প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ফরিদ আহমেদ | ১৪ আগস্ট, ২০১৬
নিউজউইক তাকে ভালবেসে আখ্যায়িত করেছিল রাজনীতির কবি হিসেবে।
কবি ছিলেন তিনি। ছিলেন গণ-মানুষের কবি, ছিলেন রাজনীতির অমর কবি। স্বপ্নহীন মানুষের স্বপ্নসারথি ছিলেন তিনি। হাটে, মাঠে, ঘাটে স্বপ্ন বিলিয়ে বেড়াতেন মানুষকে। কবিতার ঝুলি নিয়ে জনসমুদ্রে পাল তোলা নৌকো নিয়ে ছুটে যেতেন বন্দরে বন্দরে ।
দীর্ঘদিন ধরে বিদেশীদের হাতে নির্যাতিত, পথের দিশা হারানো, স্বপ্নহীন একটি জনগোষ্ঠীকে তিনি গভীর ভালবাসায়, বুকের সমস্ত মমতাটুকু ঢেলে তার ভরাট উদাত্ত কণ্ঠে রাজনৈতিক কবিতা পড়ে শোনাতেন। কখনো এই কবিতা পড়ে শোনাতেন কোনো জনাকীর্ণ রাস্তার মোড়ে, কখনো বা খোলা ময়দানে, কখনো বা তার ঘরের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
জরাজীর্ণ, স্বপ্নহীন মানুষকে তিনি শোনাতেন সুন্দর কোন আগামীর আবাহনী গান। শোনাতেন স্বপ্নময় এক অনাগত দিনের গল্প। দৃপ্ত অহংকারে বলে যেতেন অতীতের সোনাঝরা দিনের কথা, পূর্বপুরুষের হারানো গৌরবগাঁথার কথা, কিংবদন্তীর কথা। বলে যেতেন ভুলে যাওয়া প্রাচীন ইতিহাসের কথা, নরম কোমল ভালবাসাময় পলি মাটির গল্প। বলতেন সেই নরম মাটিতে পোড় খাওয়া কঠিন মানুষ এবং তাদের সংগ্রামের কথা।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত মায়াবী বাঁশি বাজিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছিলেন মানুষকে তিনি। তাঁর কবিতা শোনার জন্য উন্মাতাল মানুষ পাগলের মত ছুটে যেতো মাঠে, ঘাটে এবং প্রান্তরে। যাবেই বা না কেন? কবি যে তাদেরই মনের কথা বলেন, তাদের বুকের গভীরের স্বপ্ন নিয়েই যে তিনি কবিতা লেখেন।
কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই কবি হয়েছিলেন তিনি। হয়েছিলেন রাজনীতির কবি, গণ-মানুষের কবি। কবি হবার পিছনে তার একমাত্র রসদই ছিল বিশাল একটা হৃদয়। আর সেই হৃদয়ে সমুদ্রসম ভালবাসা ধরে রাখতেন তিনি মানুষের জন্য। তার শক্তি এবং দুর্বলতা দুটোই ছিল তার সুগভীর ভালবাসাজাত। তার প্রবল শক্তি হিসাবে তিনি তার দেশের মানুষকে ভালবাসার কথা বলতেন। সবচেয়ে বড় দুর্বলতার কথা বললেও তার বিশাল হৃদয়ে সেই মানুষদের জন্য অতিরিক্ত ভালবাসার কথাই শোনাতেন তিনি।
ওই বিশাল হৃদয়কে ধারণ করার জন্য বিশাল এক প্রশস্ত বক্ষ নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। পরম মমতায় কোটি কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি সেই সুপ্রশস্ত বুকে। শত্রু-মিত্র যাচাই বাছাই না করেই সবাইকে তিনি টেনে নিতেন তার সুবিশাল বুকের মাঝখানে। তাঁর এই বাছ বিচারহীন উদারতার জন্য বিপুল মাশুলও দিতে হয়েছে তাকে একসময়।
ছিলেন হিমালয়সম এক সুদর্শন দীর্ঘ পুরুষ। দৃপ্ত অহংকারে, অসীম সাহসে, তেজোদ্দীপ্ত নৃসিংহের মত কেশর দুলিয়ে বুক চিতিয়ে হাঁটতেন তিনি। তাঁর আত্ম-প্রত্যয়ী পদচারণায় কেঁপে উঠতো চারপাশের সবকিছু, কেঁপে উঠতো শোষকের বুক, কেঁপে উঠতো ভীরু কাপুরুষ পাকিস্তানি শাসকদের তাসের ঘর। হ্যাঁ এই সাহসী,বরেণ্য কবি আর কেউ নন। তিনি শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যার নামের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে একটি দেশের রক্তাক্ত অভ্যুদয়, শতাব্দীর কান্নাকে পিছনে ফেলে একটি জাতির নবজন্মের ইতিহাস, একটি জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের হারিয়ে যাওয়া পরিচয় উদ্ধারের কাহিনী।
