প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
দুদিন বাদেই ঈদ। সেই উপলক্ষে শ্রমিকদের ছুটি পাওয়ার কথা ছিল। কারখানা ক’দিন বন্ধ থাকবে। তাই রাতের শিফটে চলছিল জোরকদমে কাজ। আচমকা এক বিস্ফোরণে তছনছ হয়ে গেল সব কিছু। আকস্মিক আগুনে পুড়ে মারা গেল প্রায় ২৬জন মানুষ। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৫০ জন। শনিবার সকালে গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড নামের কেমিক্যাল ও ফয়েল পেপার তৈরির একটি কারখানায় বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
গত ঈদের আগে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গিদের হামলার ঘটনা পুরো দেশকে বিষাদে ভাসিয়ে দেয়। এবারও ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঈদের খুশিকে ম্লান করে দিয়েছে। গুলশানে জঙ্গি হামলার সাথে টঙ্গীর কারখানাটির বিস্ফোরণের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য কি আছে? গুলশানে যারা হামলা করেছিল, তারা জঙ্গি। দেশে নব্য জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে, হামলাকারীরা তার সদস্য। কিন্তু দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই যে কারখানাগুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষ খুন হচ্ছে, পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তো, সেই মালিকপক্ষ কী হত্যাকারী নয়? তাদের বিরুদ্ধে কেন দমন অভিযান চালানো হয় না কেন?
এ বড় বেদনার অভিজ্ঞতা। অবহেলা, উপেক্ষা আর মুনাফা অর্জনের লোভাগ্নির কাছে কিছু গরিব মানুষ পুড়ে ছাই হলো। ঈদের আগে ওভারটাম করে শ্রমিকরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বেতন আর বোনাসের টাকা তুলে ঘরে ফেরার। ঈদের আনন্দ-উৎসবে শামিল হবার। ঈদে প্রিয়জনদের মাঝে তারা ফিরবেন বটে, তবে লাশ হয়ে। পরিবার টাকাও কিছু পাবে। মন্ত্রণালয়, প্রশাসন সব মিলিয়ে প্রায় সোয়া দুই লাখ টাকা দেবে নিহত পরিবারগুলোকে! এই অনুদানের টাকার লোভে তারা যেন ভবিষ্যতে আবার ‘পুড়ে মরতে’ রাজি হয়!
যে কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেই কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে আইন মানা হয়নি। প্রাণহানির জন্য মূলত সরকার ও মালিকপক্ষের অবহেলাই দায়ী। এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটা সরকার ও মালিকপক্ষের অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। এ জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। কিন্তু কার কাছে জানাব এ দাবি? তাতে কী কাজ হবে? কারখানার পরিবেশ উন্নত হবে? মানুষ এভাবে আর মরবে না? ২৫-২৬টি তাজা প্রাণ জলন্ত আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। এরা কেউ কি কেউ ভেবেছিল, লাশ হয়ে ঘরে ফিরবে? নাকি স্বপ্ন দেখছিল দুদিন পরেই মিলবে প্রিয়জনের সঙ্গে? প্রতিটি মানুষের জীবন তো এক একটি মহাকাব্য। যার পরতে পরতে থাকে হাসি-আনন্দ, প্রেম ভালবাসা।থাকে সন্তানের জন্য আকুলতা থাকে প্রিয় মানুষের জন্য ব্যাকুলতা।সেই প্রাণের মূল্যায়ন কিসে হবে, লক্ষ টাকা অনুদান, আর শোক প্রকাশের মাধ্যমে? যাদের কারণে এই প্রাণগুলো অকালে দগ্ধ হলো, তারা কী এর জন্য কোনো শাস্তি পাবে না? পার পেয়ে যাবে?
অধিক জনসংখ্যা ও সস্তাশ্রমের এ দেশে বেশির ভাগ শ্রমজীবীই মানবেতর জীবন যাপন করেন। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি তাদের নাই, তাদের যেন কীট-পতঙ্গের প্রাণ, কয়দিন পরপরই কেবল বাতাসে তাদের লাশের গন্ধ ভাসে। তাজরিন গার্মেন্টস, রানা প্লাজায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে, বিভিন্ন কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকবান্ধব কিছু উদ্যোগ নেয়াও হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে যে কোনো রকম সতর্কতা বা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় নি- ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
আমাদের দেশে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আচরণ দেখলে মনে হয়, দেশে জনসংখ্যা দায়িত্ব বুঝি তারাই নিয়েছে। তা না হলে মানুষ মারার ফাঁদ হিসেবে কেন প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা হবে? কেন অগ্নিনির্বাপণের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা থাকবে না? কেন দ্রুত নেমে যাবার সিঁড়ির গেট বন্ধ করে রাখা হবে? কেন শ্রমিক নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে না না? সরকারই বা এমন ‘মৃত্যু-বান্ধব’ পরিবেশকে কেন ছাড়পত্র দেবে?
