আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

জামাতের 'আর্ট অফ ওয়ার'

মাসকাওয়াথ আহসান  

যুদ্ধের সবচেয়ে পুরোনো কৌশল হচ্ছে প্রতিপক্ষ দলে গুপ্তচর ঢুকিয়ে দেয়া। এই গুপ্তচর প্রতিপক্ষে ঢুকে পড়ে গোপন তথ্য নিয়ে আসে, প্রতিপক্ষে নাম লিখিয়ে সেই দল সেজে এমন কিছু করে যাতে প্রতিপক্ষের সুনাম বিনষ্ট করা যায়। জামাত বাংলাদেশে এই প্রাচীন যুদ্ধকৌশলটি খুব সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করেছে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি পাকিস্তানের কট্টরপন্থীসেনা শাসক জিয়াউল হকের কাছ থেকে শিখেছে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে হয়। সেইসূত্রে জামাতের সঙ্গে তাদের গভীর সখ্য গড়ে ওঠে।

এই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশীপে জামাত শুধু পার্টনার হিসেবেই খুশী থাকেনি। কিছু লোক ঢুকিয়ে দিয়েছে যারা বিএনপিতে নাম লিখিয়ে অপকর্মগুলো করে দলটিকে ডুবিয়েছে। জাতীয় পার্টিতেও জামাতের অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। জামাত জানে তারা নিজে কখনো ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাই বিএনপি’র শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে একসময় বিএনপিকে ডুবিয়ে দিয়ে নিজেই প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠা যায় কীনা সে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।



অন্যদিকে দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের স্কলারশীপ দিয়ে পড়িয়ে বিসিএস পাশ করিয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে ঢুকিয়ে দিয়ে আরেকটি ব্রিগেড তৈরী করেছে তারা; যাতে ক্ষমতায় যেই থাকুক সরকারী চাকুরে হিসেবে তাদের লোকগুলো থাকে। সন্তর্পণে জামাতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় থাকতে পারে।

সেখানেই থেমে থাকেনি জামাত; বিএনপি-জাতীয় পার্টিকে প্রায় ঝাঁঝরা করে দিয়ে হাত বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগের দিকে। গত বিএনপি-জামাত শাসনামলে শিবিরের ছেলেদের ছাত্রলীগে ঢুকিয়ে দেয়া শুরু হয়। যেহেতু একটি পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণের মাঝ দিয়ে শিবির কর্মী তৈরী হয়; এদের অনেকে ছাত্রলীগে এসে কালক্রমে কিছু কলেজের ভিপি-জিএসও হয়েছে। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করে তাদের অনেকেই হালে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। বড় গাড়ী নিয়ে শাহবাগে এসেছে তারা মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে। বোঝার উপায় নেই এরা আসলে জামাতের লোক।

আবার যুদ্ধশাস্ত্রে নারী গুপ্তচরের ব্যবহারও অতি প্রাচীন। ইসলামী ছাত্রী সংস্থার মেয়েদের অনেককেই ফেসবুকে ছেড়ে দেয়া হয় মেধাবী তরুণদের ইনবক্সে মাঝরাতে হাই বলে ঢুকে; রাতের নিঃসঙ্গতার সুযোগে একটি রোমান্টিক ভার্চুয়াল সম্পর্ক তৈরী করে; পরে কিছু লঘু বাক্যের স্ক্রীণশট সংগ্রহ করে সমাজে তাদের ডিফেম করে তার কন্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেবার জন্য।

এখন ছাত্রলীগ অনেক বড়সংগঠন; এখানে কে ঢুকে পড়ছে কোন উদ্দেশ্যে বোঝা কঠিন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই কট্টর রিপাবলিকানরা তাদের লোকদের ডেমোক্র্যাটদের মাঝে মিশিয়ে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই রিপাবলিকানদের গুপ্তচর নিজেকে ডেমোক্র্যাট পরিচয় দিয়ে এমন হেইট স্পিচ দেয়; যা ডেমোক্র্যাটদের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় জামাতের বাঁশেরকেল্লা দেশবিরোধী জামাতী পেজ হিসেবে মার্কামারা হয়ে যাবার পর জামাত কিছু ফানপেজ তৈরী করে। যারা বেশ কিছু দিন মজার মজার পোস্ট দিয়ে লোকজনকে টানতে থাকে; কারণ মানুষ মূলতঃ কৌতুকপ্রিয়। প্রয়োজনের সময় এই ধরণের মজাদায়ী পেজ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে লস বা ক্ষতির সম্মুখীন করে সরকারের ইমেজ।

