আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

শেখ মুজিবের ফিরে আসা এবং শেষের দিনের শুরু

হাসান মোরশেদ  

“The return of Mujib-the middle-of-the roader- who is regarded as Bangladesh’s legitimate leader by the vast majority of the people as well as most political and guerilla factions-would give a strong boost to the new governments’ effort to solidify its control over the country.
Mujib’s presence would also overshadow the current competition for power among the political factions”

৩ জানুয়ারি ১৯৭২, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ যখন এই রিপোর্ট পাঠায় তার আঠারো দিন আগে মানব ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈনিক যুদ্ধবন্দী- বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনীর হাতে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস বাইশ দিন শেখ মুজিব বন্দী পাকিস্তানের কারাগারে, ২৫ মার্চের রাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। তার নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মধ্যপন্থী দল হিসেবে আওয়ামী লিগে মতাদর্শিক নানা গ্রুপ বিদ্যমান ছিলো, স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার মতো একটা অভূতপূর্ব বিষয়ে ও এইসব গ্রুপের নানা  কোন্দল ছিলো। আওয়ামী লিগ ছাড়া ন্যাপ এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের সহযোগী ছিলো। চীনপন্থি কমিউনিস্টদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়- কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় থাকে, অনেকে বিরোধিতা করে যেমন জামায়াতে ইসলাম ও মুসলিম লীগ সহ ইসলামী সবদলগুলোই বিরোধিতা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার অংশীদার হয়ে যায়।

নিজে যুদ্ধের মাঠে অনুপস্থিত থাকলে ও সংকটকালীন সেই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দল ও উপদলের কাছে ঐক্যের প্রতীক ছিলেন তিনি। নানা মতাদর্শিক দ্বন্দের  পরও তার নামেই জয়ধ্বনি উঠে যুদ্ধের মাঠে। ছাত্র কৃষক সৈনিক রাজনৈতিক কর্মী যারাই সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন তাদের কাছে পাকিস্তানে কারাগারে বন্দী মুজিব ছিলেন স্বাধীনতার অপর নাম। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিতে দিতে তারা তাড়া করতেন পাকিস্তানী ঘাতকদের, যুদ্ধের মাঠে শহীদ হবার সময় ও তার নাম উচ্চারিত হতো।



বাঙ্গালীর স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার আন্দোলনে নিয়ে গিয়ে একটা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করা- ঠিক অতোটুকুতেই মুজিবের অবদান শেষ নয় বরং সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য তার প্রয়োজন আরো কেনো জরুরী সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে সিআইএ’ এই গোপন প্রতিবেদনে।  

কিন্তু শেখ মুজিব তখনো বন্দী পাকিস্তানের কারাগারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেদিন আত্মসমর্পণ করে তার আগের দিন ১৫  ডিসেম্বর ১৯৭১ তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার কথা ছিলো। এর আগে ৪ ডিসেম্বর বিচারের রায় ঘোষিত হয় এবং লায়ালপুর কারাগার থেকে স্থানান্তর করা হয় মিয়ানওয়াল কারাগারে। সৌভাগ্যবশত: আত্মসমর্পণের সংশয় ও এ সংক্রান্ত নানা দ্বিধা দ্বন্দের ফলে সে রাতে ফাঁসী কার্যকর হয়নি। মিয়ানোয়াল কারাগারের জেলার শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজে বাড়িতে দুদিন লুকিয়ে রাখেন।

১৬ ডিসেম্বরের পর পরই পাকিস্তানে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। পরাজিত ইয়াহিয়া খানকে হটিয়ে চতুর রাজনীতিবিদ ভুট্টো -   তার বহুল কাঙ্ক্ষিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদ দখল করে।অনেক বিশ্লেষক মনে করেন- পূর্ব পাকিস্তান থাকা অবস্থায় কোনদিনই ভোটে জিতে পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব না- এটা ভেবেই ভুট্টো গণহত্যার পরিকল্পনা করেছিলো সামরিক শাসকদের সহযোগিতায়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা করলে ও ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তী পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদেশগুলো বাস্তবতা মেনে নিয়ে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য ভুট্টোকে চাপ দিতে থাকে। ভুট্টো ও উপলব্ধি করে- ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে যুদ্ধবন্দী ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈনিককে ফিরিয়ে আনা ছাড়া কোন উপায় নেই আর শেখ মুজিবকে শাস্তি দিলে এটা কোনদিনই সম্ভব না।
 

