আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ধনীর সন্তান বনাম মধ্যবিত্ত ও গরিবের সন্তান

খুরশীদ শাম্মী  

দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি; সাধারণত মানুষের আর্থিক সচ্ছলতাকে পরিমাপ করে তাদের ধনী, মধ্যবিত্ত এবং গরিব এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। এবং ইহাকে কেন্দ্র করে মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করতেও দেখা যায় সচরাচর। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়; অর্থের আধিক্যের কারণে ধনীরা সমাজে বেশী সমাদৃত এবং  তাদের দ্বারা গরিবেরা অবহেলিত এবং নিগ্রহের শিকার। সামাজিকভাবে এই দুই শ্রেণীর অবস্থানের ঠিক মাঝখানে থেকে যায় মধ্যবিত্তরা। সম্পূর্ণ ন্যায়-নীতিবোধ এবং আর্থিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারগুলোকেই মূলত মধ্যবিত্ত পরিবার বলে চিহ্নিত করা হয়। যেখানে ধনী এবং গরিব দুই শ্রেণীর লোকই যে কোন জাতির সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তন ঘটায়, সেখানে মধ্যবিত্তরা সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। তারাই বাঁচিয়ে রাখে যে কোন দেশ এবং জাতির মূল উৎস, ভাষা, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি। প্রতিদিনের জীবনে শেকড়কে আগলে রাখতে চায় তারা। কিন্তু ধনীর মিথ্যা অহংকার এবং অনৈতিক আচরণে এই মধ্যে অবস্থিত মধ্যবিত্তরাও একটু একটু করে বদলাতে থাকে। তাই  দিনদিন ন্যায়-নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে মধ্যবিত্তদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। আর যারা এখনও মধ্যবিত্তের অবস্থানে রয়ে গেছে, তারা অপর দু’য়ের সাথে হারজিত প্রতিযোগিতায় গরিবের পাশেই থাকার চেষ্টা করে। সে কারণে বর্তমান সমাজে অধিকাংশক্ষেত্রে যে কোন বিষয়ের তুলনা হয় ধনীদের সাথে গরিব এবং মধ্যবিত্তর। ধনীরা নিজেদের উঁচুতে দেখার ইচ্ছায় সব কিছুতেই  প্রতিযোগিতা চালায়। এমনকি তাদের পরিবারে জন্ম নেয়া নিষ্পাপ শিশুরাও তাদের  প্রতিযোগিতার শিকার হয়।

বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শিশুই বেড়ে উঠে পারিবারিক বন্ধন, পারস্পরিক স্নেহ এবং ভালোবাসায়। এর ব্যতিক্রমও হয় কারো কারো জীবনে। তবে প্রতিটি মানব শিশুই জন্মগতভাবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলোর দাবী নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে শিশুটির পারিবারিক শিক্ষা এবং আর্থিক অবস্থার উপর। পাশাপাশি তার জন্মভূমির সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থানও বেশ প্রভাব ফেলে শিশুটিকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ করে গড়ে তুলতে। বাংলাদেশে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুরাও এর ব্যতিক্রম নয়।

ঘন জনবসতি পূর্ণ, উন্নয়নশীল একটি দেশ, বাংলাদেশে! অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা এখনও সম্পূর্ণভাবে স্থিতিশীল হতে পারে নি। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কালো নজর, অল্প এবং অশিক্ষিত রাজনীতিবিদদের দ্বারা আইনের অপব্যবহার, কর্মস্থলে শ্রম এবং আয়ের অসম বণ্টন। এই সকল কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের শিশুরা মূলত তাদের পারিবারিক আর্থিক অবস্থাকে কেন্দ্র করেই বেড়ে উঠে। তাদের কেউ জন্ম থেকেই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত খাবার, পানীয়, ঔষধ, কাপড়, প্রসাধনী সামগ্রী নিয়মিত ব্যবহার করে বড় হচ্ছে। উন্নত শিক্ষার উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করছে, আর চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন পারী দিচ্ছে বিদেশ। ঠিক একই সময়ে একই দেশে জন্ম নিয়ে আবার কেউ কেউ দু’বেলা ঠিকমতো খাবারও পায় না। আবার কেউ কেউ অল্প আয় এবং সরকারের ন্যুনতম সেবা গ্রহণ করে মোটা সুতি কাপড়ের দেশীয় পোশাক, তিনবেলা ডাল-ভাত খেয়ে সরকারী বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করছে।

