আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

নূর চৌধুরীকে ফেরত আনা: আশা এবং নিরাশার জায়গা

ফরিদ আহমেদ  

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি রাজেশ পালসহ আমার পাঁচজন ফেসবুক বন্ধু জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটা রিপোর্টের লিংক শেয়ার দিতে গিয়ে আমাকে যুক্ত করেছেন। জনকণ্ঠের সেই রিপোর্টটা নুর চৌধুরীকে  নিয়ে। এই লোক বাংলাদেশ আর্মির সাবেক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ আর্মির যে কুলাঙ্গার অংশ পচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল, নূর চৌধুরী সেই ঘাতক দলের অংশ ছিলো। শুধু যে অংশ ছিলো তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর বুকে সরাসরি গুলি চালিয়েছিলো এই লোকটাই।

পচাত্তরের পর থেকে এরা রাজকীয় হালে ছিলো। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার যাতে না হয়, সে কারণে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে রেখেছিল। শুধু তাই নয়, এই খুনিদের বিদেশে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রেখেছিল জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান এবং বিএনপির পথ অনুসরণকারী জেনারেল এরশাদ এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত খালেদা জিয়ার সরকারও একই কাজ করে। ছিয়ানব্বই সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয় এবং পচাত্তরের সেই রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই বিচারে আপিল বিভাগের রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হয়। নূর চৌধুরীও তাদের মধ্যে একজন। সেই বারো জনের মধ্যে ফারুক, রশিদ, বজলুল হুদাসহ পাঁচজনের রায় কার্যকর হয়েছে। নূর চৌধুরীসহ বাকি সাতজন নানা দেশে পলাতক অবস্থায় রয়েছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই ছিয়ানব্বই সালে নুর চৌধুরী ক্যানাডায় চলে আসে এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন জানায়। নূর চৌধুরীর সেই রাজনৈতিক আবেদন লোয়ার কোর্টে নাকচ হয়ে যায় ২০০৯ সালে। তাকে ডিপোর্ট করার আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু, নূর চৌধুরী এটাকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যায়। এখন জনকণ্ঠে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে করা সেই আবেদনও নাকচ হয়ে গিয়েছে। ক্যানাডার সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা অত্যন্ত আনন্দিত, সেটা বলাই বাহুল্য। যার একটা ছাপ পড়েছে আমাকে পাঁচ পাঁচজন মানুষ সেই খবরটাকে ট্যাগ করার মাধ্যমে। নূর চৌধুরীকে ক্যানাডা ডিপোর্ট করলেই সে বাংলাদেশের হাতে চলে আসবে, সেক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে যে ফাঁসির রায় আছে, সেটাকে কার্যকর করা যাবে। এটা নিঃসন্দেহেই আনন্দের সংবাদ। এর সাথে গত কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নূর চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনাও সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে। শেখ হাসিনাকে জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন যে, নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবার বিষয়টা খতিয়ে দেখবে ক্যানাডা।

আবেগ এবং আনন্দের অংশটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে কিছু বাস্তব কথা বলি এবার। প্রথমেই বলছি, জনকণ্ঠের রিপোর্টের কোনো উৎস খুঁজে পাইনি আমি। এধরনের রিপোর্টের ক্ষেত্রে উৎস জানাটা খুব জরুরী। তথ্যকে ভেরিফাই করার জন্য কোথা থেকে এই সংবাদ এলো সেটা জানা দরকার। আমি গুগল সার্চ দিয়েও এই সংক্রান্ত কোনো সংবাদ ক্যানাডিয়ান কোনো পত্রিকায় পেলাম না। গুগল সার্চে যা আসে, তার সবই নূর চৌধুরী বিষয়ে আগের লোয়ার কোর্টের দেওয়া ডিপোর্টেশন আদেশ সংক্রান্ত তথ্য।

তারপরেও ধরে নিচ্ছি যে, নূর চৌধুরীর রিফিউজি স্ট্যাটাসের আবেদন ক্যানাডিয়ান সুপ্রিম কোর্টে নাকচ হয়ে গিয়েছে। লোয়ার কোর্টে এটা নাকচ হয়েছে ২০০৯ সালে, সুপ্রিম কোর্টেও সেটা নাকচ হতে পারে। অসম্ভব কিছু না এটা। রিফিউজি আবেদন নাকচ হয়ে গেলে সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে ডিপোর্টেশন। নূর চৌধুরী যেহেতু বাংলাদেশের পাসপোর্ট হোল্ডার কাজেই তাকে বাংলাদেশেই ডিপোর্ট করবে। এটুকু খুবই আশাব্যঞ্জক এবং আনন্দের সংবাদ। কিন্তু, বাস্তবতা এমন নাও হতে পারে। কেন? সেটা বলছি।

ক্যানাডার সাথে সবচেয়ে বেশি বন্দি বিনিময় ঘটে আমেরিকার। দুইদেশের কমন সীমান্ত হবার কারণেই এটা ঘটে। আমেরিকায় অপরাধ করে ক্যানাডায় পালিয়ে আসা সহজ কিংবা এর বিপরীতটাও। এর আগে বহুবারই ক্যানাডা-আমেরিকা বন্দি বিনিময় করেছে। ১৯৯১ সালে চার্লস এনজি নামের একজন একাধিক খুনের আসামিকে আমেরিকার হাতে তুলে দিয়েছিলো ক্যানাডা। তার আগেও এমন খুনের আসামিকে হস্তান্তর করেছে ক্যানাডা।