২২ ডিসেম্বর ভুট্টো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে আশ্বস্ত করে যে মুজিবকে দ্রুতই মুক্তি দেয়া হবে। ২৩ ডিসেম্বর ভুট্টো প্রথম দেখা করে শেখ মুজিবের সাথে এবং তার জন্য পত্রিকা, রেডিও ও টিভি দেখার ব্যবস্থা করে। চতুর ভুট্টো এসময় তার কাছ থেকে সুসম্পর্কের নিশ্চয়তা আদায় করার চেষ্টা করে। ২৭ ডিসেম্বর সে আবারো দেখা করে তার সাথে এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে শিথিল প্রকারের হলেও কনফেডারেশন বজায় রাখার অনুরোধ করে। মুলতঃ ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈনিকের মুক্তির জন্যই ছিলো তার এই চেষ্টা। এ ছাড়া বাংলাদেশে গণহত্যার  চালানোর কারণে বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানের যে খারাপ ইমেজ তৈরি হয়েছিলো, শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার কিছুটা প্রশমিত করা ও তার উদ্দেশ্যে ছিলো। কিন্তু শেখ মুজিব  বাংলাদেশের জনগণের সাথে আলোচনা না করে কোন কথা দিতে অস্বীকার করেন।  বস্তুত: সেই সময় পর্যন্ত পাকিস্তানী গণহত্যা সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য তার কাছে ছিলোনা বরং ভুট্টো তাকে জানিয়েছিলো ভারতীয় ও সোভিয়েত বাহিনী ঢাকা দখল করে মানুষ হত্যা করছে।

৭ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে ভুট্টো আবারো শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে এবং পরের দিন তার পাকিস্তান ত্যাগের ইংগিত দেয়।


কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে ৮ জানুয়ারি ভোর তিনটায় তাকে এবং ডঃ কামাল হোসেনকে তুলে দেয়া হয় পাকিস্তানের চার্টার্ড বিমানে, পত্রপত্রিকাকে জানানো হয় আরো দশ ঘণ্টা পর। ইতিমধ্যে পাকিস্তানী বিমান গিয়ে পৌছায় যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায়। সাড়ে দশ মাসের দীর্ঘ কারাবাস, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা শেখ মুজিব ক্লান্ত থাকলেও সবসময়ের মতোই  ঋজু ছিলেন। প্রিয় পাইপে টান দিতে দিতে জমায়েত হওয়া সাংবাদিকদের বলছিলেন “ As you can see, I am very much alive and well”

পাকিস্তান আগে যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে অবগত করেনি। বিমান অবতরণের মাত্র এক ঘণ্টা আগে তারা জানতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তখন ছুটি কাটাতে লন্ডনের বাইরে। বিদেশ মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের প্রধান সাদারল্যান্ড দ্রুততম সময়ে এসে পৌঁছান- শীতের ভোরবেলায়। লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান রেজাউল করিম এসে উপস্থিত হন। ব্রিটিশ সরকারের তত্বাবধানে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয় বিখ্যাত ক্ল্যারিজেস হোটেলে।

হোটেলে পৌঁছার পর ফোনে কথা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও বেগম মুজিব এর সাথে। এরপর কথা হয়  ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। সকাল দশটার দিকে ফোন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ, হীথ তখন অবকাশ যাপন করছিলেন চেকার্স পল্লীতে।