বাংলাদেশে বিভিন্ন দল ক্ষমতায় থেকেছে। ক্ষমতায় থাকলে ছাত্র সংগঠনের বাড় বেড়ে যাবার একটি প্রবণতা তো আছেই। সেই বাড় ছাত্রদলেরও বেড়েছিলো; ছাত্রলীগেরও বেড়েছে। পার্থক্য শুধু এটুকুই ছাত্রলীগের কর্মীদের অপকর্মের প্রমাণ পেলেই তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রদলে এই বহিষ্কারের দৃষ্টান্ত অপেক্ষাকৃত কম।

কাজেই আওয়ামী তার ছাত্রসংগঠনের অপরাধীদের শাস্তি ও সংশোধনের কাজটি নিয়মিত করে। এরপরেও অনেক অভিযোগ রয়ে যায়। কিন্তু জামাত যে ছেলেদের ছাত্রলীগে ঢুকিয়েছে তারা প্রশিক্ষণ অনুযায়ী সন্তর্পণে অপরাধ সংঘটন করে সরে পড়ে। তাদের শিবিরের বন্ধুরা তখন রটিয়ে দেয় ছাত্রলীগ এই অপরাধ করেছে। কারণ সেটা অর্ধেক সত্যতো বটেই; কাগজে কলমে অপরাধীরা আওয়ামী লীগার।

আবার আমাদের সমাজে ব্যক্তিগত লাভ ক্ষতির হিসাব উদগ্র। অনেকেই রাজনীতিতে আসে কিছু পেতে; কিছু দিতে নয়। ফলে কেউ আশানুরূপ মুনাফা দল থেকে না পেলে দলের নীরব শত্রু হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগে এমন লোকেরা রীতিমত নিজের নাক কেটে লীগের যাত্রানাস্তিতে সক্রিয়।

এখন আসা যাক ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে নববর্ষের নারী নিগ্রহের প্রসঙ্গে। এই উতসবের সিসিটিভি ফুটেজ বারবার পরীক্ষা করে সেখানে এক শতাংশ ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে; অন্যদিন টিএসসি বা ডাসের পিছে আড্ডা দিলেও এরকম ভীড়ের দিনে লাইব্রেরীর সামনে বা মলচত্বরে আড্ডা দেয়া। উতসবের দিন ঢাবি ছাত্ররা বাইরের অতিথিদের জন্য স্পেসটি ছেড়ে দেয়। লক্ষ্য করুন ঐ দিন নারী নিগ্রহ রোধে এগিয়ে আসা লিটন নন্দীও কিন্তু তার ছাত্র-ইউনিয়নের বন্ধুদের নিয়ে অন্যদিনের মতো দলে বলে ছিলেন না। নইলে লিটন তার বন্ধুদের নিয়ে অপরাধীদের ধরে ফেলতে পারতেন। সদলবলে না থাকায় অনেকটা একাই অশুভের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে হাত ভেঙ্গেছে তার।

