প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ২৬ জুলাই, ২০১৬
অতীতে বহুবার বহু জায়গায় দেখেছি, পড়েছি। আজ আবার দেখলাম। একটি বিআরটিসি বাসে লেখা আছে: ‘তাড়াহুড়া করবেন না, আগে নামতে দিন। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।’ লেখাটা দেখে মনের মধ্যে চট করে চিন্তা খেলে গেল, সত্যিই কী তাই? জীবনের মূল্য বেশি? এই মূল্য কার কাছে? কোথায়? বর্তমান জমানায় মানুষের জীবনের দামই কী সবচেয়ে সস্তা নয়? চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, সবখানে তো জীবনেরই করুণ অপমান, নৃশংস মৃত্যু! জীবনকে মূল্যহীন, স্তব্ধ করে দিতেই যেন চারদিকে ব্যাপক আয়োজন চলছে। মানুষ খুনের এই ভোজবাজিতে আমরা যেন কেবলই অসহায় অক্ষম দর্শক!
আসলে জীবন যে মূল্যবান, এই সহজ সত্যটাই আমরা এখন ভুলতে বসেছি। মিউনিখে ম্যাকডোনাল্ডসে যে কিশোররা জীবনের স্বাদ পেতে এসেছিল, ফ্রান্সের নিস শহরে আপামর ওই যে অজস্র মানুষ জীবনের জয়গাঁথার উৎসবে মত্ত ছিলেন, কাবুলে অসংখ্য মানুষ যারা আরও একটু ভালো জীবনেরই সন্ধানে বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন, তাঁদের জীবনের মূল্য কী? শোলাকিয়া বা গুলশানে, বাগদাদে বা সিরিয়ায়, আফগানিস্তানে অথবা পাকিস্তানে-আচমকা, এক লহমায় অসংখ্য মানুষ এক আর্তনাদে সামিল হয়ে যাচ্ছেন যখন, জীবন তাঁদের ক্ষেত্রে কী অর্থে মূল্যবান থাকছে?
অথচ তাঁরা, তাঁদের জীবিত আত্মীয়-বন্ধুরা ওই জীবনকে মূল্যবান ভেবে এসেছেন। ভাবেন এখনও। ভাবে না মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি। নিজের জীবনকেও মূল্যবান ভাবে না বলেই অন্যের কোনও দামই আর থাকে না তাদের কাছে। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা যাদের বলছেন ‘একাকী নেকড়ে,’ ‘লোন উলফ’ অথবা জনা কয়েক মিলে অনেক মানুষ মেরে সব শেষে নিজেরাও মরে যাও। অসংখ্য নিরীহ, ধর্মভীরু, শান্তিপূর্ণ মানুষের মৃত্যু কোন ক্ষমতাকেন্দ্রকে আঘাত করার হাতিয়ার, কার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ— এই সব প্রশ্নকে অবান্তর করে দিয়ে আপাতত মৃত্যুর মিছিলই বাড়ছে। যেন এর শেষ নেই। নেই কোনো প্রতিকার!
কিন্তু আমরা তো জানি, জীবন মূল্যবান থেকেছে এ যাবত তার নিজের দ্যুতিতে। কত কী করার রয়েছে, এই বোধই হীরকখচিত করেছে জীবনের বোধকে। তাইতো বাঙালি দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম জোর দিয়ে উচ্চারণ করেন: ‘জীবন জয়ী হবে।’
তবে ইদানীং জীবনটাকে সত্যিই মূল্যবান লাগছে। যে কোনও মুহূর্তে, কোনো কারণ ছাড়াই অজ্ঞাত ঘাতকের হামলায় খোয়া যেতে পারে এ জীবন! অতএব মূল্য বাড়ছে জীবনের। তার দামটা যেন টের পাওয়া যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে কোনো সুরক্ষিত গোপন কুঠরিতে প্রাণভোমরাটাকে লুকিয়ে রাখি! কিন্তু তেমন কুঠরি কোথায়?
