আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

বাংলামেইল ও মধ্যরাতের অশ্বারোহী

মাসকাওয়াথ আহসান  

টুডে নিউজ৭১ ডট কম নামের একটি অনলাইন পত্রিকা প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়-কে নিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর মিথ্যা খবর প্রকাশ করে। এরকম কিছু ওয়েব পোর্টাল রয়েছে যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্যাং-এর প্ররোচনায় "গুজব" প্রচার করে। বলাই বাহুল্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের গ্যাং-গুলো নিজেদের অশ্লীল উদ্দেশ্য সাধনে ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এরকম নৈতিকতা বর্জিত পোর্টালগুলো চালায়।

টুডে নিউজ৭১ ডট কম সেরকমই একটি নৈতিকতা বর্জিত ওয়েব পোর্টাল; তথ্য উপদেষ্টা জয় সম্পর্কে তাদের প্রকাশিত খবরে তা সুস্পষ্ট। পাঠক মনোজগতে সেনসেশনাল বা অতিউদ্দীপক খবরের প্রতি তীব্র টান থাকায় এই গুজব প্রকাশকারী টুডে নিউজ৭১ ডট কমের "জয় সংক্রান্ত" মিথ্যা খবরটির লিংকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার হতে থাকে। আগে পাড়া-মহল্লার কোণা-কঞ্চিতে বিনোদন খুঁজতে লোকজন যেমন গুজব নিয়ে উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করতো; যুগ বদলে যাওয়ায় ভার্চুয়াল পাড়া-মহল্লার কোণা কাঞ্চিতে লোকজন তেমনি আলোচনা করতে শুরু করে "জয় সংক্রান্ত" গুজবটি।

এসময় বাংলামেইল টোয়েন্টিফোর ডটকম সেই টুডে নিউজ৭১ ডট কম-এর খবরটি গুজব কীনা তা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে শিরোনামে "গুজব" শব্দটি বিস্ময় চিহ্নসহ ব্যবহার করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর তাদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং-এর একজন কর্মকর্তা ফোন করে প্রতিবেদনটি উঠিয়ে নিতে নির্দেশ দেয়। ওয়েবপোর্টালটি নির্দেশ অমান্য করায় রাতে এলিট ফোর্স র‍্যাবের লোকেরা বাংলামেইল টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর দপ্তরে এসে তিনজন সাংবাদিককে তুলে নিয়ে যায়।

পৃথিবীর যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তথ্য মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় থাকে যাদের দায়িত্ব গণমাধ্যমের নৈতিকতা পর্যবেক্ষণ এবং নৈতিকতার স্খলন দেখলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশে তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলো এ দায়িত্বপালন করে। কেবল পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে বে-আইনি ফোন আসে মিডিয়া হাউজে; হুকুম তামিল না করলে রাতে এলিট ফোর্সের লোকেরা এসে সাংবাদিকদের তুলে নিয়ে যায়। ভারত-শ্রীলংকা-নেপাল-ভুটানে সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন আচরণের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রেস উইং বা এলিট ফোর্সের নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং এবং এলিট ফোর্সের এই পাকি-আচরণ মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ ও অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং ও এলিট ফোর্স যদি পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অনুশীলিত রীতি অনুসরণ না করে পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক বর্বর প্রথাকে বেছে নেয়; বুঝতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মাঝে "পাকিস্তান দূষণে"-র একটি মনোজগৎ শেকড় গেড়েছে। এই সুনির্দিষ্ট ঘটনার "পাকি-মানস" আদিম মানুষগুলো কারা তাদের চিনে রাখা ও নির্মূল করা বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক শুদ্ধতার জন্য অত্যাবশ্যক।

বাংলামেইল টোয়েন্টিফোর ডটকমের গ্রেফতার হওয়া সাংবাদিকদের একজন মাকসুদুল হায়দার চৌধুরী। যিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভাই আলী হায়দার চৌধুরীর বড় ছেলে। যিনি দীর্ঘদিন আজকের কাগজ ও বাংলাদেশ অবজারভারে কাজ করেছিলেন। এটা দেঁজাভুর মত দেখালেও সত্যি যে ১৯৭১ সালের এক কালরাতে ঠিক এমনি করে সাংবাদিক মাকসুদুল হায়দারের চাচা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো একাত্তরের ঘাতক রাজাকারেরা।

অনলাইন একটি নতুন মাধ্যম। এই মাধ্যমটি একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। গোটা পৃথিবীতেই কিছু বিশ্বাসযোগ্য অনলাইন মাধ্যম গড়ে উঠছে, কিছু দলীয় কিন্তু মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য অনলাইন মাধ্যম কাজ করছে। আর রয়েছে "গুজব" ছড়ানো মাধ্যম যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কাদা ছোড়াছুড়ি করে। অনলাইন মাধ্যমগুলো যেহেতু ভার্চুয়াল; ফলে ভূমি বাস্তবতার কোন নীতিমালা দিয়ে এদের আদৌ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মনে হয়না। তবে অসংখ্য অনলাইন মাধ্যম তৈরি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নৈর্ব্যক্তিক এবং সাংবাদিকতার নৈতিকতা মেনে চলা মাধ্যমগুলোই গ্রহণযোগ্য হয়।

অনলাইন মাধ্যমকে খুব সম্ভব পাঠকের গ্রহণ-বর্জনের স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এরপরেও নানাদেশে অনলাইন মাধ্যমের নীতিমালা প্রণয়ন এবং নিবন্ধনের মাধ্যমে ওয়েব পোর্টাল গুলোকে একটি জবাবদিহিতার মাঝে আনা হচ্ছে। বাংলাদেশেও সে প্রক্রিয়া চলছে। নৈর্ব্যক্তিকভাবে শুধু সাংবাদিকতার মানের ওপর ভিত্তি করে নিবন্ধন দেয়া গেলে খুবই ভালো। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ; এখানে একদিকে রয়েছে গাছের নারকেল থেকে পেয়ারা সবকিছুই দলীয় ভিত্তিতে পছন্দ-অপছন্দের প্রবণতা; অন্যদিকে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং-এর ঐ পাকি-মানসের দমন ও পেশী প্রদর্শনমূলক বর্বর কিছু প্রবণতা; ফলে ওয়েবপোর্টালের নিবন্ধন দেবার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির ও দলীয় লেজুড়বৃত্তির গ্যাং ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল চয়নের আশংকাটি বড় হয়ে উঠছে। এরকম ঘটলে তা বাংলাদেশ ইতিহাসের আরেকটি অন্ধকার অধ্যায় সূচিত হবে।

বাংলামেইল টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর একটি প্রতিবেদনকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং-এর কর্মকর্তার পেশী প্রদর্শনমূলক আচরণ বাংলাদেশের সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ঝুঁকিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। সভ্যতার ইতিহাস তৈরির আগে এমনকি অসভ্য যুগেও এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যারা যুদ্ধের বা সমঝোতার খবর পৌঁছে দিতো; সেই বার্তাবাহক বা প্রাচীন সাংবাদিকদের গ্রেফতার-নির্যাতন-হত্যা করা যাবে না এমন একটি প্রথা তৈরি হয়েছিলো।

আজ একবিংশ শতকে বাংলাদেশে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে আইনি পথে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা না করে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং-এর কর্মকর্তা আইনকে নিজের হাতে তুলে নিলো এবং হাতে ফেঁপে ওঠা "নতুন পেশীগুলো" দেখাতে র‍্যাবকে দিয়ে তিনজন সাংবাদিককে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো মধ্যরাতে।

মধ্যরাতের এই অশ্বারোহীদের হাতে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা আর নিরাপদ নয়; এতো খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