প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ | ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
এবার ঈদের ছুটি প্রায় ১০দিন। এমন 'ছুটি'-র ইতিহাস বাংলাদেশে বিরল। ছুটি বিরল হলেও অভিপ্রায় সরল। কোথাও বেড়াতে যাওয়া। বিশ্রামের জন্য। যান্ত্রিক জীবনের পরিবর্তনের জন্য। গরল সমস্যা হচ্ছে, সেই সুযোগটিও অনেকের মিলছে না। কারও আর্থিক সংকটে। কারও বা অন্য কোন সমস্যায়। তবুও, মানুষ সর্বাত্মক চেষ্টা লিপ্ত। অতিষ্টময় ‘ঢাকা’ ছেড়ে কোথাও যাওয়ার। কেউ কেউ যাচ্ছেন দেশের বাইরে। এদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। বরং যাদের আর্থিক সংগতি একটু বেশী, তারাই ছুটছেন দেশ ছেড়ে। মহা আনন্দে।
মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম পবিত্র ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আযহা। সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়াতে গত মঙ্গলবার থেকেই রাজধানী থেকে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে শুরু করছেন অনেকে। পথে পথে নানা ভোগান্তি আর জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও মানুষ তাদের ঈদ যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন যানবাহন চেপে বাড়ি ফিরছে লোকজন। নানা ভোগান্তি সত্ত্বেও প্রিয়জনদের সাথে ঈদ করতে শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটছে মানুষ। বাস, ট্রেন, লঞ্চ সব বাহনেই ধারণ ক্ষমতার অধিক। ভেতরে জায়গা না পেয়ে অনেকেই ছাদে উঠতেও পিছপা হচ্ছেন না। পথে পথে নানা দুর্ঘটনায় যানজট, ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়, ফেরিঘাটে দীর্ঘ সারি। এত দুর্ভোগের পরও স্বজনদের সাথে ঈদ করার প্রশান্তি মানুষের মুখে। ঘরমুখো মানুষের স্রোত সব যানবাহনে।
দেশের অভ্যন্তরে রাজধানী ছাড়ার বাসনায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন রাজধানীবাসীর একাংশ। ঘরমুখো মানুষের চাপে দেশের সব মহাসড়কেই এখন দীর্ঘ যানজট। স্বাভাবিক সময়ের এক ঘণ্টার দূরত্ব পাড়ি দিতে কয়েকগুণ বেশি সময় লাগছে। ফলে ঈদের আগেই মহাসড়কেই ভোগান্তিতে পড়েছেন ঘরমুখো মানুষ।
যদিও চলতি বছরের ২০ জুন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, এবারের ঈদে দেশের কোথাও যানজট সৃষ্টি হবে না। চার লেনগুলোর অবস্থা এবার অনেক ভালো। এছাড়া জয়দেবপুর-এলেঙ্গা চার লেন নির্মাণ কাজের জন্য যানজট যাতে না হয় তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গাজীপুরে টঙ্গীর চেরাগআলী এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পরিদর্শনকালে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে।
শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা সেতু থেকে মেঘনা-গোমতী সেতু (দাউদকান্দি) পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া দাউদকান্দি টোলপ্লাজা থেকে শুরু হয়ে গৌরীপুর পেন্নাই এলাকা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়কে গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। গৌরীপুর তিন রাস্তার মোড়, ইলিয়টগঞ্জ, চান্দিনা, পদুয়ার বাজার এলাকাতেও যানবাহনের চাপে মাঝে মধ্যে বিচ্ছিন্ন জট তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের সড়কগুলোতে গাড়ি চলছে একেবারেই ধীরগতিতে। প্রায় পুরো রাস্তাজুড়েই ভোগান্তি পোহাচ্ছেন ঘরমুখো মানুষ।