ফিডেল কাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। তাতেই আমার হিমালয় দর্শন হয়ে গিয়েছে’। এই ব্যক্তি তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব এবং আকাশছোঁয়া অসম সাহস মিলিয়ে ছিলেন হিমালয়ের মতই। বৃটিশ মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী বা ডি ভ্যালেরার চেয়ে বড় নেতা বলে মনে করতেন শেখ মুজিবকে।
আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে অসংখ্য কবি অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন। কিন্তু শ্রেষ্ঠ কবিতাটি রচনা করে গেছেন তিনিই। শুধু রচনাই নয়, বজ্র নিনাদে ফেটে পড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে মেঘমন্দ্র ভরাট কণ্ঠে পড়েও শুনিয়েছেন সেটা।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের এক নরম বিকেল। ঢাকা শহরে এক মাঠে জড়ো হয়েছিল লক্ষ কোটি মানুষ। আজ যে রাজনীতির শ্রেষ্ঠ কবি তার শ্রেষ্ঠ কবিতাখানি শোনাবেন। অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে ব্যাকুল প্রতীক্ষায় থেকেছে তারা। কখন আসবে কবি?
একটিমাত্র কবিতার জন্য হাজারো মানুষের এই উন্মাতাল প্রতীক্ষা এই ধরণী যে আর কখনো দেখেনি আগে। এই একটি মাত্র কবিতা যে পালটে দেবে পৃথিবীর ইতিহাস, পালটে দেবে ভূ-মানচিত্র, পালটে দেবে কোটি কোটি মানুষের জীবন। মূর্ত করে দেবে অগণিত মানুষের লক্ষ কোটি বিমূর্ত সব স্বপ্নকে।
কবিও নিরাশ করেননি তার অগণিত ভক্তদের। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে দৃপ্ত পায়ে মাটি কাঁপিয়ে মঞ্চে উঠেন তিনি। বিপুল বিক্রমে চারিদিক প্রকম্পিত করে স্বাধীনতা নামের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কবিতাখানি আবৃত্তি করেন তিনি। একটি জনগোষ্ঠীর সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-বেদনা মুহূর্তেই মিশে হয়ে যায় সেই অমর কবিতার সাথে।
নিপুণভাবে বাছাই করা অনিন্দ্য সুন্দর শব্দমালা দিয়ে তিনি বলে যেতে থাকেন একটি জাতির অতীত, বর্তমান এবং অনাগত ভবিষ্যতের কথা। তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা, নির্যাতিত হবার কথা, বঞ্চনার কথা, ক্ষোভের কথা, দ্রোহের কথা, আত্মত্যাগের কথা, প্রতিবাদের কথা, বীরত্বগাঁথার কথা, প্রতিরোধের কথা, শৌর্য-বীর্যের কথা। প্রতিটি শব্দ যেন বৈশাখী মেঘের বুকে পুঞ্জিভূত ক্ষোভাতুর বিজলির মত ঝলকে ঝলকে বেরিয়ে আসতে থাকে বুকের গভীর থেকে। একটিও অসংলগ্ন কথা বলেন না কবি। একবারও কোনো পুনরাবৃত্তি হয় না সেখানে। একবারও কথা জড়িয়ে যায় না। অসংখ্যবার মহড়া দেয়া নাটকের মত একটিবারও ছন্দপতন ঘটে না কোথাও। এমনই মসৃণ, মেদবিহীন, ধারালো, সুতীক্ষ্ণ এবং সুমধুর সেই কবিতা পাঠ।
কবি নির্মলেন্দু গুণ কবির সেই অমর কবিতা পাঠকে বর্ণনা করেছেন এভাবে।
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
…. …. ….