প্রশ্ন হলো, কেন জীবনবিনাশী এই আয়োজন? কেন এই হত্যালীলা? সর্বশেষ গত শনিবারে কাবুলে যে হামলা চালানো হলো, কী অপরাধ করেছিল কাবুলের সেই ‘হাজারা’ সম্প্রদায়ের লোকেরা? কেন তাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে আত্মঘাতী হামলায় অন্তত ৮০ জনকে হত্যা করা হলো? পঙ্গু বানানো হলো প্রায় তিনশ মানুষকে?
সভ্যতার সামনে এখন জঙ্গি হামলাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। কখন, কোথায়, কোন পরিচয় নিয়ে ‘লোন উলফ’ বা ‘একাকী নেকড়ে’ ঝাঁপিয়ে পড়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবে তা কেউ আগেভাগে ঠাহর করতে পারছে না। এখন তো বোমা-বারুদ-অস্ত্রেরও দরকার পড়ছে না! হয়তো, কোনও একটা ট্রাক অথবা নিত্য নতুন অভিনব ‘অস্ত্রে’ মুহূর্তে এই রকম অনেক মৃত্যুর টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হবে!নিশ্চিত নিরাপত্তা ইতিমধ্যেই অসম্ভবে পর্যবসিত হতে বসেছে। কিন্তু জঙ্গিদের অভিনব কৌশল নিরাপত্তার বোধটাকেই শূন্যে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে।
তবে কি রূপান্তরের আশঙ্কাই সত্য? প্যারিস, বেলজিয়াম, ইস্তাম্বুল, বাগদাদ, ঢাকার পরে নিস, তারপর কাবুলে হামলা সন্ত্রাস-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এই প্রশ্নকে জোরালো করে তুলেছে। তাঁদের আশঙ্কা, ক্রমেই আল কায়েদার মতো শত্রুর ঘরে গিয়ে আক্রমণ চালানোর পথ বেছে নিচ্ছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
কঠোর ইসলামিক অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে খলিফাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা আইএস মূল উদ্দেশ্য ছিল। এই কারণেই আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ছিলেন আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি। কিন্তু যতই ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস কোণঠাসা হচ্ছে ততই আল কায়েদার পথে ফিরতে শুরু করেছে আইএস। কিন্তু আল কায়েদা যেমন সেল বা মডিউল তৈরি করে লক্ষ্যে আঘাত হানত, সে পথে যাচ্ছে না আইএস। বরং প্রধানত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে পশ্চিমী যুবক, যুবতীদের জেহাদে দীক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আর তারা কখনও দল বেঁধে (প্যারিস, ফ্রান্স), কখনও একলা (সান বার্নার্ডিনো, আমেরিকা) হামলা চালাচ্ছে। এটাকে বলা হচ্ছে, ‘লোন উলফ অ্যাটাক’।
জেহাদি আদর্শে দীক্ষিত কোন যুবক-যুবতী যে কোনও সময়ে হামলা চালাতে পারে। তাদের কাছে থাকা যে কোনও জিনিসই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। আল কায়েদা সাংগঠনিক কাঠামো মেনে বিভিন্ন সেলে ভাগ হয়ে কাজ করে। কিন্তু আইএস অনেক ক্ষেত্রেই প্রথাবহির্ভূত পথে নাশকতা চালায়। আইএসের সংগঠন অনেক ছড়ানো-ছিটানো। তার মধ্যে শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জেহাদে দীক্ষিত হয়ে যারা আইএস-এর হয়ে হামলা চালানোর ছক কষে, তাদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া বেশ কঠিন। ফলে আগাম হামলা ঠেকানো খুব শক্ত। তার উপরে এ ভাবে একটি হামলা সফল হলে অন্য জেহাদিদের মধ্যে এই ধরনের হামলা চালানোর উৎসাহ বাড়ে। এই ‘লোন উলফ অ্যাটাকই’ আগামী দিনে নিরাপত্তা সংস্থাগুলির মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে অনেকের ধারণা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এক দিন নিশ্চিত ভাবে ইরাক ও সিরিয়াতে আইএস-এর পতন হবে। নিজভূম থেকে আইএসকে মুছে ফেলা সম্ভব হলেও জেহাদিদের মনভূমি থেকে আইএস-কে মুছে ফেলা কার্যত অসম্ভব ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে। ইতিমধ্যে জঙ্গিবাদ মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে একটি ‘আদর্শবাদে’ পরিণত হয়েছে। যার পেছনে রয়েছে ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা।