বাংলাদেশের ধনীরা অধিক টাকা খরচ করে সন্তান লালন পালন করে আত্মতৃপ্তির একটি ঢেঁকুর দেয় এই বলে, “আমার সন্তান সর্বশ্রেষ্ঠ সেবায় বেড়ে উঠছে।” সরকারী সীমিত অনুদানে গরিবেরা কথায় কথায় কষ্ট প্রকাশ করে এই বলে যে তারা নিজেরা সন্তানদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে সক্ষম নয়। বিষয়টি অসম। এই অসম পরিবেশে বেড়ে ওঠা ধনীর সন্তানেরা কি আসলেই লাভবান হয়? কোমল হৃদয়ের শিশুদের জন্য এই উঁচুনিচু পরিবেশ কখনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না, বরং শিশুদের মধ্যে সমানভাবে প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশের বয়স মাত্র ৪৫ বৎসর। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক বাংলাদেশি শহীদ হয়েছেন, ইজ্জত হারিয়েছেন লক্ষ লক্ষ বীরাঙ্গনা। সহায় সম্পত্তি হারিয়েছেন অনেকেই। দেশের এতবড় একটা পরিবর্তনে ঐ সময়ের প্রতিটি বাংলাদেশি নাগরিকই আর্থিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এত বড় একটা পরিবর্তন, মুক্তিযুদ্ধের পর এক প্রজন্মও ঠিকমতো পার হয়নি অথচ দেশের একদল মানুষ হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐ সকল কাঁচা টাকার পিছনে ভর করে আছে কিছু দেশপ্রেমিক শ্রমিকদের অমানবিক শ্রম অথবা কারো রক্ত এবং নৈতিকতা বিক্রির কিছু গল্প। তাই ধনীদের লোক দেখানো আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুরের পিছনে থাকে আরও একটা তিক্ত ঢেঁকুর। প্রতিযোগিতায় তাদেরকে জয়ী মনে হলেও তারা হেরে যায় নিজের বিবেকের কাছে। তাদের সন্তানদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। আর মধ্যবিত্ত এবং গরিবেরা সারাদিন শারীরিক পরিশ্রম, মালিকদের দেয়া মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে সৎ উপায়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক না পেয়ে স্বল্প আয়ে সন্তানদের ভরণপোষণ করে। তারা সন্তানদের শিক্ষার জন্য পাঠায় সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায় সরকারী হাসপাতালে। আপাতদৃষ্টিতে তাদের পরাজিত মনে হলেও আসলে তারা জয়ী হয় জীবনের সত্যের কাছে। কারণ তারা সকল স্বল্পতার মাঝেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সন্তানদের ভালো এবং মন্দের পার্থক্য এবং সংগ্রামী জীবনের মহত্ব শেখাতে সক্ষম হয়। তারা মূল্য দিতে শেখে মানব জীবনের। তাদের সন্তানেরা জীবনের শুরুতেই উপলব্ধি করতে শেখে জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বারবার যাচাই বাছাই করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ন করে জীবন গড়তে। তাই তারা যে কোন পরিবেশে যে কোন অবস্থার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকে।

বেলা শেষে বিচারে বসলে মধ্যবিত্ত এবং গরীবের সন্তানদের, কেবল ক্ষুধার যন্ত্রণায় একবেলা দু’বেলা খাদ্য চুরির বদনাম ছাড়া তেমন কিছু হারাবার থাকে না। তারা সর্বস্থানে, সর্বকালের জয়ী। আর অন্যের ন্যায্য অধিকারে অন্যায্য ভাগ বসিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ধনীদের সন্তানেরা নিজেদের শ্বেত পাথরের দেয়ালের বাইরে গেলেই হারিয়ে ফেলে নিজেদের অস্তিত্ব।

আমরা শিশুদের নিষ্পাপ জীবনে এই সকল অসুস্থ প্রতিযোগিতার সমাপ্তি কামনা করি। চাই নতুন সমাজ যেখানে ধনী, মধ্যবিত্ত এবং গরিবের সন্তানেরা একই স্কুলে লেখাপড়া শিখবে, একই মাঠে খেলবে, প্রতিটি শিশু সমানভাবে বেড়ে উঠবে। 

খুরশীদ শাম্মী, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