একে একে সাক্ষাৎ করতে আসেন লেবার পার্টির নেতা হেরলল্ড উইলসন, এমপি পিটার শোর, বিবিসির বিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট, ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থ। ততোক্ষণে গোটা লন্ডনে ছড়িয়ে পড়েছে বাঙ্গালীর মুক্তিসংগ্রামের প্রধান পুরুষের আগমন বার্তা। হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী, ভারতীয় এবং নানা দেশের মানুষ ভিড় জমিয়েছে তাকে দেখার জন্য, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে মুখরিত হোটেল এলাকা।  


জমায়েত হয়েছেন পৃথিবীর সকল বিখ্যাত মিডিয়ার সাংবাদিকেরা তার কথা শুনার জন্য। কিছুক্ষণ পর শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেন। একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের মতোই  প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে পৃথিবীর আর সকল দেশের  কাছে দাবি জানান  বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের এবং জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিকরনের। শেখ মুজিব যথার্থই বুঝেছিলেন অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে আইনগতভাবে টিকিয়ে রাখতে অপরাপর দেশ এবং জাতিসংঘের স্বীকৃতি প্রয়োজন এবং যতো দ্রুত সম্ভব। তাই ঢাকায় অবস্থানরত অন্য সহকর্মীদের সাথে দেখা হওয়ার আগেই স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি এই আবেদন জানিয়েছিলেন।


এরপর সাংবাদিকরা নানা বিষয়ে তার কাছে জানতে চান। তার বন্দিত্বকালীন সময় সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন ‘And, a man who is ready to die, no body can kill’ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক বিষয়ে ভুট্টোর কাছে কোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন ‘I told him I could only answer that after I returned to my people”

আরেকজন সাংবাদিক জানতে চান পাকিস্তান থেকে সরাসরি বাংলাদেশ বা কাছাকাছি অন্য কোথাও না গিয়ে কেনো লন্ডনে? মুজিব উত্তরে বলেন ‘ Don’t you know I was a Prisoner? It was the Pakistan government’s will, not mine”

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার অবকাশ বাতিল করে ছুটে আসেন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট এবং শেখ মুজিবকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এখানে। আরো উপস্থিত ছিলেন কমনওয়েলথ এর সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ। স্মিথ এখানেই শেখ মুজিবকে কমনওয়েলথের সম্ভাব্য সদস্য রাষ্ট্রের নেতা হিসেবে সম্বোধন করেন।

পরে জানুয়ারি’র ১৩ তারিখে এডওয়ার্ড হিথ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে এক তারবার্তায় মুজিবের ইংল্যান্ড ভ্রমণ বিষয়ে বিস্তারিত অবগত করেন। হিথ জানান ‘ he had suggested that he should be sent to Dacca or handed over to the Red Cross or the United Nations. HJis ideas were not,however acceptable to Bhutto. Mujib, who himself had refused to go to Tehran, finally agreed to come to London. ..He was anxious to reach Dacca as soon as possible, and we gave him an RAF for the onward journey. It was his own choice that he should not transfer to an Indian aircraft in Delhi”  

হিথ এ সময় শেখ মুজিবের কাছে জানতে চান পাকিস্তানের সাথে শিথিলতম কনফেডারেশনের বিষয়ে ভুট্টোর প্রস্তাবনায় তার মতামত কী? মুজিব স্পষ্টভাবে বলেন ‘এই সময় পেরিয়ে গেছে। পাকিস্তানের সাথে কোন ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ অসম্ভব, এরকম কিছু করার চেষ্টা হলে আরেকবার গেরিলা যুদ্ধ হবে”

তার এই শক্ত মতামত প্রসঙ্গে হিথ, নিক্সনকে অবগত করে লিখেন


“In this he has confirmed the position of the Bangladesh authorities in Dacca and our own assessment of the state of affairs in the East. However, although he spoke with understandable bitterness of the actions of the previous Pakistan regime, he showed no rancor towards Bhutto and said that he wished establish good relations with West Pakistan...The new partition should be, in his words ‘a parting as of brothers’, but Bhutto must acknowledge Pakistan’s division.”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে উদ্ধৃত করে নিক্সনকে আরো জানান
“Bangladesh and India would, of course, be much closer”

