প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ৩১ আগস্ট, ২০১৬
নিকট অতীতেও শরৎ ছিল অবকাশ যাপন, তালের পিঠা ও পাগলা হাওয়ার ঢেউ খেলানো কাশবনের ঋতু। পাকা তালের মোহনীয় ঘ্রাণ যেনো পূর্বাহ্ণেই এর আগমনী বার্তা সগৌরবে প্রচার করে। আহ্নিক গতির প্রভাবে বাংলা-প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চের ভোরের পর্দা সরিয়ে সূর্যোদয়ের মতোই হাজির হলো বঙ্গাব্দের পঞ্চম তনয়া। লোকজ ভাষায় যার আরেক নাম ‘ভাদ্দর।’
‘তালপাকা গরম আর মোলায়েম সফেদ কাশফুল এ মাসের সমার্থক। সময়ের আবর্তে আশ্বিনের অগ্রজের কাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি। এর চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য কালিমাখা মেঘ নীল আকাশের সীমানা থেকে পালাই পালাই করে। পানিহারা পেঁজা পেঁজা মেঘের টুকরো ইতস্তত: ঘুরে বেড়ায়। অবিরাম বর্ষণের ঝম্ ঝম্ শব্দ থাকে না। সূর্য রশ্মির খরতায় অসহনীয় গরম বিরাজ করে সর্বত্র। বৃক্ষমুণ্ডের তালগুলো পেকে কালচে লাল রং ধারণ করে। জর্দা রঙ্গা শিউলি ফুল ফোটে দেহে স্নিগ্ধতার আমেজ মেখে। নদীর কূলে কূলে কাশবনের মায়াবী আমন্ত্রণ। দুরন্ত শিশু-কিশোরের দল সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দস্যিপনায় মেতে ওঠে। তবে এবার বর্ষা পুরোমাত্রায় না হওয়ায় কাশবনও যেনো অন্যরকম অভিমান করেছে!
সাধারণত বাংলা বছরের প্রথম পাঁচ মাস একত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। পঞ্জিকা বিশারদদের হিসাব অনুযায়ী ভাদ্র পঞ্চম একত্রিশা মাস। বলাবাহুল্য, অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস একত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। ভাদ্রপাদ তারার নামে ভাদ্র মাসের নামকরণ করেছেন পণ্ডিতরা। এ মাসে শুক্র একাদশীতে ‘পাশ মোড়া’ নামক ধর্মীয় আচার পালন করে হিন্দু সম্প্রদায়। ধর্মানুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগ থাকা সত্ত্বেও এটি প্রধানত আনন্দ উপভোগের উপলক্ষ হিসাবেই লোকের কাছে সমাদৃত। শুধু যে হিন্দুরাই উৎসব পালন করে তা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানসহ অপরাপর অমুসলমানরাও ভাদ্রের তালের পিঠা খাওয়ার খুশিতে বিষম উৎসবে মেতে ওঠে। এছাড়া পেয়ারা, আনারস, চালতা, জাম্বুরা, আমড়া, উড়িগাব ইত্যাদি এ উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ করে।
তবে অসহনীয় ভ্যাঁপসা গরম ভাদ্র মাসের চরিত্রে যেন স্থায়ী কালিমা লেপন করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি বিএনপির যেমন অভিযোগের কোনো শেষ নেই, ভাদ্রকে নিয়ে আধুনিক মানুষেরও অভিযোগের কোনো শেষ নেই। কথায় আছে ভাদ্রের গরমে তাল পাকে। তাল নিয়ে মানুষের খুব একটা আগ্রহ নেই। তালের পিঠার বাজার দরও খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। তবে এই গরমে সবার বেতাল অবস্থা। ভাদ্রমাস শুরু হবার পর থেকেই প্রচণ্ড গরমে জনজীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। প্রখর রৌদ্রের উত্তাপ দেশবাসীকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে লোডশেডিং।
ভাদ্রমাসের গরম প্রাচীন কাল থেকেই সুবিখ্যাত। এই গরমে মানুষ তো বটেই, কুকুর পর্যন্ত বেতাল হয়ে পড়ে। কুকুরের আচরণে বিরাট পরিবর্তন আসে। এ মাসে কুকুর সমাজের একটা বড় অংশই গরমে দিশেহারা হয়ে প্রায় পাগল হয়ে যায়। মানুষ সতর্ক হয়। গ্রামগঞ্জে এখনো কুকুর দেখে গরমের তীব্রতা অনুমান করা হয়। মাঝেমাঝে দেখা যায় কোনো জলাশয়ে কুকুর নেমে পড়লে ছেলেমেয়েরা সেই জলাশয়ে গোসল করতে নামতে ভয় পায়। তখন দুষ্ট বালক-বালিকার দল ঢিল ছুঁড়ে মেরে কুকুরটাকে দূরে সরাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কুকুর অনমনীয়। নড়াচড়ার কোন নামই নেয় না! ভাদ্রের গরম বলে কথা!