গণসূর্যের মঞ্চ কাপিয়ে কবি
শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি —
“এবারের সংগ্রাম
আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
হ্যাঁ, সেই থেকে স্বাধীনতা নামের স্বপ্নে রাঙানো শব্দটি আমাদের। শুধুই আমাদের। আমাদের অসম্ভব প্রিয় এক শব্দ। আর এই প্রিয় শব্দটিকে আঁধারের কারাগার থেকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে আমাদের একান্ত নিজেদের করে দিয়েছেন তিনি। এর জন্য, আমাদের বুকের সবটুকু ভালবাসা রাজনীতির এই শ্রেষ্ঠ কবির জন্য।
২.
আমরা ভালবাসলেও সবাই এই কবিকে ভালবাসে নি। একটা ক্ষুদ্র অংশ, যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল, তারা উনিশশো একাত্তর সালের পরাজয়কে ভুলতে পারে নি কিছুতেই। এই এক পরাজয়ের মধ্য দিয়েই যে তারা হারিয়েছে তাদের সকল অস্তিত্ব। সেই হারানো অস্তিত্বকে ফিরিয়ে আনতে অন্ধকারে লুকিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তারা। তাকে মুখোমুখি ফেস করার শক্তি কিংবা সাহস কোনোটাই তাদের ছিল না। তিনি ছিলেন শার্দূল, এরা ছিল হায়েনার মতো। আঁধার রাতে দলবেঁধে সভা করে হায়েনার দল। পরিকল্পনা করে কীভাবে পতন ঘটানো যায় শার্দূলের। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে পনেরোই অগাস্ট রাতে ট্যাংক নেমে আসে সেনানিবাস থেকে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ির সামনে। অতর্কিতে অপ্রস্তুত অবস্থায় হামলা চালানো হয় কবির উপরে। তাঁর বিশাল বুক ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয় মেশিনগানের গুলিতে। লুঙ্গি এবং গেঞ্জির সাধারণ পোশাক পরা অসাধারণ মানুষটি লুটিয়ে পড়েন সিঁড়িতে। তিনি নন, যেন রক্তাক্ত পতন ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।
শুধু তাঁকে একা নয়, তাঁর বংশের সবাইকে হত্যা করা হয় নিষ্ঠুরের মত। তাঁর স্ত্রী, ছেলেরা, ছেলের বউয়েরা, কেউ রেহাই পায় নি। তাঁর সাত বছরের শিশু সন্তান লুকিয়ে ছিল সিঁড়ির নীচে। ঘাতকেরা তাঁকেও খুঁজে নিয়ে এসে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। গর্ভবতী নারীও রেহাই পায় নি এদের মৃত্যুক্ষুধা থেকে। কবির সমস্ত বংশ নিশ্চিহ্ন করার একটাই মাত্র উদ্দেশ্য ছিল। আর কেউ যেন তার মতো কবি না হয়ে ওঠে। এই বঙ্গভূমে কবি হওয়াটা কাঙ্ক্ষিত নয়, নয় গৌরবের, নয় আনন্দের।এ যেন অসহায়ভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেবার অলিখিত এক নিয়মমাত্র। রাত্রির বুকে রক্তাক্ত রক্তকরবীর ঢলে পড়ার বিষাদীয় গল্প।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য