মালিক-সরকারের উদাসীনতায় বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনার নামে শ্রমিকের মৃত্যু এখন আমাদের অনেকেরই গা-সওয়া হয়ে গেছে। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে-এমন পরিবেশ বহাল রেখে যারা শিল্প-কারখানা স্থাপন করছেন, আর যে সব সরকারি কর্মকর্তা সব জেনে-বুঝেও এসব প্রতিষ্ঠান চালানোর ছাড়পত্র দিচ্ছেন-খুনি আসলে তারাই। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কী?
ঘটনা ঘটার পর মন্ত্রীরা বলে থাকেন, দায়ী যেই হোক না কেন সে খুনী এবং শাস্তি তাকে পেতেই হবে। এই ধরনের কথাগুলোকে আজকাল আর কেউ যেমন গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে না। কেননা এই ধরনের কথার কোনো বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় না। কদিনের উত্তপ্ত বাক-বিতণ্ডার পর সব ধামাচাপা পড়ে যাবে, জনগণের দাবির স্বর সন্ধ্যা প্রদীপের মত স্তিমিত হয়ে আসবে।
ঘটনার পেছনে কে দায়ী, কারা দায়ী এবং তাদের শাস্তি দাবি করলে অনেক সময় সরকারের বিরাগভাজনও হতে হয়। আমাদের দেশে অপরাধ করে পার পেয়ে যাবার যে একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তাতে সরকারের ভূমিকা সব সময়ই অপরাধীর পক্ষে। সরকার কেন জানি অপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। এতে করে সাধারণ মানুষও সরকারের বিরুদ্ধে বিরূপ হয়ে উঠে। সরকারের ভালো উদ্যোগককেও কেউ আর ভালো চোখে দেখে না।
ইতিমধ্যে প্রথামাফিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এতে কী লাভ হবে বোঝা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত দেশে সংঘটিত নানা ঘটনা দুর্ঘটনায় কটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, আর কটি তদন্তের ফলাফল আলোর মুখে দেখেছে-সে তথ্য কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না।
বিভিন্ন কারখানা-গার্মেন্টস মালিকের কাছে শ্রমিকের জীবনের চাইতে অর্থ বড়, মুনাফা বড়-এই কথাটিই আমাদের দেশে একমাত্র সত্য। আর সরকার শ্রেণিগত কারণেই মালিকের ‘স্বার্থ’ রক্ষায় ভূমিকা পালন করে। তা না হলে একটির পর একটি গার্মেন্টসে আগুন লাগে, মারা যায় তালাবদ্ধ শ্রমিক। কত শত শ্রমিক এই পর্যন্ত করুণ মৃত্যুকে বরণ করেছে জীবনের সন্ধানে কাজ করতে এসে। শ্রমিকের ঘামে সম্পদের চূড়ায় বসেও মালিকের লালসা মেটেনা। দেশে তো শ্রমিকের অভাব নেই। দুই শত মারা গেলে ডাক দিলেই দুই হাজার শ্রমিক এসে হাজির হবে পরদিন। তার উপর মালিকরা হলো দেশের সমস্ত আইনের ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। তাদের গায়ে এমনই তেল যে ধরলেই ফসকে যায়। এই পর্যন্ত বাংলাদেশে কত গার্মেন্টস কর্মী কেবল আগুনে মারা গেছে বা ভবন ধসে মারা গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আজ পর্যন্ত কোনো মৃত্যু বা হতাহতের ঘটনার জন্য, কোনো গার্মেন্টস মালিক দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে ঢুকেনি। তাদের সংগঠন বিজেএমই এ অতি শক্তিশালী সংগঠন। কাক কাকের মাংস খায় না বলে প্রবাদ আছে। আর তাই কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি এই সংগঠনটি দোষী সদস্যের বিরুদ্ধে। ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে ঘটা করে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে তারা তাদের মহান দায়িত্ব পালন করেছেন আর কারো কারো বাহাবা কুড়িয়েছেন!
মুনাফার লোভে, ধর্মের নামে, নীতিহীন রাজনীতির নামে যারা মানুষের জীবন কেড়ে নেয় তাদের সংখ্যা নিতান্ত কম। তাদের গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে যদি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে আক্রান্ত মানুষ একদিন ঠিকই ফুঁসে উঠবে। তখন খুনিদের রক্ষাকারী বা দোসর হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধেও জনরোষ উথছে উঠতে পারে। সেটা দেশের জন্য, সরকারের জন্য শুভ হবে না। কাজেই সময় থাকতেই সরকারকে অন্যায়কারী, মানুষ হত্যাকারীদের পক্ষ ত্যাগ করতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান ও ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এখন বিভিন্ন শিল্পকারখানায় নানা অব্যবস্থা চালু রেখে স্রেফ মুনাফার লোভে যারা নিরীহ শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, সেই সব ঘাতক-খুনীদের বিরুদ্ধে সরকার দৃঢ় হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে-এটাই জনপ্রত্যাশা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য