প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ২০ আগস্ট, ২০১৬
আমরা যারা প্রবাসী, দেশ থেকে কেউ আসলেই প্রথম প্রশ্নটা থাকে দেশের অবস্থা কি? সাম্প্রতিককালে সবার প্রায় একই উত্তর। দেশ খুব ভাল চলছে। দেশে এখন সবাই আওয়ামী লীগ করে। যারা দেশ থেকে আসেন তাঁদের প্রায় সবাই এই কথাটি বলে থাকেন। যার প্রমাণ কিছুটা পেলাম এবার জাতীয় শোক দিবস পালনের নমুনার মধ্য দিয়ে।
এইবার জাতীয় শোক দিবস পালনের কিছু ছবি অনলাইনে এসেছে। যা দেখে বুঝার উপায় ছিল না দিনটা কি ছিল। শোক দিবস, না আনন্দের কোন দিন উদযাপন করছেন তারা। কম হলে ও ৫০টি ছবি দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি হলো কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শোক র্যালি। ১৫ আগস্টে জাতির জনকের কবরের সামনে মোনাজাতরত শেখ হাসিনার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে বেদনার অশ্রুজল। ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে, আমি নাম জানি না উনার, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা। কেউ কেউ কাঙালি ভোজের আয়োজন করেছিলেন, খাবারের বাক্সে বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়ব। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বঙ্গবন্ধুর ছবি। এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। লন্ডনে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও দেখলাম সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন। শোক সভায় ছাত্রলীগের মারামারি সহ নানা রকম সেলফি তো আছেই। এই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্য শোকের নমুনা। আরেক অনুষ্ঠানে জাতীয় শোক দিবসে সকল উপস্থিত থাকার জন্য অঙ্গ সংগঠনের সভাপতি সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন! সিলেট অঞ্চলের এক মহিলা এমপি নিজের নির্বাচনী এলাকায় নাকি ১৩ আগস্ট তারিখে সংবর্ধনাও নিয়েছেন। এই একই ভদ্রমহিলা মুখ ফসকে এর কয়দিন আগে বলেছেন আমরা আছি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, আমরা আছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে। প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রেসিডেন্ট সুবিদ আলী ভূঁইয়া বলে ফেলেন, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি।
বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচী ঘোষণার পর দলে দলে সবাই বাকশালের সদস্য হওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। যার প্রমাণ খোদ জিয়াউর রহমান বাকশালের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন।বাকশালের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নিজে কলম ধরেছিলেন। সেই চিত্রই যেন আবার ফিরে আসছে। বলছি না বঙ্গবন্ধুর জন্য আপনি কাঁদো কাঁদো হয়ে সারাদিন বসে থাকবেন। কিন্তু ন্যুনতম মার্জিত ব্যবহার তো আশা করা যায়। কোথাও মসজিদের ভিতরে নাকি ব্যানার টাঙিয়ে জাতীয় শোক দিবসের দোয়া মাহফিল করেছেন কেউ কেউ। আরেক ব্যানারে দেখলাম খোদ বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিবের ফাঁসি দাবি করে শোক দিবসের র্যালি করছে ছাত্রলীগ। এটা কোনভাবেই ভাল লক্ষণ নয়। এর প্রতিক্রিয়া খুবই ভয়াবহ।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, শোকের মাস, বেদনার মাস, বেদনায় শ্রদ্ধায় দেশে দেশে বাঙালিরা, সপরিবারে খুন হওয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের নিহত সকল সদস্যদের গভীর বেদনায় স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তাঁদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে বেদনার দিন। বাঙালি জাতির জীবনের কালো অধ্যায়।
রাত পোহালেই আরেক ভয়াল ২১ আগস্ট যেখান থেকে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর কম হলে ও উনিশ বার তাঁকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছিল। বারবার দলীয় নেতাকর্মীদের রক্তের বিনিময়ে বেঁচে গিয়েছেন তিনি। সেই সুযোগ জাতির জনক ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে পান নি। ঘাতকরা রাতের আধারে খুন করেছিল বঙ্গবন্ধুকে। তাঁর চারপাশে সেদিন খন্দকার মোস্তাক ও তার অনুসারীরা দেয়াল তুলে দিয়েছিল।
নব্য আওয়ামী লীগারদের ভিড়ে আজ খাঁটি আওয়ামী লীগ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। বড় ভাই জামায়াতে ইসলামির বড় নেতা তো ছোট ভাই হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের বড় নেতা না হলে ও যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগের পদবীধারী। অভিমানে, অপমানে প্রকৃত আওয়ামী সমর্থকরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। এই যে মানুষের ভিতর এক ধরণের বিরূপ মনোভাব গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে এর ভিতর কোন দুরভিসন্ধি আছে বলেই মনে হয়। যেভাবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এই পর্যন্ত সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ থেকে শুরু করে আওয়ামী সাংস্কৃতিক লীগ নাম সহ ৩৭৯টি লীগ নামধারী সংগঠনের তালিকা পাওয়া গেছে বলে অনলাইনে একটা তথ্য পেলাম। যারা মুজিব কোট পরে নিজেদের ছবির সাথে বঙ্গবন্ধুর ছবি জুড়ে দিয়ে ব্যানার পোস্টার বানিয়ে প্রচার প্রচারণা করছেন। তাদের কার্যক্রম বা উদ্দেশ্য সহজেই অনুমেয়।
গণহারে বানের জলের মতো আওয়ামী লীগার হচ্ছে মানুষ, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য যখন বলেন ‘জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি’ তখন মাঠ পর্যায়ের অবস্থা কি একবার ভাবুন। যার পরিবারের সবাই জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত সেই পরিবারের ছেলেটি যখন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়ে যায় সেই ছাত্রলীগের অবদান কি থাকবে একবার ভেবে দেখতে পারেন। কে কার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগ এর যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। সরকারী কর্মকর্তারাও বাদ পড়ছেন না এই প্রতিযোগিতা থেকে। গত বছর জাতীয় শোক দিবসে যে লোকটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনলাইনে উপহাস করেছে সেই ছেলে এবার তার ফেসবুক ভরে ফেলেছে বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে। করভি রাসকিন নামক জাগো ফাউন্ডেশনের যে ছেলেটি আরেকটি ১৫ আগস্টের স্বপ্ন দেখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, জঙ্গি হাসনাত, তাহমিদ এর মুক্তি দাবি করে সেই ছেলে যখন মন্ত্রীর সাথে সেলফি তুলে, মন্ত্রণালয় থেকে লাখ লাখ টাকা অনুদান পায়, আমরা সাধারণ মানুষ ভীত হই।
ভারত থেকে বানের পানিতে ভেসে আসা হাতির উপাধি বঙ্গ বাহাদুর! আমাদের মিডিয়া ও সেই শব্দটা খুবই প্রচার ও করল। বঙ্গবন্ধু কিংবা বঙ্গতাজ উপাধিগুলো আমরা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের দুই মহানায়কের উপাধিতে ব্যবহার করছি। সেখানে হাতির উপাধি বঙ্গ বাহাদুর!
৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও মন্ত্রী এমপি ছাড়া খুব শ্রদ্ধেয় প্রবীণ রাজনীতিবিদদের গায়ে মুজিব কোট দেখেছি। কোন ছাত্র নেতার গায়ে দেখেছি বলে মনে হয় না আমার। কিন্তু এখনকার রং বেরং এর হাফ মুজিব কোট কোনটা বা বিয়ের শেরওয়ানীর মতো ঝকমকে মুজিব কোট সবার গায়ে।
এবারের শোক দিবসের দিন লন্ডনে একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভাই আপনার গায়ে যে কাল কোট এইটার নাম কি? উনি খুব গম্ভীর ভাবে বললেন মুজিব কোট। বললাম আপনারটা তো মুজিব কোট না ভাই, আপনার এই কোটে তো বোতাম পাঁচটা । ভদ্রলোক একটু অবাক হয়েই বললেন তো কি হয়েছে? বললাম মুজিব কোটের বোতাম হবে ছয়টা এবং এই ছয় বোতামে ৬৬টির আন্দোলনের ছয় দফাকে রিপ্রেজেন্ট করে। ভদ্রলোক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে যারা সব কিছু ছেড়েছেড়ে জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠন করে সেদিন পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে খন্দকার মোস্তাক ও জিয়াউর রহমানের অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যারা নিহত হয়েছিলেন, নির্যাতিত নিপীড়িত হয়েছিলেন, ফাঁসি কাষ্ঠ থেকে ফিরে এসেছিলেন বিশ্বজিত নন্দী, সরকারী নথিপত্রে এখনো তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহী দুষ্কৃতিকারী হিসাবে চিহ্নিত আছেন। বিশ্বজিত নন্দী সহ সেই দিনের প্রান্তিক যোদ্ধাদের নাম ইতিহাসের পাতায় দুষ্কৃতিকারী হিসাবেই রয়ে গেছে। ৭০০০ বঙ্গবন্ধুপ্রেমী সেদিন সম্মুখ যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। দীর্ঘ দুই বছর তাঁরা তাঁদের যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন।
ময়দান জুড়ে আছে লাল নীল রঙিন মুজিব কোট পরিধানকারী আওয়ামী লীগ। ১৫ আগস্ট পরে যারা গা ঢাকা দিয়েছিলেন, যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, সেদিনের সেনাপ্রধান সেই শফিউল্লাহ, রক্ষীবাহিনী, কিংবা বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক যিনি ১৫ আগস্টের সকালবেলা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে প্রায় রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি এক সময় বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা হয়েছিলেন। শফিউল্লাহ এখনো বহাল তবিয়তে রাজনীতি করছেন।
শোক দিবসকে এরা ‘সুখ’ দিবসে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। ১৫ আগস্ট পিতৃহন্তারক বাঙালিদের মুখোশ একবার খুলে দিয়েছিল। মুখোশ খুলে দিয়েছিল ওয়ান এলিভেন। এতো সুসময়ের আওয়ামী লীগ দিয়ে জাতি কি করবে! কোটি কোটি রঙিন পাঁচ বোতামের মুজিব কোট ওয়ালাদের চেয়ে, ৭৫ পরবর্তী দুষ্কৃতিকারীগণের মতো ৭ হাজার দুষ্কৃতিকারীই জাতির পিতার সম্মান রক্ষায় যথেষ্ট। যমুনা টেলিভিশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এদের নিয়ে কারও গায়ে মুজিব কোট ছিলনা। হয়তোবা সেটাকে তাঁরা দুঃসাহস মনে করেছেন কিংবা জনকের প্রতি শ্রদ্ধায় সেই কোট পরিধান করেন নি বলেই আমার মনে হয়েছে।
যে কোন কারণেই হোক বেগম খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট তাঁর তথাকথিত জন্মদিন পালন করা থেকে বিরত থেকেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে যে বিকৃত আনন্দ বিরোধী শিবির করতো তার দুইগুণ আনন্দ উপভোগ করেছে তাঁরা জাতীয় শোক দিবস পালনের ছবি দেখে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য