ফলে বিভিন্ন আগ্রহী কর্ণার থেকে ছাত্রলীগের ছেলেদের এই নিগ্রহের দায়ে কলংকিত করার যে চেষ্টা চলছে তা একটি কালো অর্কেস্ট্রা। যত দোষ ছাত্রলীগ ঘোষ এটি যা কিছু কালো তার সঙ্গে প্রথম আলোর একটি প্রিয় ন্যারেটিভ। শিবির তাদের ন্যারেটিভে অচেনা দুর্বৃত্ত; আর অচেনা দুর্বৃত্ত তাদের ন্যারেটিভে অবধারিত ভাবেই ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগের ছেলেরা এই মুহূর্তে মেয়র নির্বাচনের ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইনে ব্যস্ত; দম ফেলার সময় নেই তাদের। নববর্ষ উদযাপনের অবসর তাদের ছিলোনা। প্রমাণ ছাড়া নববর্ষের নারী নিগ্রহের ঘটনায় ‘ছাত্রলীগে’র নাম জড়িয়ে দেয়াটা অযৌক্তিক। ঢাকা ইউনিভার্সিটি ছাত্রলীগের ছেলেরা ঐদিন ক্যাম্পাসে থাকলে তারা অবশ্যই ছাত্র-ইউনিয়নের লিটনের মত নারী নিগ্রহ প্রতিরোধে সক্রিয় হতো। ছাত্রদলের ছেলেরাও ব্যস্ত মেয়র নির্বাচনের প্রচারণায়। তারা উপস্থিত থাকলেও প্রতিরোধ করতো এই নিগ্রহ। এটাই ঢাকা ইউনিভার্সিটির ঐতিহ্য। তাই বলে এটিকে স্বর্গদাবী করাও ইউটোপিয়া। কিন্তু নববর্ষের দিনে বহিরাগতদের উতসব পালনের যে সুযোগ এই ক্যাম্পাস করে দেয়; সেখানে বহিরাগতদের অপরাধের কারণে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছেলেদের বিশেষতঃ ছাত্রলীগের ওপর অনভিপ্রেত দোষ চাপানো; সাংস্কৃতিক উতকর্ষের এই ঐতিহ্যবাহী আলোক উঠোনটিকে ডিফেম করার একটি হীন প্রচেষ্টা। আর লিটন নন্দী ছাত্র ইউনিয়ন করেন; তিনি ঢাবি’র ছাত্রলীগের ছেলেদের চেনে্ন; প্রতিদিনই তো দেখা হয়; কথা হয় তাদের সঙ্গে। লিটন যখন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলছেন, এদের তিনি চেনেন না; অপ্রত্যক্ষদর্শী গুজব সমাজের ন্যারেটিভটিই কেন লুফে নিতে হবে।



শেষ কথা
একাত্তরের শীর্ষঘাতক ও দালাল গোলাম আজমের ছেলে আযমী তার ফেসবুক স্টেটাসে লিখেছে, রবীন্দ্রনাথের নামে শাহজাদপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে দেয়া ঠিক নয়। এরপর এক ট্র্যাশ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছে রবীন্দ্রনাথ খুব খারাপ মানুষ। একজন গণহত্যার মাস্টার মাইন্ডের ছেলের মুখে রবীন্দ্রনাথের চরিত্র বিচার মানায় না। আযমী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে যথারীতি হিন্দু ধর্মের মানুষের প্রতি বিষোদগার করেছে। সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়েছে। আযমীর সক্রিয় হবার আগে হেফাজতের মাস্টার মাইন্ড শফি বৈশাখের উতসবকে হিন্দুদের উতসব হিসেবে চিহ্নিত করেছে। নববর্ষে নারী নিগ্রহের জন্য নারী পোশাক, সহ- শিক্ষা, পেশাজীবী হওয়া এগুলোর সমালোচনা করেছে। সে সৌদী আরবের মত বাংলাদেশ দেখতে চায়। এরই মধ্যে আগামী বছর নববর্ষের উতসব বর্জনের ডাক এসে গেছে ঘোলা পানির মতস্যজীবীদের কাছ থেকে। এই কন্ঠস্বরগুলো নিঃসন্দেহে নারী নিগ্রহের বেনিফিশিয়ারীদের প্রতিক্রিয়া।যে কোন অপরাধীকে খুঁজে বের করতে অপরাধ কর্মটির বেনিফিশিয়ারীকে খুঁজে বের করতে হয়। তারা নিজে এসে ধরা দিলে খুঁজে বের করার ঝামেলাটা অবশ্য কমে যায়।


মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