প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ফরিদ আহমেদ | ২৩ আগস্ট, ২০১৬
গত ৫ জুন চট্টগ্রামে খুন হন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু। শুরুতে এটাকে জঙ্গিদের কাজ ভেবে নিয়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সপ্তাহব্যাপী অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। এরপর হঠাৎ করেই এই মামলা এক নাটকীয় দিকে মোড় নেয়। ২৪ জুন খুন হওয়া মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে খুব অদ্ভুত উপায়ে তাঁর শ্বশুরের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। তিনি এই মামলার বাদি, সেই সাথে পুলিশের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। কিন্তু, পুলিশ তাঁকে তাঁর বাসা থেকে নিয়ে যাওয়ার প্রায় পনেরো ঘণ্টা তাঁর আত্মীয়স্বজনদের কোনো ধারণাই ছিল না বাবুল আক্তার কোথায়। বাবুল আক্তার নিজে কাউকে ফোন দেন নি, পুলিশের কেউ ফোন করে তাঁর পরিবারের লোকদের তাঁর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা দেয় নি। এমনকি তাঁর বাবা এবং শ্বশুর নানা জায়গায় ফোন করে বাবুল আক্তারের খবর জানতে চেয়েও পাননি। কেউ তাঁদের ফোনই ধরে নাই সেদিন। যেটা তাঁদেরকে বিস্মিত এবং বিমূঢ় করেছিল সেদিন।
বাবুল আক্তারকে তুলে নিয়ে যাবার পরদিনই বাংলা নিউজ সংবাদ পরিবেশন করে যে, স্ত্রী হত্যার সাথে বাবুল আক্তার নিজেই জড়িত। তাঁর নির্দেশে তাঁর সোর্সরাই মিতুকে হত্যা করেছে, এটা জিজ্ঞাসাবাদে ‘স্বীকার’ করেছেন বাবুল আক্তার। তিনি খুব সম্ভবত আটক হতে যাচ্ছেন। কিন্তু, এর পর পরই নাটকীয়ভাবে বিকাল বেলা পুলিশ দপ্তর থেকে বের হয়ে আসেন বাবুল আক্তার। বাংলা নিউজ তাঁকে নিয়ে করা লিংকগুলো মুছে দেয় কোনো ধরনের ব্যাখ্যা ছাড়াই। এতে সবার ধারণা জন্মায় যে, বাংলা নিউজ মূলত হলুদ সাংবাদিকতা করেছে। এজন্য তাঁদের প্রচুর গালমন্দও হজম করা লাগে সমাজের নানা স্তর থেকে।
বাংলা নিউজ থেমে গেলেও, এর ক’দিন পর থেকে মূল ধারার পত্রিকাগুলোতেও একই ধরনের খবর আসা শুরু হয়। সেখানে নানা নির্ভরযোগ্য উৎসের রেফারেন্স দিয়ে তারা বলার চেষ্টা করে, ওই পনেরো ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদে ঊর্ধ্বতন তিন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে পরিষ্কারভাবে জানান যে, মিতু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার সকল প্রমাণ তাঁদের কাছে রয়েছে। এখন হয় তাঁকে বাহিনী থেকে পদত্যাগ করতে হবে, নতুবা জেলে যেতে হবে। বাবুল আক্তার পদত্যাগে সম্মতি দেন এবং পদত্যাগপত্র লিখে দিয়ে চলে আসেন।
বাবুল আক্তার সত্যি সত্যি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন কিনা, এটা নিশ্চিত করতে পারতো দুটো অংশ। পুলিশ কর্তৃপক্ষ অথবা বাবুল আক্তার নিজে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ এটাকে ধোঁয়াশা করে ছাড়ে। চরম একটা অপেশাদার ভূমিকা দেখা যায় তাদের মধ্যে। দায়িত্বসম্পন্ন কেউ স্বীকার যায় না কোনো কিছু। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদেরও কেউ প্রতিবাদ জানায় না। বাবুল আক্তার নিজেও শক্ত করে মুখ চেপে ধরে রাখেন নিজের।
দিনের পর দিন যায়, তিনি অফিসে যান না, ছুটিও নেন না। একদিন পুলিশের আইজি অভিযোগ করেন এই বলে যে, বাবুল আক্তারের চাকরি করার মতো মানসিক অবস্থা নেই। তিনি অফিসে আসেন না। এভাবে অফিসে না এলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই কথা শুনেই কিনা কে জানে, বাবুল আক্তার কাজে যোগদান করতে যান। কিন্তু, কাজে তাঁকে যোগ দিতে দেওয়া হয় না। তবে, তাঁর কাজে যোগদান করতে যাওয়ার কারণে সেই পদত্যাগ পত্রের রহস্যের সুরাহা হয়। তাঁকে কাজে যোগদান করতে দেওয়া হয় না তিনি পদত্যাগ করে ফেলেছেন এই যুক্তিতে। সরকারী চাকরির বিধি অনুযায়ী একবার পদত্যাগপত্র দিয়ে ফেললে, সেটা আর ফেরানোর কোনো উপায় নেই। এর পর পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকল সন্দেহের অবসান করে বলেন যে, বাবুল আক্তারের নিজের হাতের লেখা পদত্যাগপত্র তাঁর অফিসে এসেছে। তাঁর পদত্যাগপত্র নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।
ঘটনার এইটুকুর পর বলা যেতে পারে যে, এতদিন পত্রিকাগুলো আমাদের যে খবর পরিবেশন করেছে তার কিছুটা অংশ সত্যি ছিল। বাবুল আক্তার সত্যি সত্যি পদত্যাগপত্র লিখে দিয়ে এসেছিলেন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নেবার রাতেই।
এই পদত্যাগপত্র নিয়ে আমার সামান্য দুই একটা বক্তব্য রয়েছে।
এক: বাবুল আক্তার কি স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র দিয়েছেন? নাকি চাপে ফেলে তাঁর কাছ থেকে পদত্যাগপত্র নেওয়া হয়েছে?
