যে যে সব দেশে দুনীতির প্রসার ঘটেছে, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ সমান্তরালভাবে বেড়েছে। অথচ দেশের গণমাধ্যমগুলি এই দুইটি ইস্যুতে যে মাত্রায় ভূমিকা রাখার কথা, সেই মাত্রার ভূমিকাটি দেখা যায় না।

আমরা যদি বিগত সময়ের গণমাধ্যমের প্রডাকশন গুলি পর্যালোচনা করি, দেখা যাবে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে গভীর অনুসন্ধানী রিপোর্ট তেমন একটা নেই। জঙ্গিরা তাদের অপারেশন ঘটানোর পর আমরা গণমাধ্যমের দৌড় ঝাঁপ দেখতে পাই। সোজা ভাবে বললে বলাযায় যা ঘটে তাই মিডিয়াতে আসে। প্রায়ই ঘটনাগুলি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগে আসে। অনেকে ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিচার বিশ্লেষণ হওয়ার পরে আমাদের গণমাধ্যমে স্থান পায়। কি ঘটতে পারে সেই ধাঁচের অনুসন্ধানী রিপোর্ট তেমন দেখা যায়না। অথচ নিরাপত্তার বাহিনীর দুটি চোখ থাকলে মিডিয়ার চারটি চোখ থাকার কথা। কেন যে গণমাধ্যমগুলি দীর্ঘ চার দশক ধরে প্রত্যাশিত জায়গায় আসতে পারে নাই, সেটির উত্তর খোঁজাও জরুরি হয়ে পড়ছে।

দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলির চিন্তা চেতনা ও পেশাদারিত্বের গভীরতার একটি উদাহরণ দেই। অনলাইনের ওপেন সোর্স থেকে একটি স্যাটায়ারকে সত্যি ধরে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত গণমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রথম সারীর গণমাধ্যমগুলি স্যাটায়ারটিকে সংবাদ আইটেম হিসাবে প্রকাশিত করেছে। সংবাদটির সততা যাচাই বাছাই করার জন্য সামান্যতম পেশাদারিত্বের অবস্থান থেকে ইউনেস্কোর অফিসিয়াল ওয়েব পেইজটি দেখার প্রয়োজন অনুভব করা হয়নি।

১.৬২ বিলিয়ন মানুষের বিশ্বাসকে এইভাবে ইউনেস্কোর সনদ দেওয়া যে ধৃষ্টতার পর্যায়ে পরে এটির বুঝার মত সামান্যতম জ্ঞান কি আমাদের গণমাধ্যমের নেই? ইউনেস্কো কোন বিশ্বাসকে সনদ দেয়নি। কোন ধর্মীয় বিশ্বাসকে সনদ দেওয়া ইউনেস্কোর এজেন্ডার মধ্যে পড়ে না এমন একটি ঘোষণা সংগঠনটির অফিসিয়াল ওয়েব পেইজে দেওয়ার পর গণমাধ্যমগুলির অনলাইন সংস্করণ থেকে সংবাদ আইটেমটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ঠিক একই ভাবে, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির সময় সর্বাধিক প্রচারিত একটি বাংলা পত্রিকা পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিভিন্ন ব্লগের লেখাকে সেই সকল পত্রিকার প্রতিবেদন হিসাবে এই দেশের জনগণকে খাইয়েছে।

দেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে যদি মুল ধারার গণমাধ্যমগুলি সোচ্চার থাকত, তবে জঙ্গিবাদের প্রসার সমাজের এত গভীরে যেত না। গণমাধ্যমে ভাল করেই জানার কথা দেশের কোন কোন প্রতিষ্ঠান জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র। কেবল নর্থ সাউথ নয়, বহু বেসরকারি ও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়েত ইসলাম, ইসলামিক ছাত্র শিবির ও হিজবুত তাহরির শিকড় অনেক গভীরে চলে গিয়েছে। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এখন জঙ্গিদের মেন্টর হিসাবে কাজ করছেন।

জঙ্গি নির্মাতাদের টার্গেট তরতাজা যুবকেরা। বিশেষ করে, সদ্য মাধ্যমিক স্কুল পেরিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর মস্তকের নিউরনগুলিকে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি বান্ধব করে তুলা হচ্ছে। ইসলামিক ছাত্র শিবির, হিজবুত তাহরির সহ অনেক জঙ্গি সংগঠন আমাদের সবার নাকের ডগায় বিপদজনক কাজটি করছে। একজন মানুষ তার স্কুল জীবনে যে আদর্শের আলোকে নিজের মননটি গঠন করে, বাকী জীবনের যে কোন প্রতিকূলতায় সেই আদর্শটিকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে। দেশের স্কুল পাশ করা শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের মস্তককে সবচেয়ে উর্বর সময়টিতে  ইসলামিক ছাত্র শিবির ও হিজবুত তাহরির মত জঙ্গি সংগঠন গুলি ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে বিষক্রিয়ায় নীল করে তুলছে।