এই চিত্রটা পাল্টে যায় ২০০১ সালে। দুজন ক্যানাডিয়ান নাগরিক গ্লেন সেবাস্টিয়ান বার্নস এবং আতিফ আহমদ রাফায়কে খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় আমেরিকায়। এই দুজনই পালিয়ে ক্যানাডায় চলে এসেছিল। আমেরিকা ক্যানাডাকে অনুরোধ করে তাদের আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করতে। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্ট এদের হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সুপ্রিম কোর্ট এক্সেপশনাল সারকামস্টান্স ছাড়া এক্ট্রাডিকেশনের বিপক্ষে রায় দেয় সেই মামলায়। যেখানে ফেরত পাঠালে বন্দি (ক্যানাডিয়ান হোক, কিংবা না হোক) মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হবে সেখানে তাকে পাঠানোটা ক্যানাডার সংবিধানের বরখেলাফ এই রুলিং দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ফেরত দেওয়া হবে তখনই যখন অন্যদেশ নিশ্চয়তা দেবে যে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না। এই এক্সেপশনাল সারকামস্টান্স খুবই অস্পষ্ট একটা ধারণা, ঠিক কোন পর্যায়ের কী হলে এর আওতায় পড়বে, সেটা সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট করে বলে দেয় নি। অনেকের ধারণা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত হলেই হয়তো এর আওতায় পড়বে। তাও ,সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত না। নূর চৌধুরীর কেস এক্সেপশনাল সারকামস্ট্যান্স এর আওতায় পড়বে কিনা, সেটা বলা মুশকিল। এটার প্রয়োগ আজ পর্যন্ত হয়নি।

দুই হাজার পাঁচ সালে ক্যানাডা সেকেন্ড অপশনাল প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে। এটা মৃত্যুদণ্ড এবোলিশ সংক্রান্ত চুক্তি। এখন শুধু ক্যানাডার সংবিধানই নয়, এই চুক্তির কারণেও ক্যানাডার পক্ষে কাউকে এমন জায়গায় ঠেলে দেওয়া সম্ভব নয় যেখানে তার জন্য মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষা করছে। এটা শুধু ক্যানাডা না, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্সও এই চুক্তির কারণে অনেক সন্ত্রাসীকে আমেরিকার অনুরোধের পরেও আমেরিকার কাছে তুলে দেয় নি। স্পেন নাইন ইলেভেনের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন সন্ত্রাসীকে আমেরিকার হাতে তুলে দিতে স্বীকৃতি জানিয়েছিলো। শর্ত দিয়েছিলো তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না বা মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে বিচার করা যাবে না।এখন ক্যানাডা যদি আমেরিকার চেয়েও বাংলাদেশকে বেশি গুরুত্ব দেয় সেক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশকে ভালবেসে তাদের প্রচলিত আইনকে তারা টুইস্ট করবে কিনা, সে বিষয়ে অবশ্য যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমার।

এখন তাহলে কী হতে পারে? সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে তাকে ডিপোর্ট করতে, আবার সুপ্রিম কোর্টেরই রায় আছে কাউকে এমন জায়গায় পাঠানো যাবে না যেখানে তার জন্য মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষা করছে। এই জটিলতার সমাধান হতে পারে তৃতীয় কোনো দেশে নূর চৌধুরীকে ডিপোর্ট করা, যেখানে মৃত্যুদণ্ড নেই (নিশ্চিত নই, এটা কীভাবে সম্ভব। তার পাসপোর্ট বাংলাদেশি পাসপোর্ট)। সেখান থেকে বাংলাদেশ তাকে নেবার ব্যবস্থা করবে। অথবা তাকে জেলে পুরে ক্যানাডিয়ান জেলের ভাত খাওয়ানো। এর বাইরে অন্য কিছুও থাকতে পারে। আইনের লোকেরা ভালো বলতে পারবেন সেটা। আমার আইন বিষয়ক জ্ঞান অপ্রতুল। কাজেই আমি বলতে পারছি না এই বিষয়ে কিছু। নূর চৌধুরী ক্যানাডার নাগরিক কিংবা ইমিগ্রান্ট হলে বাংলাদেশ সরকার আরো খারাপ অবস্থায় থাকতো। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, বাংলাদেশের সাথে ক্যানাডার বন্দি বিনিময় চুক্তিই নেই। নূর চৌধুরী সেটা না হওয়াতে বাংলাদেশের জন্য অনেকখানি সুবিধাই হয়ে গিয়েছে বলবো। তারপরেও, পুরো প্রক্রিয়াটা এখনও দীর্ঘস্থায়ী এবং অনিশ্চিত বলেই আমার ধারণা।

নূর চৌধুরীকে ক্যানাডা বাংলাদেশের হাতে তুলে দিলে এটা একটা বিরাট ব্যতিক্রম তৈরি হবে তাদের আইনের ইতিহাসে। সেবাস্টিয়ান বার্ন কেস যেমন একটা বেজলাইন উদাহরণ ছিলো, এটাও হয়তো তাই হয়ে দাঁড়াবে।

ফরিদ আহমেদ, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