দুই: স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র দিয়ে থাকলে, তার কারণটা কী? তিনি চাকরি করার মতো মানসিক অবস্থায় নেই? সেক্ষেত্রে তাঁর আসলে চিকিৎসা প্রয়োজন। কেন তাঁকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়নি?
তিন: তাঁকে চাপ দিয়ে পদত্যাগপত্র নেওয়া হলে, কারা এই কাজটা করেছে? কী তাদের উদ্দেশ্য? ঠিক কোন কারণে বাবুল আক্তার চাপের সামনে নতি স্বীকার করলেন? তাঁর দুর্বলতাটাই বা ঠিক কোন জায়গায়?
চার: সত্যি যদি তিনি মিতু হত্যার সাথে জড়িত থাকেন, তবে চাকুরি থেকে অব্যাহতি কোনো সমাধান নয়। তিনি একটা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, যার সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। সেটা থেকে তাঁকে মুক্ত করে দেবার কোনো অধিকার কারো নেই। চাকরি থেকে অব্যাহতি খুনের শাস্তির সমতুল্য হতে পারে না কিছুতেই।
বাবুল আক্তারের ঘটনা এখন আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। বাবুল আক্তার নিজেই দাবি করেছেন, তাঁকে চাপে ফেলে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। তিনি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন। আগের‘অব্যাহতিপত্র’বাতিল করতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া আবেদনের বিস্তারিত বর্ণনায় বলা হয়, ‘বিগত ৫.৬.২০১৬ইং তারিখে আমার স্ত্রী নির্মমভাবে খুন হন। ওই ঘটনার পর দুটো অবুঝ শিশু সন্তান নিয়ে আমি সীমাহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাই। আমি এতটাই শোকাহত ছিলাম যে, শুধু সন্তানদের কথা ভেবে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। শোকগ্রস্ত ও অসহায় অবস্থায় আমি যখন জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় অতিবাহিত করছিলাম, সেই সময় বিগত ২৪.০৬.২০১৬ইং তারিখে পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরির অব্যাহতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। স্ত্রীর মৃত্যুশোক, সদ্য মাহারা দুটো শিশুর ব্যাকুলতায় প্রতিকূল ও বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে আমি চাকরি হতে অব্যাহতির আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করি। একজন সৎ পুলিশ অফিসার হিসেবে এবং আমার সন্তানদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন এই চাকরি। এমতাবস্থায়, উক্ত অব্যাহতিপত্রটি প্রত্যাহারের আবেদন জানাচ্ছি, যা আমি স্বেচ্ছায় দাখিল করিনি।’
এর বিপরীতে পুলিশ প্রশাসন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে যে, জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেবার কোনো প্রশ্নই আসে না। বাবুল আক্তার নিজের ইচ্ছাতেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। বাবুল আক্তারের কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগপত্র নেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ হাস্যকর উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমি তো জোরটোর দেখি না, কারণ আমার কাছে কাগজ আছে। কাগজে তো জোর করার গন্ধ পাই না। এমনকি জোর করে তার কাছ থেকে পদত্যাগপত্রে সই নেয়া হয়েছে তা কখনও তিনি (বাবুল) বলেননি।‘
বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেনের বক্তব্য হচ্ছে, ‘পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা এভাবে পদত্যাগ করতে পারেন না। তিনি কোথায় বসে, কীভাবে পদত্যাগপত্র দিচ্ছেন সেটাও বিবেচ্য বিষয়।’
