প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
দেবজ্যোতি দেবু | ২৫ আগস্ট, ২০১৬
"বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট। তোমরা একজন একজন করে এসো। ও মরে যাবে।"
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ৮ম শ্রেণীর এক কিশোরী পূর্ণিমা রানী শীল। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তি সহিংসতার শিকার হয়েছিল বিএনপি-জামাত জোট সরকারের কর্মীদের হাতে। ১০-১২ জন মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছিল পূর্ণিমাকে। কিশোরী মেয়েটার কষ্ট হবে আঁচ করে একজন অসহায় মায়ের এমন করুণ আকুতি। জানোয়ারের কাছে মানুষ কতোটা অসহায়!
জানোয়ারদের আরো জানোয়ার করে তোলার পিছনে দায়ি কিন্তু আমরাই। ধর্ষণ বাংলাদেশে নতুন কিছু না। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় একটা দুইটা ধর্ষণের খবর ছাপা হয়। আমরা শুধু দেখি আর আফসোস করি। নিরবে নিভৃতে কষ্ট পাই। কষ্ট পুষে রাখি কিন্তু কিছু করি না, বলি না। কখনো নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে, কখনো রাজনৈতিক চাপে আমরা চুপ থাকি। আমাদের এই নিরবতাই ধর্ষণে আরো উৎসাহ যোগায়। আমরাই তার ব্যবস্থা করে দেই।
কিছুদিন আগে ঢাকার শ্যাওড়াপাড়ার একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আফসানা ফেরদৌসকে ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনায় অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ তেজগাঁও কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিনের উপর। আফসানার পরিবারের দাবি আফসানাকে অপহরণ এবং ধর্ষণের পর হত্যা করেছে রবিন। এজন্য ছাত্রলীগের দিকে সরাসরি আঙ্গুল তুলছেন আফসানার পরিবার এবং ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা।
অপর একটি মহলের দাবি এটা সম্পূর্ণই রবিন-আফসানার দাম্পত্য কলহের করুণ পরিণতি। এজন্য ছাত্রলীগের কোন দায় নেই। ছাত্রলীগের ইমেজ নষ্ট করতেই এমন অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
দুই পক্ষের কাঁদা ছুড়াছুঁড়িতে ন্যায্যতা হারাচ্ছে আফসানার হত্যাকারীর শাস্তির দাবি। দায় ছাত্রলীগের আছে কি-না, তা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। আফসানাকে যে নির্মম ভাবে হত্যা করলো রবিন, সেটা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নাই। বস্তুত পক্ষে এভাবেই অপরাধ করে ফাঁক গলে বের হয়ে যায় অপরাধীরা।
আমাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ছাত্রলীগ কর্মীরা কোন অপকর্ম করতে পারে না। যারা ছাত্রলীগ করে তারা সকলেই অত্যন্ত সুপুরুষ! আসলেই কি তাই?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসীমুদ্দিন মানিক ওরফে রেপিস্ট মানিক'র কথা মনে আছে? ৯৮-৯৯ সালে যে ধর্ষণে সেঞ্চুরি করে বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করেছিল, ক্যাম্পাসে মিষ্টি বিতরণ করেছিল? তদন্ত কমিটি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু প্রমাণের অভাবে, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে শাস্তি হয়নি তার।
২০১৬ সালের জুন মাসে পটুয়াখালির বাউফলে রাতে ট্রলারে মা ও মেয়েকে তুলে নিয়ে জোর করে গণধর্ষণ করে স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা ও তার সহযোগীরা।
২০১৬ সালের মে মাসে সদ্য এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক তারিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাভলী নামের এক পোশাক শ্রমিককে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয় ধামরাই উপজেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক লায়ন পারভেজের নামে।
এরকম শত শত ধর্ষণের অভিযোগ এবং প্রমাণ আছে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সর্বাধিক আলোচিত ছিল পিরোজপুরের দশম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ করে সেই দৃশ্য ভিডিও করে বাজারজাত করার ঘটনা। সেই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল জেলা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আহসান কবীর মামুন ওরফে টাইগার মামুনকে।
পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে তরুণী লাঞ্ছনা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অনেকবার। তাই বলে কি ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল কোন ইতিহাস নেই? ছাত্রলীগের প্রশংসা করার মত কোন কাজ নেই? অবশ্যই আছে। তাহলে কেন এক রবিনের জন্য ছাত্রলীগকে দায় নিতে হবে?
রবিন, মামুন, পারভেজ, মানিকরা আলাদা আলাদা ব্যক্তি পরিচয় বহন করে। ছাত্রলীগ পরিচয় পাওয়ার আগে তাদের নিজস্ব একটা পরিচয় আছে, চরিত্র আছে। সেই ব্যক্তি পরিচয় ততোক্ষণ সংগঠনকে দায়ি করে না, যতোক্ষণ পর্যন্ত না সংগঠন সেই ব্যক্তির পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, কিংবা সেই ব্যক্তি সংগঠনের আদর্শ পরিপন্থি কোন কাজে জড়িত থাকার পরেও সংগঠন চুপ থাকে।
আমরা জানি আফসানা ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং রবিন ছাত্রলীগের। রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে থেকেই তারা প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে বৈবাহিক জীবনে পা রেখেছিলেন। এটা সম্পূর্ণই তাদের ব্যক্তিগত জীবনের চিত্র। এখানে যেমন রাজনীতির কোন স্থান নেই, তেমনি আমরা ব্যক্তি রবিনের অসৎ কর্মকান্ডের দায়ও ছাত্রলীগের উপর চাপাতে পারি না। কিন্তু যখন দেখি রবিন কিংবা মানিকের সাংগঠনিক পরিচয় তার শাস্তি পাওয়া না পাওয়ার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাদের অপকর্মের দায় থেকে সংগঠনকে কি আলাদা করা যায়?
