আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

অবনী বেঁচে আছো!

দেবজ্যোতি দেবু  

অবনী বেঁচে আছো?
জবাব দেয় না অবনী। অবনী জবাব দিতে ভুলে গেছে। অবনী আজ বোবা হয়ে গেছে। চার দেয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে অবনীর আর্তনাদ সভ্য মানুষদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। বরং বধির সমাজ কড়া নেড়ে জানতে চায়, অবনী বাড়ি আছো?

সেই যে কবে অবনী মুখে হাসি, বুকে আনন্দ নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলো, আজ হয়তো সেটা মনেই নেই তার। খোঁপায় ফুল গুঁজে বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে সর্বশেষ সে কবে বৈশাখী উদযাপন করেছে, তার মনে নেই। সন্ধ্যার পরে কাজ সেরে রিকশা, বাস অথবা সিএনজি করে সর্বশেষ একা কবে বাড়ি ফিরেছিল, সেটাও আজ স্মৃতির অগোচরে মিলিয়ে গেছে। শেষ কবে গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে, কোমরে শারীর আঁচল গুঁজে, হাতে কাশফুল নিয়ে নাচতে নাচতে ছুটেছিল, সেটাও ভুলে গেছে অবনী। কলসি কাঁখে হাসতে হাসতে শেষ কবে জল আনতে গিয়েছিল সেসব কথা এখন ভুলেও মনে পড়ে না তার।

অবনী হয়তো সেসব কথা ভুলেই গেছে। অবনী ভুলে গেছে, সেও মানুষ। সুস্থ পরিবেশে স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা মনে করতেও কষ্ট হয় তার। সভ্যতার আড়ালে সমাজের কুৎসিত অন্ধকার ছিঁড়ে, খাবলে খাচ্ছে তাকে। কখনো ফলের বৃক্ষ, কখনো তেঁতুল, কখনোবা মিষ্টির হাড়ি, নানান নামের আড়ালে তার মানুষ পরিচয়টা ঢাকা পড়ে গেছে সমাজের কাছে।

কেন বোবা হয়ে গেছে অবনী? কেন বোবা হতে হচ্ছে তাদের? প্রতিদিন অবনীকে বিবস্ত্র হয়ে পড়ে থাকতে হয় ঝোপের পাশে, জঙ্গলে, ডাস্টবিনের পাশে, নদীর পাড়ে, নির্জন অন্ধকার গলির মধ্যে। কখনো অবনীকে পাওয়া যায় লাশ হয়ে ঝুলে আছে ঘরের সিলিং-এ, গাছের ডালে। এতকিছুর পরেও যদি মৃত্যুদূত করুণা না করে, তাহলে অবনীর শেষ আশ্রয় হয় মাংস বিক্রির হাঁটে। সেখানেও যে সভ্যতা রোজ পকেট বদলি হয় অবনীর বিনিময়ে। সেখানে প্রেম বিছানা বদলি হয় রাতের অবসানে।

বিধ্বস্ত, নির্বাসিত অবনীর সাত পাঁকে বাঁধা হয় না। হয়না সীঁথি জুড়ে লাল পৃথিবী আঁকার সৌভাগ্য। থাকেনা কবুল পড়ে বৈধতা পাবার অধিকার। তাদের ভাগ্যের আকাশে নতুন সূর্যোদয় কখনোই হয় না। থাকেনা সন্তানদের বৈধতা দেয়ার ন্যুনতম অধিকার। কিভাবে দেবে! বাবুরা যে অবনীকে সতী দেখতে চায়। সমাজ যে অবনীকে দাসী বানিয়ে রাখতে চায়। সবাই তার সৌন্দর্যের, সতীত্বের খদ্দের। বাবুদের মতে, বিধ্বস্ত অবনী বড়ই কুৎসিত, কূলটা, অস্পৃশ্য। তার মাংস সুস্বাদু, তার সঙ্গ সাময়িক উত্তেজনা জাগাতে পারে। কিন্তু সে কখনোই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন, পরিচয় পাবার যোগ্য নয়।

অবনী ফিরে যেতে চায় শৈশবে। শৈশবের স্মৃতি মনে পড়তেই ভয়ে আঁতকে উঠে অবনী। শিশু অবনী কি নিজেকে মানুষ ভাবতে পেরেছিল? শৈশবেও কি সে ইচ্ছা-স্বাধীন ছুটোছুটি করতে পেরেছিল? তখন সে যে আরো অরক্ষিত, অসহায়। লজেন্স দেয়া বাবুরা যে শিশু অবনীকেও ছাড় দেয় না। বিকৃত মানসিকতার করাল আঘাত যে শিশু অবনীকেও লজ্জিত, বিধ্বস্ত হতে বাধ্য করে। পশুদের লালসার কাছে হেরে যেতে হয় শিশু অবনীকেও।