যারা গুলশানে সেভেন ওয়ান ঘটিয়েছে, প্রতিটি জঙ্গির বয়স আঠার থেকে বাইশের কোঠায়। মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গণিত বিভাগের  শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যা-চেষ্টা মামলার কোন আসামিরও বয়সই ২৫ হয়নি। আসামিদের মধ্যে গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিমের বয়স ১৯, শাহরিয়ার হাসান ওরফে পলাশের ২২, জাহিনের ২৩,  রায়হানের ২৪, মেজবাহের ২৪ ও সালমান তাকসিনের উনিশ বছর বয়স।

জঙ্গিদের সম্ভাব্য প্রজনন কেন্দ্র, জঙ্গি মেন্টর হিসাবে কারা জড়িত, কোন কোন প্রতিষ্ঠান পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে জঙ্গি-পন্থী হিসাবে ভূমিকা রাখছে, আমাদের রাজনীতির কোন অংশ কৌশলে জঙ্গিবাদে উস্কানি দিচ্ছে সেইসব বিষয় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন গণমাধ্যমগুলি প্রকাশ করা উচিত।

দেশের কথিত সুশীল ও বুদ্ধিজীবী সমাজ আজো বনসাই হয়ে পরে আছে। এখনো এই সমাজ ডানে বায়ে তাকিয়ে কথা বলে। বাংলাদেশে উগ্রবাদের চাষাবাদ এই প্রথম নয়। ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রথম স্তর হল আন্ত-ধর্মীয় বিদ্বেষ। দেশের ভিতর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিক নির্যাতন সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশটির মননে ও আলাপ আলোচনায় স্থান পায়নি। নির্যাতনকারীরা দশকের পর দশক ধরে সুশীলের এড়িয়ে যাওয়া থেকে একটি নীরব সমর্থন পেয়ে আসছে। দেশের কবি সাহিত্যিকের কর্মেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের স্থান নেই। গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে একজন প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি চমৎকার (!!) মূল্যায়ন করেছেন। উনার মতে দেশে সেই অর্থে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে না। উনার বক্তব্যকে সারমর্ম করলে দাড়ায় ‘যাই হচ্ছে সেটি মেনে নেওয়াই ভাল’। অথচ উনি আওয়ামীলীগের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী। আরেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর মূল্যায়ন হচ্ছে দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগুরুদের নির্যাতন করছে।

জঙ্গি হামলা ধরন দেখে সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের চেতনা ও সংবেদনশীলতা প্রকাশ পায়। বিগত কয়েক মাস ধরে বুদ্ধিজীবীদের এই ধরনের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেভেন ওয়ান না ঘটলে হয়ত উনাদের বক্তব্যের প্রবণতা একটি নির্দিষ্ট লিনিয়ার রেখা অনুসরণ করত। ফলে সমাজ বিভক্তকারী ও ঘৃণা প্রচারক জাকের নায়েকের দোষ একার নয়। দেশের সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ নানান রূপে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে জাকের নায়েকের ভূমিকা পালন করছে।

আইএস সৃষ্টিতে পশ্চিমাদের মুল ভূমিকা রয়েছে। ইরাকে আইএস যখন গঠন হয় তখন মার্কিন সেনা গোয়েন্দার প্রধান ছিলেন মাইকেল টি ফ্লেন। বহু সাক্ষাতকারেই ফ্লেন স্বীকার করেছেন যে আইএস যখন সৃষ্টি হয় তারা বুঝতে পারছিলেন। ইরাক থেকে মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টও পাঠানো হয়েছিল হোয়াইট হাউজে। অজ্ঞাত কারণে মার্কিন প্রশাসন নীরব ছিল।

আইএস সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল সিরিয়ার বাশার আল আসাদকে সরানোর জন্য। মার্কিন প্রশাসন আসাদকে রেখে সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সংস্কারের পক্ষে ছিলেন। কেবল মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির বিশ্বস্ত মিত্র সৌদি আরবের চাপে ওবামা প্রশাসন সেই দিকে আগাতে পারেনি। সিরিয়াতে রাশিয়া হামলার পরেও সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে সকল বহুজাতিক সভা হয়েছে, সেখানেও আসাদকে রেখে একটি সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তাতেও সৌদি আরব আপত্তি জানায়।

