আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিএনপির নতুন কমিটি : আমের চেয়ে আঁটি বড়!

চিররঞ্জন সরকার  

সবাই নেতা হয় না, কেউ কেউ নেতা হয়। যিনি নেতৃত্বের আসনে থাকেন তিনি দলকে এগিয়ে নিয়ে যায় সাফল্যের দিকে। আর রাজনৈতিক দলের সাফল্য হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি বাস্তবায়ন করাই যে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য। জাতি গঠনে ভূমিকা পালন, গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে চাপে রাখা, প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় ভূমিকা রাখা, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করা-এসবও রাজনৈতিক দলের কাজ। যদিও আমাদের মত দেশে রাজনৈতিক দলগুলো এ জাতীয় সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারায় খুব একটা পরিচালিত হয় না।  

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধাপে একটি করে কমিটি থাকে। মূল যে কমিটি বা দলের সুপ্রিম অথরিটিকে বলা হয় কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় কমিটিই মূলত একটি রাজনৈতিক দলকে পরিচালনা করে। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে এই কমিটিগুলো নির্বাচন করা হয়। এই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতা বা দলের মূল নেতা। আর আমরা জানি যে, যিনি নির্দেশ প্রদান করেন, সামনে থেকে সব কিছু পরিচালনা করেন তাকে নেতা বলে। নেতার গুণাবলি বা যোগ্যতাকে বলে নেতৃত্ব।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এইচ ও ডানেল এর মতে সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য জনগণকে সহযোগী হতে প্ররোচিত ও উদ্যোগী করার কাজকেই নেতৃত্ব বলে। নেতৃত্ব ব্যক্তি বা দলের সেই নৈতিক গুণাবলি যা অন্যদের অনুপ্রেরণা দিয়ে বিশেষ দিকে ধাবিত করে।  নেতার কাজ হচ্ছে সময় উপযোগী সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সংগঠনকে অভিষ্ট লক্ষে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। একটি সংগঠনের জন্য নেতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বা কর্মীরাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কর্মী থেকে অনেক সময় নেতা তৈরি হয়। আবার নেতার অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে কর্মী ও ফলোয়ার তৈরি করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি-চাহিদা-অধিকারবোধ ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে নেতারা সংগঠনকে নতুন দিক-নির্দেশনা দেন। নতুন নতুন সদস্য সংগঠনে যুক্ত হয়। এর সঙ্গে নেতৃত্বের পরিবর্তন করাটাও সাংগঠনিক চর্চা। নেতা আসে নেতা যায়, সংগঠন রয়ে যায়।

নেতা হলেন সেই ব্যক্তি যিনি এমন কিছু ঘটান যা সাধারণভাবে ঘটার কথা নয়। বস্তুত যা স্বাভাবিকভাবে ঘটবে, তার জন্য নেতার প্রয়োজন হয় না। যে কোনো ব্যক্তিই তা করতে পারেন। সত্যিকারের নেতা অনন্য, অসাধারণ, অতুলনীয়, অভাবনীয় কিছু সৃষ্টি করেন। নেতা বড় কাজ করেন। অর্থাৎ ‘ইনক্রিমেন্টাল চেঞ্জে’র বা ক্ষুদ্র পরিবর্তনের জন্য নয়, উল্লম্ফনের জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন পড়ে। তাই নেতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘আনরিজনেবলনেস’ বা দুঃসাহসিকতা।

উল্লিখিত পর্যবেক্ষণের আলোকে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির নতুন কেন্দ্রীয় নেতা-নির্বাচন নিয়ে আমরা খানিকটা আলোচনা করতে পারি। গত এক দশকে কোনো সুস্থ ও কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ দলটি কাউন্সিলের সাড়ে ৪ মাস পর এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ৫০২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছে।

উল্লেখ্য, প্রায় ১৬ বছর পর ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ৬ বছর পর গত ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল।

উল্লেখ্য, কাউন্সিলের ১০ দিন পর মহাসচিব মির্জা ফখরুল, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিনহার নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর তিন দফায় যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নিয়ে কমিটির ৪২ জনের নাম ঘোষণা করা হয়।

সর্বশেষ ১৯ সদস্যের যে স্থায়ী কমিটি, কাউন্সিলের এতদিন পরও ১৭ জনের নাম প্রকাশ করা হলো। যে দুটি পদ খালি আছে সেটির ব্যাপারে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব।

বিএনপির এই কমিটি দেখে মনে হয়েছে, যেন তারা দক্ষ যোগ্য নেতা নির্বাচন নয়, বরং পদবণ্টনের মাধ্যমে সবাইকে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেছে। তাইতো এমন ঢাউস সাইজের একটি কমিটি করা হয়েছে। এক চেয়ারপারসনের ৭৩ উপদেষ্টা রাখা হয়েছে!  এই উপদেষ্টারা বেগম জিয়াকে কী উপদেশ দেবেন? কীভাবে দেবেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না।