লন্ডনে সেদিন সকলেরই ধারনা ছিলো শেখ মুজিব সরাসরি ঢাকা চলে আসবেন যেখানে তাঁর অপেক্ষায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ এবং এর সাতকোটি মানুষ, অপেক্ষায় তার পরিবার এবং সহকর্মীগন। কিন্তু সকলকে অবাক মুজিব সিদ্ধান্ত জানালেন তিনি  প্রথমে দিল্লী যাবেন, তারপর ঢাকা।

তার এই ইচ্ছে জানার সাথে সাথে ইন্দিরা গান্ধির নির্দেশে ভারতীয় হাইকমিশনার জানান এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ বিমান প্রস্তুত তাকে লন্ডন থেকে দিল্লী এবং দিল্লী থেকে ঢাকায় নিয়ে যেতে। কিন্তু সবাইকে আবারো চমক দিয়ে শেখ মুজিব এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং ব্রিটিশ বিমান বহরের একটি বিমান বেছে নিলেন।

মিসেস গান্ধী এবং ভারতীয় কূটনীতিকরা স্বভাবতই মনঃক্ষুণ্ণ হলেন কিন্তু নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির এই কূটনৈতিক চাল মেনে নেয়া ছাড়া তাদের কিছু করার ছিলোনা। এই প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে মুজিব ইংগিত দিলেন যে তিনি ভারতের উপর নির্ভরশীল নন এবং তিনি স্বাধীন থাকবেন। নিজের ইচ্ছেয় ব্রিটিশ বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকা যাবার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি আরো জানিয়ে দিলেন সবাইকে- নিজের পছন্দমতো যে কোন দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে তিনি আগ্রহী এবং এটা শুরু হলো ব্রিটেনকে দিয়ে- উপমহাদেশের সকল দেশ একসময় যার কলোনি ছিলো এবং এখনো যার প্রভাব রয়েছে এই অঞ্চলে।

লন্ডন-দিল্লী পথে যাত্রাবিরতি হয় সাইপ্রাসে। রাষ্ট্রপতি ম্যাকারিয়াস এখানে সংবর্ধনা জানান শেখ মুজিবকে।স্থানীয় সময় সকাল ৭ টা ৩০মিনিটে দিল্লীর পালাম এয়ারপোর্টে তাকে বহনকারী ব্রিটিশ বিমান এসে নামে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার পুরো কেবিনেট সহ উপস্থিত হয়ে শেখ মুজিবকে বরন করেন এবং পালাম থেকে তারা যান দিল্লী ক্যান্টনমেন্ট এর প্যারেড গ্রাউন্ডে। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সশস্ত্র অভিবাদন জানানো হয়।শীতকালের সকালবেলা লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত তখন তার কথা শুনার জন্য। ইন্দিরা গান্ধী  সংক্ষিপ্ত ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বিশেষ করে শেখ মুজিবের মুক্তিতেতার আনন্দ ও সন্তোষ প্রকাশ করেন।

এর পর শেখ মুজিব তার চিরাচরিত আবেগময় বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতীয় জনগণের প্রতি তার ব্যক্তিগত পক্ষ এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, মুজিব আরো আশা প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ত্যাগ ও আত্মদানের মাধ্যমে গড়ে উঠা বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে।

আনুষ্ঠানিকতার পর্ব শেষে মুজিব, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ব্যক্তিগত বৈঠকে প্রথমেই জানতে চান- ভারতীয় সৈন্য কবে বাংলাদেশ থেকে ফিরবে? এতো দ্রুত এরকম একটা বিষয় উত্থাপন করবেন মুজিব, সেটা হয়তো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ধারনায় ছিলোনা। কিন্তু প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক ইন্দিরা তাঁর বিস্ময় লুকিয়ে মুজিবকে জানান- তার ইচ্ছেমতো যে কোনদিন ভারতীয় সৈন্য ফিরে আসতে প্রস্তুত, সম্ভাব্য দিন হতে পারে মুজিবের পরবর্তী জন্মদিন ১৭ মার্চের আগে।