ভাদ্রমাসটা আসলে বিরক্তিকর একটা কাল। ভাদ্র মানেই বেড়াজাল শুভ কাজ নাস্তি, পায়ে পায়ে বাধা-বারণ। কবিরা পর্যন্ত এই মাসটাকে উপেক্ষা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তবু এর অন্য রূপও আছে। ভাদ্র বাদ দিয়ে যখন আমরা ভাদর উচ্চারণ করি তখনই ছলোছলো একাকীত্ব, টইটম্বুর বিরহ আর অব্যক্ত ছটফটানি এসে ভিড় করে। এমন ধারা কেন?
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর...। চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী এক ঝড়বৃষ্টির দিনে তাঁর অন্তরঙ্গ দেবর রবিকে বিদ্যাপতির এই লাইনটিতে সুর বসাতে অনুরোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাৎক্ষণিক ভাবে তাতে মিশ্র মল্লারের সুর দিয়ে গাইতে শুরু করেন। বিদ্যাপতির প্রভাবে রবি তখন হয়েছেন ভানুসিংহ, রচিত হচ্ছে অপূর্ব সুন্দর ভানুসিংহের পদাবলী। আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসে এ এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
আমরা আগে শুনতাম, ‘ধারার শ্রাবণ, পচা ভাদ্র’, অর্থাৎ শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি হয় জোরালো, ভাদ্র মাসে টিপ টিপ, সেই জন্য ভ্যাপসা গরমও চলে। কিন্তু আবহাওয়া এখন অনেক পালটেছে, কোনও কোনও ভাদ্র মাসেও প্রবল বৃষ্টির তোড়ে নদীনালা উপচে ওঠে, কোথাও কোথাও বন্যা হয়। এখন যেমন হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। তারা সেই বন্যার বানিতে নাজেহাল হয়ে ফারাক্কার কপাট খুলে দিয়েছে। সেই পানি আমাদের পদ্মা দিয়ে বয়ে এসে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত করছে। এ এক বেমক্কা ফ্যাসাদ। যখন ফারাক্কা দিয়ে পানি আসা দরকার, তখন ঠিকঠাক মত আসে না। আর এখন অদরকারি হলেও পানিতে ভেসে যাচ্ছে! ভাদ্র বুঝি এ কারণেও ‘অপয়া’!