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সার্জেন্ট মো. কামারুজ্জামান রাজ জানান, মেঘনা সেতু থেকে মেঘনা গোমতী সেতু (দাউদকান্দি) পর্যন্ত গজারিয়া অংশের পুরোটা, অর্থাৎ প্রায় ১৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যানজট রয়েছে। মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার ওসি আবদুল আউয়াল জানান, যাত্রীবাহী বাসের পাশাপাশি সড়কে পণ্য ও কোরবানির পশুবাহী যানবাহনের চাপ রয়েছে। ফলে যেখানে জট নেই, সেখানেও গাড়ি দ্রুত এগোতে পারছে না। দাউদকান্দি টোলপ্লাজা, গৌরীপুর তিন রাস্তারমোড়, ইলিয়টগঞ্জ, চান্দিনা ও পদুয়ার বাজার এলাকায় যানবাহনের চাপ সবচেয়ে বেশি। যানজটের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, মেঘনা সেতুর একদিক ছেড়ে অন্য দিক বন্ধ রাখা হলে যানবাহনের জট বাঁধে। তাছাড়া টোলপাল্লাজায় কোনো গাড়ির খানিকটা দেরি হলেই কয়েকশ গাড়ি জমে যায়।
অন্যদিকে, গোড়াই মহাসড়ক থানার এলেঙ্গা ফাঁড়ির ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পার থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি রয়েছে, সামনে এগোতে হচ্ছে থেমে থেমে। রংপুর থেকে ঢাকামুখী এক বাসের চালক বলেন, দুই হাত করে আগাচ্ছি, আধা ঘণ্টা বসে থাকছি, আবার দুই হাত আগাচ্ছি। ঢাকা পৌঁছাব কখন বলতে পারছি না।
মানুষের ঈদ যাত্রায় বরাবরই পছন্দের প্রথমেই থাকে ট্রেন। ঈদে যাত্রীচাপ সামলাতে নির্ধারিত ট্রেনের সঙ্গে আরও ৬ জোড়া বিশেষ ট্রেন চলছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা নতুন বিলাসবহুল কোচ নিয়ে চলছে সিলেট রুটের পারাবত এক্সপ্রেস, দেওয়ানগঞ্জ রুটে তিস্তা এক্সপ্রেস, দিনাজপুর রুটের একতা ও দ্রুতযান এক্সপ্রেস, খুলনায় চিত্রা এক্সপ্রেস এবং বৃহস্পতিবার চালু হওয়া মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। নতুন ঝকঝকে বগিতে যারা চড়েছেন, তাদের মন একটু বেশিই প্রফুল্ল, বিশেষ করে শিশুরা।
মহাসড়কে যানজট, এই পরিস্থিতি ট্রেনের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিটি ট্রেনই ছাড়ছে উপচে পড়া যাত্রী নিয়ে। কামরার ভেতরে তো বটেই যাত্রীরা অবস্থান নিয়েছে ছাদেও। সকাল থেকেই রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশন পরিণত হয়েছে জনারণ্যে। বসার জায়গা নেই। নেই হাঁটাহাঁটির উপায়। কাঙ্ক্ষিত ট্রেনে নির্ধারিত আসনে বসাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। ভিড়ের কারণে সহজে যেতেই পারছে না যাত্রীরা। প্রবীণ, শিশু আর নারীদের বিড়ম্বনা সবচেয়ে বেশি।
ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রির ৩ দিন পর কমলাপুরে যাত্রীদের ভিড় দেখেই বোঝা গিয়েছিল শুক্রবার থেকে বাড়ি ফিরতে আগ্রহী মানুষ। সেই ধারণাই সত্য প্রমাণ হলো। সকাল থেকে কমলাপুর রেল স্টেশনে ঘরমুখো যাত্রীদের ভিড় উপচেপড়া। প্রতিটি ট্রেন ছেড়েছে যাত্রী বোঝাই হয়ে। কমলাপুরের পর যারা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে উঠার অপেক্ষা ছিলেন তাদের কয়জন এই ট্রেনে চাপতে পারবেন তা নিয়ে সংশয়ের কথা বলছেন যাত্রীরাই। তবে একদিন থেকে কিছুটা স্বস্তি আছে যাত্রীদের। সকালে যে কয়টি ট্রেন ছেড়েছে, সেগুলোর প্রায় সব কটিই ছেড়েছে নির্ধারিত সময়ে।
প্লাটফর্মে বসার আর কোন জায়গা খালি না থাকায় অনেকেই মেঝেতে বসে পড়েছেন। এর মধ্যে হাল আমলের ক্রেজ সেলফি তুলতে ব্যস্ত তরুণররা। নিজেরা তো বটেই স্বজনদের এই যাত্রার স্মৃতি ফ্রেমে ধরে রাখতে মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় চলছে ক্লিকের পর ক্লিক। আর ডিজিটাল যুগে সেসব ছবি মুহূর্তেই চলে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বন্ধু বা স্বজনরা জানতে পারছেন, প্রিয় মানুষ আসছে তাদের কাছে।
এদের অনেকের ভাষ্য, ‘জীবিকার প্রয়োজনে শহরে থাকলেও মন পড়ে থাকে গ্রামে, যেখানে শৈশব কেটেছে। ঈদ আসলে যাত্রা ভোগান্তি মেনে নিয়েই যাই সবাই। গ্রামে ঈদ করতে যাওয়ায় মনে আলাদা প্রশান্তি কাজ করে। আর এ কারণে যাত্রার পুরো পথে এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করে। তখন আর কষ্টের কথা মনেই থাকে না।’
ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে সব রকমের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ৯ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) সকালে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সারাব এলাকায় একটি পাতালপথ (আন্ডারপাস) উদ্বোধনের সময় এ কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালের সামনে কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কে ওই পাতালপথের উদ্বোধন করা হয়। মন্ত্রী বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষকে স্বস্তি দিতে সব রকমের চেষ্টা চলছে। যানজট নিরসনে পুলিশের সঙ্গে স্কাউট, কমিউনিটি পুলিশ কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীও নিয়মিত এসবের খোঁজখবর রাখছেন।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এবার ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা পুরোপুরি স্বস্তিদায়ক করতে পারবো। এমন আশ্বাস দিচ্ছি। যাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করব।’ ওবায়দুল কাদের বলেন,রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলার অভাব একটা বড় সমস্যা। কারও ধৈর্য নেই। অনেকে উল্টো পথে গাড়ি চালান। এসব কারণে মহাসড়কে যানজট আরও বেড়ে যায়। তিনি জানান, পুলিশকে বলা হয়েছে, উল্টো পথে যারাই যাবেন, তিনি মন্ত্রী হন, আর ভিআইপি হন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। তাই সড়ক-মহাসড়কে কোথাও কোনো যানজট হবে না। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া চৌরাস্তায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে মন্ত্রী এ কথা বলেন।
সড়ক পরিবহনমন্ত্রী জানান, দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হচ্ছে। কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ও মাওয়া চৌরাস্তা মিলিয়ে ৩৪টি মামলা হয়েছে এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে বড় গাড়ি রয়েছে, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা রয়েছে। রাস্তাঘাটে কোনো সমস্যা নেই উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের জানান, বর্তমানে রাস্তার কোনো সমস্যা নেই। তিনি নিজে রাস্তাঘাট পরিদর্শন করছেন। তিনি আরও জানান, যানজট হচ্ছে দুর্বল ড্রাইভের কারণে। এ ছাড়া ঈদুল আযহায় পশুবাহী ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলে এবং রাস্তায় রাস্তায় বিকল হয়ে পড়ে, এটাও যানজটের একটি কারণ। এরও আগে, গত ২০ জুন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, এবারের ঈদে দেশের কোথাও যানজট সৃষ্টি হবে না। চার লেনগুলোর অবস্থা এবার অনেক ভালো। এছাড়া জয়দেবপুর-এলেঙ্গা চার লেন নির্মাণ কাজের জন্য যানজট যাতে না হয় তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। তাই সড়ক-মহাসড়কে কোথাও কোনো যানজট হবে না বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সড়ক পরিবহনমন্ত্রী জাতিতে আশ্বস্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এবারের ঈদে যাত্রা আরামদায়ক হবে। যাত্রীরা স্বস্তিতে গন্তব্যে যেতে পারবেন। পুলিশ, স্কাউট, গাড়ির মালিক ও সাংবাদিক সবার সহযোগিতা থাকবে। ঈদুল আযহা তাদের জন্য ‘চ্যালেঞ্জিং’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি। বাস্তবতা পর্যবেক্ষণে, মন্ত্রীর ‘আশ্বাস’-কে আমরা কোনভাবেই ‘বিশ্বাস’-এ পরিণত করতে পারছি না। এর বহু প্রমাণ এবং উদাহরণ বিদ্যমান। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনটা ভুল? মন্ত্রীর ‘আশ্বাস’ না কি আমাদের ‘বিশ্বাস’করতে না পারার অপারগতা?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য