প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ২২ জুলাই, ২০১৬
সাম্প্রতিক বিভিন্ন ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গিবাদী তৎপরতা মোকাবিলার জন্য কার্যকর ঐক্যবদ্ধ জাতীয় উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে সব মহল থেকে। এই সংকট মোকাবিলায় ঐক্যের যে কোনো বিকল্প নেই, সেটা সবাই জানেন এবং মানেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্যের উপাদানের যথেষ্ঠ ঘাটতি আছে। এক পক্ষ বলছে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে জাতীয় ঐক্যসৃষ্টি হয়েছে। আরেক পক্ষও ঐক্যের তত্ত্ব-তালাশে ব্যস্ত। যদিও ঐক্যবিরোধী উপাদান তারা সঙ্গে নিয়েই হাঁক-ডাক ছাড়ছে।
অনেকেই ঐক্যের ব্যাপারে বিএনপিকে জামায়াত ত্যাগের শর্ত দিচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করে একটি রায় প্রদান করেন। জামায়াত সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করে। আপিল মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি এখনো। আরও একটি কারণে দেশের প্রগতিশীল গণতন্ত্রীরা জামায়াতের বিরোধিতা করে। সে কারণটি হচ্ছে তাদের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। যারা জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে, ধর্মের নামেই চালাচ্ছে। তাই এই ধরনের তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক নিয়ে কথা আছে, বিশেষ করে কয়েকটি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের কারও কারও শেকড় ছিল জামায়াতে— এটা বহুল প্রচারিত।
এ ছাড়া জঙ্গিবাদ নিয়ে বিএনপির অবস্থান ও ভূমিকা মোটেও স্বচ্ছ নয়। তাদের এক রা- এটা হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের কারসাজি! বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জঙ্গি তাণ্ডবে সরকার ও প্রতিবেশী দেশের সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ বেগম জিয়া ১৪ জুলাইর বৈঠকে করেছেন তার ভিত্তি কি, কোন তথ্য সূত্রে তিনি এমন অভিযোগ করলেন– এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। তিনি ঐক্য চাইছেন। তবে জঙ্গিবাদের অভিযোগে অভিযুক্তদের ত্যাগও করতে চাইছেন না। অর্থাৎ কেবল চাওয়ার জন্যই চাইছেন।
আমাদের দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ বিকাশে জামায়াত-বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। তাদের শাসনামলেই দেশে জেএমবিসহ জঙ্গিবাহিনী বিকশিত হয়। সারাদেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ হয়। মানুষকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। বিএনপির একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে জঙ্গি কানেকশনের খবর প্রকাশিত হয়। সে এক কালো অধ্যায়!
পরবর্তী সময়ে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে সব সময়ই জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়-মদদ জুগিয়েছে। তাদের রাজনৈতিক হিসেব মতো, জঙ্গিরা যত বেশি হত্যা-আক্রমণ পরিচালিত করবে, হাসিনা সরকার তত বেশি দুর্বল হবে। আর ততই নিজেদের ক্ষমতায় যাবার পথ পরিষ্কার হবে। জঙ্গি হামলায় জামায়াত-বিএনপি জোটের এই ‘স্ট্র্যাটেজি’ জঙ্গিবাদকেই উৎসাহ যোগাচ্ছে। জামায়াত-উল-মুজাহিদিন, আনসারউল্লা বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীর প্রভৃতি গোষ্ঠীগুলোর পেছনে জামায়াতের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এসব দলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এই জামায়াত-শিবির চক্র বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশজুড়ে হাজার হাজার মানুষ খুন করেছে। বুদ্ধিজীবীদের খুন করেছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রগতিশীল ছাত্রকর্মীদের রগকাটা কালচার চালু করেছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাদের নেতাদের বিচার করেছে এবং চরম শাস্তি দিচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশকে অশান্ত করতে হবে। ২০১৩ সাল থেকে মুক্তমনা মানুষেরা আক্রান্ত। প্রকাশ্যে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধদের উপর পরিচালিত হচ্ছে আক্রমণ। সবই করা হচ্ছে ‘ইসলামের’ নামে। দেশে লাগাতার খুন হচ্ছে। জঙ্গিরা কুপিয়ে, জবাই করে হত্যা করছে। জামায়াত-বিএনপি জোট মুখে কুলুপ এঁটে থাকছে। তাদের প্রতিবাদ নেই, ঘৃণা প্রকাশ নেই! করবে কীভাবে? জঙ্গিরা যে তাদের আকাঙ্ক্ষারই বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে!