খুব সম্ভবত ‘চরিত্র-দোষের’ কারণেই শরৎকাল হিসেবে আশ্বিন যতটা মান্যতা পেয়েছে, ভাদ্র তেমন পায়নি। নামটাও কেমন কর্কশ। এ কারণেই কী ছোটভাইয়ের স্ত্রীকে ভাদ্রবধূ বা ভাদ্দর-বউ বলে ? কবিরাও এই মাসের উল্লেখ এড়িয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ অজস্র বর্ষার গান লিখেছেন, আষাঢ় ও শ্রাবণের উল্লেখ অজস্র, তার পরই ভাদ্রকে টপকে চলে গেছেন আশ্বিনে। যেন তিনি এই মাসের ভাসুর! যত দূর মনে পড়ে, তাঁর একটিমাত্র গানে এই রকম আছে, ‘আজ বারি ঝরে ঝর ঝর ভরা ভাদরে।’ এখানেও তিনি বিদ্যাপতির মতন ভাদ্রকে ভেঙে ভাদর করেছেন। তিনি ওই মাসটির প্রতি সেই প্রথম যৌবনের পর আর তেমন মন দেননি, এ কথা বলা যেতেই পারে।
আমাদের দেশের রাজনীতিও এই ভাদ্রে কিছুটা তেঁতে উঠেছে। নারায়ণগঞ্জে পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে গুলশান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী। নিহত তার দুই সঙ্গীও। গত ২ জুলাই গুলশান হামলার পর থেকেই তামিমকে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে দাবি করছিল পুলিশ। তার খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযানও চলছিল। অবশেষে তামিম ও তার দুই সঙ্গীকে খতম করে পুলিশ। তালপাকা গরমে দেশবাসীর কাছে এটা একটা স্বস্তির সংবাদ বটে। স্বস্তির সংবাদ অবশ্য আরও একটা আছে। জামায়াতের অন্যতম শীর্ষ নেতা, আলবদর নেতা ও ধনকুবের মীর কাসেম আলির যুদ্ধাপরাধের চূড়ান্ত দণ্ড এখন কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ফাঁসির দড়ি আর মীর কাসেম আলির মাঝখানে শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা বাকি।
এদিকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে পারস্পরিক বাদানুবাদ তীব্র হয়ে উঠেছে। ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে রামপালে যে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ চলছে তা সুন্দরবনের পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক, এই অভিযোগে অনেক আগে থেকেই আন্দোলনে নেমেছে বিভিন্ন বাম দল। এ ব্যাপারে আগাগোড়া চুপচাপ থাকা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আকস্মিক এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রকল্পের বিরোধিতা করেছেন। এই প্রকল্পটি বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন পর বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ‘শীতনিদ্রা’ ভঙ্গ হতে দেখে অনেকে আমোদও বোধ করছেন। কেননা বেগম জিয়ার শাসনামলেই দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত কয়লা খনির বিরোধিতা করায় ২০০৬ সালে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।
আন্দোলনকারী বিভিন্ন বাম দল ও খালেদা জিয়ার অবস্থানের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন শেখ হাসিনা। তিনি আন্দোলনকারীদের খোঁচা দিয়ে বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। বিরোধীদের কথায় আমার কিছু যায়-আসে না। আপনাদের কথায় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিলে বিদ্যুৎ পাবেন না। হারিকেন নিয়ে অন্ধকারে বসে থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণের মাত্রা ন্যুনতম রেখেই এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। এই প্রকল্প সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি করবে না।’
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যে বাদানুবাদ চলছে, হঠাৎ ‘ঘুম থেকে জেগে’ বেগম খালেদা জিয়া রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি এবং আনেদালনকারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ‘হারিকেন নিয়ে অন্ধকারে বসে থাকা’র প্রচ্ছন্ন হুমকি রাজনীতিতে যে উত্তাপ সৃষ্টি করেছেন, তাকে রসিকজনেরা ‘ভাদ্র মাস সিন্ড্রোম’ বলে অভিহিত করছেন! আসলেই তাই! ভাদ্রমাসের এই গরমে মাথা ঠিক রাখা সত্যি খুব কঠিন ও কষ্টকর কাজ!
তবে আমাদের হতাশ হলে চলবে না। ধৈর্য ধরতে হবে। উল্টাপাল্টা আচরণ ও কথা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে, ভাদ্র মাসে তাল পাকে। তাই তাল পাকার মহান ব্যাপারটা চিন্তা করে এই তাল-পাকা-গরমটাকে একটু সহ্য করতেই হবে।
কী আর করা! মাত্র তো আর কটা দিন!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য