অবনী যেতে চায় সৃষ্টিশীল মানুষদের কাছে। শোনাতে চায় তার আর্তনাদ। কিন্তু সেখানেও সে আশাহত হতে বাধ্য হয়। কবির কলমের খোঁচায়, কল্পনায়, অবনীর কায়িক সৌন্দর্যের কদর সর্বাধিক। বণিক সমাজের কাছেও অবনীর দেহ অমূল্য। বণিক সমাজ বাণিজ্য চায়, কষ্ট না। তারা সৌন্দর্যের ফেরিওয়ালা, আর্তনাদের না। এতকিছুর ভীরে অবনীর আর্তনাদের চিত্র ঠাঁই পায় না কোথাও। অবনীর অশ্রুবন্যা কারো মনের বাঁধে আঘাত করে না। ভাঙ্গতে পারে না কুৎসিত উত্তেজনায় মেতে থাকা শকুনদলের লালসার বেষ্টনী। যারা একটু আধটু শুনতে পায়, তাদের কথা আবার এই সমাজ শোনে না। এই সমাজের কাছে তারা 'পাগল'।

নির্লজ্জ সমাজ অবনীকে পর্দানশীন হতে বলে। শরীর ঢেকে রাখতে পারলেই অবনী নিরাপদ থাকবে। মানুষের সম্মানটাও এদের কাছে শরীর কেন্দ্রিক! পর্দা করলে সম্মান পাবে, না হলে মরতে হবে! নিরাপত্তার স্বার্থে অবনী রক্ষণশীল হয়। আপাদমস্তক নিজেকে ঢেকে দেয় কালো পর্দায়। তবুও কি বাঁচতে পারে অবনী? সুরক্ষিত সেনা ক্যাম্পের সীমানা প্রাচীরের ভিতরে অবনীর ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ বলে দেয়, পশুদের ভিড়ে পর্দাপ্রথা প্রহসন মাত্র। সম্মানটা মানবতা বোধ থেকে জন্মায়, পর্দা থেকে নয়। পর্দাবিশ্বাসীরা অভিজাত রেস্টুরেন্টে চাপাতি নিয়ে হামলে পড়ে অবনীর উপর। জখমে জখমে রক্তাক্ত করে তাকে। কুমিল্লা থাকা গুলশান, কোথাও নিরাপদ না অবনী। ওদের পাশবিকতা প্রমাণ করতে চায়, "জন্মই অবনীর আজন্ম পাপ"।

বেলা শেষে হেরে যায় অবনী। তার হেরে যাওয়া আমাদের লজ্জিত করেনা। তার ধুলো জমা স্মৃতির পাতা আমাদের স্মৃতিকাব্যে দাগ কাটেনা মোটেও। বরং আমরাই বাজারে নিলামে তুলি অবনীকে। আমাদের এই পাশবিকতা লজ্জিত করে মানবিকতাকে। হারিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। কিন্তু অপরাজেয় থেকে যায় আমাদেরই পাশবিকতা। কেন এমন হয় বলতে পারেন?

তবুও ঘুরে দাঁড়াতে চায় অবনী। আশাবাদী হয়। বিশ্বাস করতে চায় প্রিয় বাংলাদেশ আবার তাকে মানুষ পরিচয়ে বাঁচার সম্মান দিবে। অবনী বলে, "আবার ফিরবো তোমাদের গাঁয়ের মেঠো পথে। ফিরবো গ্রাম্য বঁধুর কাঁখের কলসি হয়ে। ফিরবো ঘাসের কচি ডগায় শিশির বিন্দু হয়ে। নবান্নে সোনালি ধানে কৃষকের মুখের হাসি হয়ে। ততদিন তুমি বেঁচে থাকবে তো প্রিয় বাংলাদেশ?"

ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টায়। সময়ের সাথে সাথে আরো নৃশংস হতে থাকে সমাজ। বাংলাদেশ ডাক দেয়, "অবনী বেঁচে আছো"?

জবাব দেয় না অবনী। অবনী জবাব দিতে ভুলে গেছে। অবনী আজ বোবা হয়ে গেছে। চার দেয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে অবনীর আর্তনাদ বাংলাদেশের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। বরং বাংলাদেশের বধির সমাজ কড়া নেড়ে জানতে চায়, অবনী বাড়ি আছো?

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