যতদিন যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের হামলার পরিসর ততই বাড়ছে। দু’দশক আগেও সন্ত্রাসবাদীদের হামলার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল আমেরিকার নাগরিক ও সম্পদ। কালক্রমে তা প্রসারিত হয়েছে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ সামরিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অনুসারি দেশগুলিতে। আরও পরে ব্যাপৃত হয়েছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বে যুদ্ধের সমর্থনকারী দেশগুলিতে। এখন তো যারা জঙ্গি মতবাদের সঙ্গে নেই তাদেরই টার্গেট করা হচ্ছে। ভিন্ন মত, ভিন্ন সম্প্রদায়, ভিন্ন ধর্মের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। যদিও বিস্ময়কর ভাবে জঙ্গি হামলার নিশানা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি!
বস্তুত, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই। সন্ত্রাসবাদের পেছনে ধর্মীয় মৌলবাদের ভূমিকা যেমন একরকম অপরিহার্য তেমনি দারিদ্র্য, বেকারি, হতাশা, বিপন্নতা, অস্তিত্বহীনতাও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পুঁজিবাদের বিকাশ মানুষের সামাজিক, মানবিক ও পারিবারিক মূল্যবোধগুলিকে ভেঙে চুরমার করে ব্যক্তিসর্বস্ব ভোগবাদকে উৎসাহ দিয়ে ক্রমাগত মানুষকে নিঃসঙ্গ ও বিপন্ন করে তুলছে। তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় পরিচিতিসত্তাকে নির্মূল করে অসহায়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই বাস্তবতাই সন্ত্রাসবাদের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বত্র। সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্বজুড়ে তাদের সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থে সন্ত্রাসবাদকে পুষ্ট করে, মদত দেয় এবং ব্যবহার করে। ওসামা বিন লাদেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই সৃষ্টি। তেমনি সিরিয়ায় মার্কিন বিরোধী আসাদ সরকারকে উৎখাত করতে সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠী তৈরি করেছে আমেরিকা ও তার সহযোগীরা। এই সশস্ত্র বিরোধের জমিতেই বেড়ে উঠেছে আইসিস।
ধর্মের নামে ‘মগজ ধোলাই’য়ের মাধ্যমে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হামলা চালানো হচ্ছে। এটি ঠেকাতে হলেও দরকার কাউন্টার ‘মগজ ধোলাই।’ একটি মগজকে যদি ধোলাই করে আত্মঘাতী পথে ঠেলে দেওয়া যায়, অনেক মৃত্যুর জঙ্গি লক্ষ্য নিশ্চিত হয়ে যায়। তার চেয়েও বড় কথা, সর্বগ্রাসী এক ভয়ের জন্ম হয় সমাজজুড়ে। ধোলাই হওয়া কিছু মগজ, অসংখ্য নিরীহ মানুষের লাশ এবং চরাচর জুড়ে ভয়— জঙ্গি সাম্রাজ্যের এটাই মূল মন্ত্র। ধর্মের নামে অধর্ম রুখতে পারে একমাত্র মানুষই। আর সেটা সম্ভব মগজ ব্যবহারের মাধ্যমে। তা না হেলে জঙ্গি হামলার নিশানা থেকে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষ রেহাই পাবে বলে মনে হয় না।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য