এখানেই সুশীল ও বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। পশ্চিমরা তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে আইএস সৃষ্টির জন্য নীতিগত সমর্থন দিয়ে গেছে। কিন্তু সেসব দেশগুলি থেকে মানুষ আইএসে যোদ্ধা হিসাবে যোগ দিয়েছে তাদের কি কোন দোষ নেই?  যারা আইএসকে অর্থায়ন করল, তারা নিষ্পাপ? অতি সম্প্রতি আইএসের যোদ্ধাদের যে তালিকা  প্রকাশ হয়েছে, সেখানে আইএসের মোট যোদ্ধার মধ্যে চারভাগের একভাগ সৌদি আরবের  নাগরিক। এটি ওপেন সিক্রেট যে আইএসের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সৌদি আরব,কাতার আর কুয়েতের টাকায় । তুরস্কের আইএসের তেল বিক্রির টাকাও রয়েছে।

ফলে আমরা যখন জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলি, সেই ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকাটিকে এড়িয়ে গিয়ে কেবল পশ্চিমাদের দোষ দেওয়াটি দিন শেষে জঙ্গিদের পক্ষে যায়। যার যতটুকু অবদান সেই ডিগ্রি অনুযায়ী বিশ্লেষণ হওয়া উচিত। তা না হলে একটি নির্দিষ্ট জাতি গোষ্ঠীর প্রতি উগ্রবাদ সমাজে বিনির্মাণ হয়।
দেশে জঙ্গি উত্থানের কারণ হিসাবে আরেকটি ন্যারেটিভস সামনে আনা হয়। বলা হয়ে থাকে দেশে বিরোধী দল নেই; ফলে  জঙ্গিরা সেই শূন্যতা পূরণ করছে। কোন সন্দেহ নেই যে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল আমাদের দেশের শিশু গণতন্ত্রের জন্য খুবই অপরিহার্য।তবে জঙ্গিবাদকে যে গণতন্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না সেটি আমাদের সুশীলরা বুঝেও না বুঝার ভান করেন।

পশ্চিমা দেশগুলিতে গণতন্ত্র থাকা স্বত্বেও কি জঙ্গি হামলা হচ্ছে না? পাশের দেশ ভারতে কি গণতন্ত্র নেই? সেখানে কি জঙ্গিরা হামলা করেনি? ফলে কেবল গণতন্ত্রের দুর্বলতার জন্য জঙ্গি হামলা হচ্ছে এটি একটি দুর্বল মতামত। আবার অনেক রাষ্ট্রে শরিয়া ও শরিয়াসাদৃশ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকা স্বত্বেও জঙ্গি হামলা হচ্ছে। বরং সেই সকল দেশ থেকেই জঙ্গিবাদ কচুরিপানার মত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। উদাহরণ স্বরূপ তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সৌদি আরব।

দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এটি সত্য যে সরকারের বিশেষ কিছু বাহিনী দীর্ঘ কয়েক বছর জঙ্গিদের অপারেশনাল কর্মকাণ্ড বেশ দক্ষতার সহিত নিয়ন্ত্রণ রাখার সক্ষমতা দেখিয়েছে। তবে বর্তমানে যে নতুন মাত্রার জঙ্গিপনা দেখা দিয়েছে, তা মোকাবেলা করার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সেভেন ওয়ান যে আমাদের গোয়েন্দা ব্যর্থতার ফল এটি স্পষ্ট। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ ও গোয়েন্দা-সংস্থা গুলি একই সময়ে জঙ্গি হামলার খবর জানতে পারে।  

সমাজের উচ্চ স্তরের শত শত যুবক আত্মঘাতী হয়ে উঠছে, অথচ আমাদের গোয়েন্দারা টেরই পায়নি। আমাদের কাছে এখনো কোন পরিসংখ্যান নেই যে কত জন বাংলাদেশী নাগরিক আইএসে যোগদান করেছে। খোদ ঢাকার ভিতরেই বহু মুল ধারার প্রতিষ্ঠান থেকে শতশত শিক্ষার্থী নিখোঁজ, আমাদের গোয়েন্দারা জানতেই পারেনি। সেভেন ওয়ানের পরে গোয়েন্দারা মাত্র দুই দিন চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে শতাধিক ছাত্র নিখোঁজের সন্ধান পেয়েছে। নিখোঁজ থাকার প্রায় শত ভাগই উচ্চবিত্ত, ব্যবসায়ী,শিল্পপতি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত একশ্রেণীর কর্মকর্তাদের সন্তান।