এদিকে সরকারের সঙ্গে যারা আছে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে যারা পরিচিত, তারা নিজেরাও কিন্তু যথেষ্ঠ ঐক্যবদ্ধ নয়। তাদের মধ্যেও কাদা ছোঁড়াছুড়ি আছে। আছে অবিশ্বাস, সন্দেহ। যাদের ঐক্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, বলা চলে তাদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম অনৈক্য। যাদের শায়েস্তা করবার জন্য সবাই ঐক্য চাইছে এবং আরও বেশি ‘অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই ঘাতক জঙ্গিরা কিন্তু যথেষ্ঠই ঐক্যবদ্ধ। তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-দলাদলি-শর্ত-অবিশ্বাস কোনো কিছু নেই। তারা কঠিন ঐক্য বজায় রেখে তাদের মানবতা বিরোধী হিংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে।
আসলে আমাদের দেশে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন ব্যাপার। আমাদের দেশটা হলো ঝগড়া-বিবাদের দেশ। মারামারি হানাহানির দেশ। তুচ্ছ কারণে এমনকি অকারণেও এখানে ঝগড়া, মারামার, কলহ, কোন্দল চলতে থাকে। প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে কেবলই দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর সংঘর্ষের খবর। দলে দলে ঝগড়া-মারামারি, উপদলীয় কোন্দল আর এই কোন্দলকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষ-হানাহানি। মন্ত্রী আর উপদেষ্টায় কোন্দল, নেতায় নেতায় রেষারেষি, কর্মীতে কর্মীতে কোন্দল। শুধু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যেই নয়, বিভিন্ন পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, এমনকি ব্যক্তির মধ্যেও কলহপ্রবণতা দেখা যাচ্ছে। পুরো দেশটাই বর্তমানে কলহ-কোন্দলের দেশে পরিণত হয়েছে।
জাতি হিসেবে আমরা কতটা শান্তি প্রিয় আর কতটা কলহপরায়ণ- সে বিষয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্তে আসাটা মুশকিলের ব্যাপার। অনেকে জোরেশোরে প্রচার করে থাকেন যে বাঙালিরা চিরকালই নিরীহ এবং শান্তিপ্রিয়। সহজে তারা মুখও খোলে না, প্রতিবাদও করে না। মেনে নিয়ে এবং মানিয়ে নিয়ে বাঙালিরা ঝগড়া-কলহ এড়িয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেছে। আবার অনেকে মনে করেন যে, বাঙালি আসলে ভীষণ কোন্দলপরায়ণ ঝগড়াটে এক জাতি। অধিকাংশ বাঙালির পেট ভর্তি হিংসা এবং মাথা ভর্তি জিলেপির প্যাঁচ। আরেকজনের সর্বনাশ কামনা করা ছাড়া অনেকেরই কোনো ধ্যান নেই। অন্যেরটা মেরে, আরেকজনেরটা কেড়ে ঠকিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা ছাড়া অধিকাংশ বাঙালির কোনো সংকল্প বা জ্ঞান নেই। অন্যের সঙ্গে তো বটেই, বাঙালি চিরকাল স্বজনদের সঙ্গেও পায়ে-পা দিয়ে ঝগড়া করে। হিংসা-কোন্দল ছাড়া বাঙালির পেটের ভাত হজম হয় না।
বাঙালি সম্পর্কে হয়তো এই উভয় ধরনের মতই সত্য। এখানে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে কলহপরায়ণ ঝগড়াটেও। তবে কী এক অজ্ঞাত কারণে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকের সংখ্যাই বাড়ছে। স্বার্থপর হিংসুটে ঝগড়াটে মানুষগুলো ক্রমেই সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে, ছাত্র সংগঠনে, প্রশাসনে বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে এমনকি মন্ত্রিপরিষদেও এখন কোন্দলপ্রিয় হিংসুটেদের ভিড়। এই মানুষগুলো কেউ কাউকে দেখতে পারে না, কেউ কাউকে পছন্দও করে না। কেবলই একে অপরকে ল্যাং মারে অথবা সারাক্ষণ পারস্পরিক ধস্তাধস্তি করে। এখানে সবাই সবার সবার প্রতিদ্বন্দ্বী। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ছাত্রলীগ ছাত্রদলই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের, বিএনপির সঙ্গে বিএনপিরও কলহ হয়। প্রতিদ্বন্দ্বি বিভিন্ন দল ও সংগঠনে ঝগড়া-কলহ তো রয়েছেই, দলের মধ্যে উপদলীয় কোন্দলের ঘটনাও প্রতিনিয়ত ঘটছে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত হচ্ছে। মারামারি, খুনোখুনি পর্যন্ত হচ্ছে।
এদেশে সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী। সবার সঙ্গে সবার যেন অলিখিত শত্রুতা। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। চান্স পেলেই একজন আরেকজনকে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। দলের জুনিয়র নেতা সিনিয়র নেতাকে ল্যাং মারছে। আবার সিনিয়র নেতা জুনিয়রের কাঁধে পা দিয়ে চলতে চাইছে। শুধু সিনিয়র-জুনিয়র নয়, সিনিয়রের সঙ্গে সিনিয়রের, আবার জুনিয়রের সঙ্গে জুনিয়রেরও লড়াই বাধছে। নেতায় নেতায় সংঘাত, কর্মীতে কর্মীতেও সংঘাত চলছে।
সবাই জয় চায় কিন্তু এজন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায় না। উন্নতি ও কল্যাণের জন্য দলের নেতাকর্মী তো বটেই, এমনকি বাপকে পর্যন্ত গলা-ধাক্কা দিতে কেউ কসুর করছে না। নিজের আখের গোছানোর ক্ষেত্রে যে যাকে প্রতিদ্বন্দ্বি বা পথের কাঁটা মনে করছে, সে তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য কী আদৌ সম্ভব? কে কাকে ছাড়বে? কে কাকে মানবে?
কাজেই আসুন, ঐক্যের কথা না বলে আমরা বরং একে-অপরের বিরুদ্ধে কাছা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ি!ঐক্য নিয়ে অনৈক্যের খেলাকেই বিজয়ী করি। জঙ্গিবাদকে অনিবার্য ‘নিয়তি’ হিসেবে মেনে নিই!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য