ঠিক এই নিশ্চয়তা পাবার জন্যই মুজিব লন্ডন থেকে ঢাকা যাবার আগে দিল্লী এসেছিলেন- মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতীয় সৈন্য দখলদার বাহিনী হয়ে যাচ্ছেনা- এই জরুরী বার্তা নিয়েই তিনি যেতে চেয়েছিলেন তার স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙ্গালী জাতির কাছে।

১০ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটায় শেখ মুজিব পদার্পণ করেন স্বাধীন বাংলাদেশের তেজগাঁ বিমানবন্দরে।তার সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সহ অনেকে।তাকে বরন করে নেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মুজিবনগর সরকারের অন্য সব মন্ত্রীরা বিমান বন্দর থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেখানে আগের বছর ৭ মার্চ তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন আসন্ন যুদ্ধের। যুদ্ধ ও গণহত্যায় বিধ্বস্ত কিন্তু স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বেলিত প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ তখন জমায়েত তাদের প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য, তার কথা শুনার জন্য। এই আবেগ, এই সম্মোহন অতুলনীয়।সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি কয়েক মুহূর্ত বাকরুদ্ধ থাকলেন। কাঁদলেন, কাঁদালেন।

তারপর সেই সম্মোহনী ভরাট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন
“আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার সোনার বাংলা আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলার কৃষক,শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার উদ্দেশ্যে জানাই সালাম। ইয়াহিয়া খানের কারাগারে মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে মুক্তি হবে, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলো না। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন দেশের মুক্তি সংগ্রামে এত লোকের প্রাণহানির নজির নাই। আমার মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করে তারা জগণ্য বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে।সোনার বাংলার অসংখ্য গ্রাম তারা পুড়িয়ে দিয়েছে”

তিনি তার বক্তৃতায় দেশ গড়ার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি জানতেন এবার শুরু করতে হবে নতুন আরেক সংগ্রাম। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে তার বহুল্ প্রতিশ্রুত সোনার বাংলায় পরিণত করতে হবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামের চেয়ে দেশ গড়ার এই সংগ্রাম মোটে ও সহজ নয়।

দেশে ফেরার পর বিশ্রামের কোন অবসর ছিলোনা তার। পরের দিন ১১ জানুয়ারি অস্থায়ী সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে তিনি দীর্ঘ প্রতিশ্রুত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার ২৩ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামী লিগ মন্ত্রীসভা সহ শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতির নির্বাচিত হন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী।

এসময় দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন “ সোনার বাংলা গড়তে হবে। এটা বাংলার জনগণের কাছে আওয়ামীলীগের প্রতিজ্ঞা। আমরা আওয়ামীলীগের কর্মীরা, যখন বাংলার মানুষকে বলি, সোনার মানুষ হও তখন তোমাদেরই প্রথম সোনার মানুষ হতে হবে। তাহলেই সোনার বাংলা গড়তে পারবা। আর যারা বাংলার দুঃখী মানুষেরপাশে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করেছো, তারা বাংলার দুঃখী মানুষের কাছ থেকে সরে যেয়োনা”

যাদের উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব এই কথাগুলো বলেছিলেন তারা কতোটুকু তার কথা মেনেছিলেন সেটা আলোচনা সাপেক্ষ কিন্তু শেখ মুজিব নিজে তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার প্রতিশ্রুত সোনার বাংলা গঠনে সচেষ্ট ছিলেন, বাংলার দুঃখী মানুষদের পাশে তাদের একজন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।  
 

তথ্যসূত্র:

1.    The Bangladesh Military Coup and The CIA Link: BZ Khasru
2.    Liberation & Beyond Indo-Bangladesh Relations: J.N.DIXIT
3.    ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারক গ্রন্থ (২য় খণ্ড)- এম নজরুল ইসলাম সম্পাদিত
4.    বঙ্গবন্ধু: ভাষা ও মনোজগৎ: শেখ সাদী
 

হাসান মোরশেদ, লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