প্রশ্ন হচ্ছে এই যে জঙ্গি নেটওয়ার্ক এটি কি একদিনে গড়ে উঠেছে। এই ধরনের নেটওয়ার্ক গঠন করার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। অথচ আমাদের গোয়েন্দারা আঁচ পায়নি, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটি কি কেবল গোয়েন্দা ব্যর্থতা, নাকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে থাকা কেউ কেউ সেই সুযোগ করে দিচ্ছে? আওয়ামীলীগের ভিতরের লোভী-লীগ অংশটির প্রতিনিধিবৃন্দ এই প্রশ্নটির উত্তর ভাল করেই দিতে পারবে। সরকারের উচিত কাল বিলম্ব না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের ভেটিং-এর আওতায় আনা। এমনকি যে সকল লোভী লীগের সদস্য অর্থের জন্য জামায়াত–শিবিরপন্থী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের পক্ষে কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া।

রাজনৈতিক দলগুলির সুবিধাবাদিতাও জঙ্গিবাদ উত্থানের পিছনে ভূমিকা রাখছে। একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ কি করে আশা করেন যে জামায়েত ইসলাম বাংলাদেশের স্বার্থে রাজনীতি করে? জামায়েত-ইসলামের রাজনীতি সমাজে রেখে সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়। জামায়াতে ইসলাম কৌশল করে দেশের সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। জামায়েত খুব দ্রুতই আগাচ্ছে, দুর্বল হচ্ছে বিএনপি।

জামায়েত ইসলাম বহু ক্ষেত্রেই সফল। আজ যে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের নীল বিষে সমাজ আক্রান্ত, বাংলাদেশে এটির প্রাইমারি উৎস হচ্ছে জামায়েত ইসলাম। বাংলাদেশে কল্পিত আইএস , হিজবুত তাহরির,  জেএমবি কিংবা আনসার উল্লাহ বাংলা টিম হল জামায়েত ইসলামের রাজনীতির বাই প্রডাক্ট। সেভেন ওয়ান হামলার ঘটনায় জামায়েত ইসলাম ঠিকই আড়াল থেকে হাসছে।

কিছু দিন আগে ডা. জাফরউল্লাহ বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে আহ্বান জানিয়েছিলেন বিএনপি যেন জামায়েত ইসলামকে ছেড়ে দেয়। মঞ্চে বেগম জিয়াও উপস্থিত ছিলেন। ডাঃ জাফর-উল্লাহ আহ্বান বেগম জিয়া সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। বিএনপি এবং জামায়াত একে অন্যের পরিপূরক। বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি জামায়েতকে ছাড়া অনেকটা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অন্ধ মানুষের মত। জামায়েত ইসলাম জঙ্গিবাদের ম্যানুফ্যাকচারার এটি কেবল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নয়, পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রই বিশ্বাস করে।অথচ এই জামায়েত ইসলাম থেকে অপারেশন করেও বিএনপিকে আলাদা করা সম্ভব নয়।

জামায়েত ইসলাম নামক বিষাক্ত সাপটি বেশ চতুরতার সহিত এখন আওয়ামীলীগের উপর ছোবল দিচ্ছে। লোভী-লীগ জামায়েতকে বিষাক্ত ছোবল দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। জামায়েত ইসলামের জঙ্গি অর্থনীতির প্রতি এই লোভী লীগের দৃষ্টি রয়েছে। রাজশাহী, বগুড়া,সাতক্ষীরা বা চট্টগ্রামে এমন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা জামায়েত ইসলামের সাথে বুঝাপড়া না করে চলাফেরা করে। প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখি, আওয়ামীলীগের নেতাদের টাকা পয়সা দিয়ে জামায়েত ইসলামের সন্ত্রাসী নেতা কর্মীরা আইনের বাইরে থাকে।

দেশের জঙ্গিবাদের মুল কারণসমূহ নির্ণয় করা হয়ত একাডেমিক গবেষণার বিষয়। তবে আমরা যারা বিভিন্ন শ্রেণী পেশায় সচেতন মানুষ, তারাও জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে জঙ্গিবাদে ভূমিকা রাখছি।

বিজন সরকার, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