আফসানা হত্যাকান্ডের পর বিভিন্ন ভাবে সেটাকে আত্মহত্যা বলে প্রমাণের চেষ্টা চলছে। ধর্ষণ হয়নি বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে। যেখানে আমরা জানি, আফসানার লাশ হাসপাতালে পৌছে দিয়ে দু'জন লোক পালিয়ে যায়, বিভিন্ন নাম্বার থেকে ফোন করে আফসানার পরিবারকে বিভ্রান্ত করা হয়, অবশেষে হুমকিও দেয়া হয় কয়েকবার। এতোকিছুর পরও আফসানার হত্যাটা আত্মহত্যা হয়ে যায় কিভাবে? কিভাবে এতোগুলো হুমকি দেয়া ফোন পুলিশের তদন্তের বাইরে থেকে যায়? এই সবই কি স্বাভাবিক কোন ঘটনা? নাকি রবিনের রাজনৈতিক পরিচয়ই এসব তদন্তের নামে রসিকতার মূল কারণ?
অন্যান্য ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ডে যদি এসব আলামতকে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়ে থাকে, তাহলে রবিনের ক্ষেত্রে কেন এসব আলামতকে এড়িয়ে গিয়ে আত্মহত্যা বলে দায় সারতে চাইছে পুলিশ? তনু হত্যাকান্ডে ডাক্তারের রিপোর্ট যদি আমরা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে ভুয়া বলে প্রমাণ করে থাকি, তাহলে আফসানার ক্ষেত্রে কেন আমরা চুপ? কেন আমরা শাস্তি দাবি না করে, সঠিক তদন্ত দাবি না করে, ছাত্রলীগ নিয়ে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছি?
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি রবিনের চেয়ে এখানে তার সাংগঠনিক পরিচয়টাই তাকে বাঁচানোর জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিনই কোন তদন্ত ছাড়াই ওসি মন্তব্য করেছেন "এটা আত্মহত্যা" বলে। রবিনের পক্ষে ছাত্রলীগের কর্মীরা পরোক্ষভাবে কথা বলছে, ফোনে হুমকিও দিচ্ছে। সাংগঠনিকভাবে এমন খুনির বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করেননি নেতা পর্যায়ের কেউ। তাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়নি এখনো। এটা কি তাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন যোগাচ্ছে না? তদন্তে কোন প্রভাব ফেলছে না?
আফসানার বাবা-মা তাদের সন্তানকে হারিয়েছেন। ভাই হারিয়েছে তার আদরের বোনকে। যে বোন কথা দিয়েছিল ঈদের সময় বাড়ি এসে সবার সাথে মিলে ঈদ করবে। ভাইটা সেই অপেক্ষাতেই বসে ছিল। কিন্তু তার বোন আর ঈদে আনন্দ করার জন্য বাড়ি ফিরবে না। সেই বোনের নিথর দেহটিকে কবর দিয়েছে অপেক্ষায় থাকা সেই ভাই। শোকে কাতর পরিবার জানে না এই শোক তারা কিভাবে কাটিয়ে উঠবে। তারা জানে না আদৌ আফসানা বিচার পাবে কি-না। এতো মর্মান্তিক সত্য চোখের সামনে দেখেও কি আমরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিচয় থাকার কারণে একজন ধর্ষককে এভাবে এড়িয়ে যাবো? তার কৃতকর্মকে অদেখা করে রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েই তর্ক করে যাবো?
আমাদের উচিত মানুষ আফসানার উপর নির্যাতন এবং হত্যার অপরাধে জানোয়ার রবিনের বিচার চাওয়া। মানুষের পক্ষে থেকে জানোয়ারের বিরুদ্ধে একজোট হওয়া। এই সমাজটা মানুষের। এখানে মানুষই রাজনীতি করবে। কোন নরপশুকে রাজনীতিতে তো দূরের কথা, এই সমাজেও থাকতে দিতে চাই না। রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আসুন মানুষের পক্ষে দাঁড়াই। রাজনৈতিক অঙ্গনটাকে মানুষের কল্যাণের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করি। রবিনদের রাজনৈতিক পরিচয় ছাত্রলীগের সুনাম নষ্ট করছে। এসব পিশাচের সঙ্গ ত্যাগ করে মানুষের সাথে হাতে হাত রেখে লড়াই করি। ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী পরিচয়ে নয়, লড়াইটা হোক জানোয়ারের বিরুদ্ধে মানুষের। যেখানে সকল মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে অমানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।
সবাইকে জানিয়ে দিন, বাংলাদেশটা মানুষের। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় কোন অপরাধীর ঠাঁই নেই।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য