এই কমিটিতে পরিবারতন্ত্র বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। খালেদা জিয়া অনুমোদিত বিএনপির নতুন কমিটিতে দলটির নেতাদের পরিবারের এক ডজনের বেশি সদস্য স্থান পেয়েছেন। চেয়ারপারসন পদে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান পদে তার ছেলে তারেক রহমান কাউন্সিলেই নির্বাচিত হন। গালাগালিতে বিশেষভাবে দক্ষ স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মেয়ে অপর্ণা রায়কে প্রান্তিক ও জনশক্তি উন্নয়ন বিষয়ক সহ-সম্পাদক করেছেন খালেদা জিয়া। গয়েশ্বরের পুত্রবধূ নিপুণ রায় চৌধুরীও পদ পেয়েছেন, তিনি কার্যনির্বাহী সদস্য হয়েছেন। ভারতে বিচারের মুখোমুখি থাকার মধ্যেও স্থায়ী কমিটিতে আসা সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা আহমেদকেও রাখা হয়েছে নির্বাহী সদস্য হিসেবে।

তবে নাম ঘোষণার পরপরই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন নতুন কমিটির দুইজন সদস্য। নতুন কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী এবং সহ প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন, তবে তারা কোন কারণ উল্লেখ করেননি।

ওদিকে বিএনপির একজন সাবেক নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, যে স্থায়ী কমিটি গত ১০ বছরে দলকে ভালো কিছু দিতে পারেনি তাদেরকে নিয়েই গঠিত স্থায়ী কমিটি দলকে আগামীতে ভালো কিছু দিতে পারবে বলে জনগণ মনে করে না।

একটি রাজনৈতিক দলের ৭৩ জন উপদেষ্টা ও ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান কোনো অবস্থাতেই দলের শক্তির পরিচয় বহন করে না। এর মাধ্যমে দলের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতাই জনগণের সামনে ফুটে উঠেছে। এই সব অপ্রয়োজনীয় উপদেষ্টা ও ভাইস চেয়ারম্যান দলের গতিশীলতা দারুণভাবে বিঘ্নিত করবে এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মতৎপরতায় বাধা সৃষ্টি করবে।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির মূল পরিসর ছিলো ২১০ জনের। ২০০৮ সালের সম্মেলনে এই পরিসর বাড়িয়ে করা হয় ৩৭১ জনের। এবার তা আরও বেড়েছে। বিএনপি সব সময় যুক্তি দেখিয়েছে, তাদের ত্যাগী এবং পরিক্ষিত নেতাকর্মী বেশি। তাই কমিটির পরিসর বাড়াতে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শতশত নেতার কমিটির গুটিকয়েক নেতা ছাড়া আর কাউকে আন্দোলন বা রাজপথে পাওয়া যায় না। তাই এবারের এই বিশাল কমিটি কতটা রাজনৈতিক সুবিধা দেবে-সে প্রশ্ন জোরেশোরেই উঠেছে। এত বড় কমিটি একটি পূর্ণাঙ্গ মিটিং করতে পারবে কি-না তা নিয়েও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাহলে এমন একটি কমিটি কেন করা হলো?  

নীতি-আদর্শের দিক থেকেও যে বিএনপি একটুও বদলায় নি তার প্রমাণ এই কমিটি। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ পেয়েছেন পেয়েছেন দুই যুদ্ধাপরাধীর ছেলে। তারা হচ্ছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে আজীবন সাজাপ্রাপ্ত আবদুল আলীমের ছেলে ফয়সাল আলীম। সালাউদ্দিন কাদেরের ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ পেয়েছেন।  শুধু তাই নয়, অভিযুক্ত, দণ্ডপ্রাপ্ত, ফেরারি আসামি-সবাইকেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে স্থান দেয়া হয়েছে।

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর ‘প্রিন্স’গ্রন্থে বলেছিলেন, রাজাকে মিথ্যা বলতেই হবে, তাঁকে অভিনয় করে হলেও দেখাতে হবে যে তিনি প্রজাবৎসল। প্রজাদের শোকে তিনি মুহ্যমান, এই ধারণা রাজাকে জনপ্রিয় করবে। দুই বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও ‘আমের চেয়ে আঁটি বড়’ মার্কা একটা কমিটি উপহার দিয়ে বলবেন, মানুষের কল্যাণের জন্য, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ জন্যই এই কমিটি গঠন করা হয়েছে!

সালাম জানাই মহামতি ম্যাকিয়াভেলিকে! আমাদের রাজনীতিতে আপনি এখনও কত প্রাসঙ্গিক!

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