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘কে কি বলল এটি দেখার বিষয় নয়। তাছাড়া বাবুল আক্তার বললে তারা বিষয়টি নিয়ে ভাবতেন। তার শ্বশুর চাকরিতে নেই। তাই তার বক্তব্যও গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া বাবুল আক্তার অক্ষম কিংবা অনুপস্থিত নয়, উনার (বাবুল) কথা আরেকজনের বলার সুযোগ নেই। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাবুল আক্তার যদি এ ধরনের অভিযোগ করতেন, সেক্ষেত্রে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যেত।‘
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাবুল আক্তারের পদত্যাগপত্র, তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের আবেদনপত্রসহ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে এনেছে। আগামী সপ্তাহেই তা রাষ্ট্রপতির কাছে চলে যাবে বলে তাঁরা বক্তব্য দিয়েছেন। এখন সম্পূর্ণ বিষয়টা নির্ভর করছে রাষ্ট্রপতির উপর। তিনি বাবুল আক্তারের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে পারেন, কিংবা তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের আবেদনের উপর ভিত্তি করে পুরো বিষয়টার একটা তদন্ত করারও নির্দেশ দিতে পারেন। আমাদের সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে যেতে হবে এই রহস্যের শেষ দেখার জন্য।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে বাবুল আক্তার ইস্যুর রহস্য এখন একটা প্রধান প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সেটা হচ্ছে, কোন চাপে পড়ে তিনি পদত্যাগপত্রে সই করেছিলেন? তাঁর মাথায় কি সেদিন পিস্তল ধরা হয়েছিল? নাকি তাঁর বাচ্চাদের খুন করে ফেলার হুমকি দিয়েছিল কেউ? কিংবা তাঁর কোনো দুর্বলতাকে (খুন হতে পারে, হতে পারে বড় ধরনের কোনো দুর্নীতি কিংবা অন্য কোনো গোপন অপকর্ম) কাজে লাগিয়েছিল প্রতিপক্ষ? তাঁকে যদি তাঁর সহকর্মীরা ভয় দেখিয়ে থাকে, এর প্রতিকার তিনি সরকারী বিধি অনুযায়ীই পাবার কথা অভিযোগ করলে। প্রতিকার না পেলেও, তাঁর চাকরির বিধি মেনে ওইসব ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করা উচিত ছিল যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সাথে সাথেই। এটা অনেক সিরিয়াস একটা ইস্যু। তিনি সেটা করেন নি। এমনকি তাঁর কাছ থেকে যে জোর করে পদত্যাগপত্র নেওয়া হয়েছে ২৪শে জুন রাতে, সেটাও তিনি এতদিন কাউকে বলেন নাই। এখন চাকরি চলে যাচ্ছে দেখে মুখ খুলেছেন তিনি। তিনি প্রাণের ভয়ে এতদিন মুখ খোলেন নাই, এই যুক্তিটা খুব একটা শক্তিশালী কোনো যুক্তি না। একজন পুলিশ সুপারকে তাঁর সহকর্মীরা, তা তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, জানের ভয় দেখাতে পারে না। ব্যাপারটা এতো সহজ না। ভয় দেখালেও, সেটাকে অতিক্রম করার সামর্থ্য একজন পুলিশ সুপারের থাকে বলেই আমার ধারণা।
ধরা যাক, ২৪ তারিখ রাতে তাঁকে একা পেয়ে গিয়েছিল প্রতিপক্ষ। তিনি বাধ্য হয়েছিলেন পদত্যাগপত্র দিতে। কিন্তু, পরের দিন বিকালেই তিনি মুক্ত হয়ে যান। তাঁকে ভয় দেখিয়ে পদত্যাগপত্র নিয়েছে, এটা নিয়ে তখনই তাঁর সচল হবার কথা ছিল। তাঁর বন্ধু-বান্ধব আছে, শুভাকাঙ্ক্ষীর আছে, আছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। মিডিয়াও আছে। কিন্তু, তিনি করেন নাই সেটা। কেন করেন নাই? প্রতিপক্ষের দেওয়া ভয়ে তিনি ঘরবন্দি হয়ে গেলেন কেন? একটা মানুষকে কেউ ভয় দেখালে, সে তাঁর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সেটাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। বাবুল আক্তারের ক্ষেত্রে সেই চেষ্টাটা দেখা যায় নি।
বাবুল আক্তার কি তাহলে নিজস্ব কোনো গোপন দুর্বলতা নিয়ে শঙ্কিত? মিতু হত্যার সাথে কি সত্যি সত্যিই তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে? পত্রপত্রিকা যা যা এসেছে, সেগুলো কি তবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না? সময়ই বলে দেবে এইসব প্রশ্নের উত্তর। সত্য কখনো চাপা থাকে না, এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য