আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ধর্ম ব্যবসার দুষ্টচক্র ও আমাদের বাঙালিপনা

আরিফ রহমান  

আমাদের দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটির সফট টার্গেট হিন্দু সম্প্রদায়। নাস্তিক্যবাদের সমস্ত দায় আমরা ৪৭-এর দেশভাগের পর থেকেই এই গোষ্ঠীটিকেই দিয়ে আসছি। কারো বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যেমন কুশপুত্তলিকা দাহ করে প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো হয় তেমনি নাস্তিক্যবাদীদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে দাহ করা হয় হিন্দু ঘর বাড়ি।

আসুন হিন্দু আর নাস্তিক্যবাদকে এভাবে এক লাইনে নিয়ে আসার কিছু ক্লিয়ার-কাট নিদর্শন দেখা যাক-

এক.
একাত্তর সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রখ্যাত শর্ষীনার পীর সাহেব এবং তাদের দলবল থেকে একটি ফতোয়া জারি হয়েছিলো, বিখ্যাত সেই ফতোয়ায় বাঙালি হিন্দু নারীদের "মালে গণিমত" আখ্যা দিয়ে সাচ্চা ইমানদার পাকিস্তানী ভাইদের জন্য হালাল ঘোষণা করা হয়। এই ফতোয়ার কথা উল্লেখ করা হয় দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ১৯-শে ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। এরপর সংকলিত হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল অষ্টম খণ্ডে, পীরের বাহিনী কর্তৃক লাঞ্ছিত স্বরূপকাঠির বারতী রানী বসুর বর্ণনায়।

তবে এই কৃতকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ শর্ষীনা পীর সাহেব মাওলানা আবু জাফর মো. সালেহ স্বাধীনতার মাত্র ৯ বছর পর ১৯৮০ সালে এবং ৪ বছর পর ১৯৮৫ সালে আবারো। মোট দুই দুই বার স্বাধীনতার পদক দেয়া হয়। শুধু এটুকুই নয় এই বিশিষ্ট ব্যক্তিকে একুশে পদক পর্যন্ত দেয়া হয়। ধর্মানুভূতি তো দূরের কথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনানুভূতিতেও আঘাত আসে নাই আজ পর্যন্ত। আজ পর্যন্ত বাতিল হয় নাই এই স্বাধীনতা ও একুশে পদক।

তারমানে আমরা বুঝলাম- রাষ্ট্র ১৯৭১ সালের সেই ফতোয়াকে খুব একটা ভুল মনে করে না।

দুই.
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের সময় ১২ জন পাকিস্তানী জেনারেল পরাজয় স্বীকার করে নিতে চায় নি, তাদের একজন ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেল কামাল মতিনউদ্দিন। এই লোক ছিলো প্রচণ্ড হিন্দু বিদ্বেষী একজন মানুষ।

তিনি তার অধীনস্থ বাঙালি সৈনিকদের নাম উচ্চারণ করতেন না, "বাঙাল" বলতেন। বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে তার মনোভাব ছিলো- বাঙালরা নাচ গান এবং কবিতা খুব পছন্দ করে আর ভারতের হিন্দুরা নাচ, গান ও কবিতায় পারদর্শী। এসব কারণেই বাঙালি হিন্দুরা বাঙালি মুসলমানদের ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলো। উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা এদের ভেতরে এতটাই প্রভাব ফেলেছিলো যে এরা হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মের মাঝামাঝি একটা ধর্ম পালন করতো। পাকিস্তান না টেকার পেছনে তার মতে একটা কারণই যথেষ্ট, পশ্চিম পাকিস্তানের মোসলমানেরা আসল মুসলমান আর পূর্ব পাকিস্তানের মোসলমানেরা হিন্দু।

পরবর্তীতে এই জেনারেল কামাল মতিনউদ্দিন একবার ঢাকায় এসেছিলেন, একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে। সেই কথা গর্ব ভরে লিখেছেন নিজের বইয়ের ভেতর।

কনফারেন্সের দিন ছিলো শব-ই-বরাতের দিন, তিনি দেখলেন হোটেলের টিভিতে বাংলায় শবেবরাতের ফজিলত বর্ণনা করা হচ্ছে। এরপর আজানের ধ্বনি। তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার ভৃত্যকে জিজ্ঞেস করলেন-

'প্রতিদিনই কি নামাজের সময় টিভি থেকে আজান প্রচারিত হয় এখানে...?'

ভৃত্য ক্ষুব্ধ গলায় বললো-

'আপনি এখনও বুঝতে পারছেন না যে আমরা মুসলমান, হিন্দু ভেবে আমাদের বাপ-দাদাকে আপনারা হত্যা করেছেন...'

এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন স্যারের লেখা "পাকিস্তানী জেনারেলদের মন" গ্রন্থে।

তিন.
পূর্ববঙ্গের গভর্নর মালিক ফিরোজ খান একবার বলেছিলেন-

'বাঙালি মুসলমানরা অর্ধেক মুসলমান অর্ধেক হিন্দু,
তারা মুরগীর মাংসটাও হালাল করে খায় না।'

এই অপমানে মাওলানা ভাসানী তীব্র ভাষা ব্যবহার করে বলেছিলেন-

'লুঙ্গী উঁচা করিয়া দেখাইতে হইবে আমরা মুসলমান কি না?'

চার.
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক আর মাওলানা ভাসানীর যুক্ত ফ্রন্ট যখন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ায় তখন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাদের একটি ফতোয়ায় বলা হয়েছিলো-

''যুক্তফ্রন্ট নাস্তিকের দল,
যুক্তফ্রন্টকে ভোট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটদাতার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে"

পাঁচ.
তাজউদ্দীন আহমেদ হিন্দু এবং নাস্তিক এই কথা বলে গোলাম আযম নিয়মিত কলাম লিখতেন সংগ্রামে-

"বাংলাদেশ বাঙালিদের দ্বারা শাসিত হবে এই মতবাদ শ্রী তাজউদ্দীনের"
-দৈনিক সংগ্রাম ৮ মে, ১৯৭১

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে হেলিকপ্টারে করে লিফলেট ছড়াতো-

"শ্রী তাজউদ্দীন হিন্দু্‌স্থানে গিয়া হিন্দু হইয়াছেন..."

ছয়.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনলে ধর্মনাশ হবে- এই দাবী তুলে পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার গভর্নর মোনায়েম খান রবীন্দ্র সংগীত লেখার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মুসলমান শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছিলো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাংলা বিভাগের মুসলমান শিক্ষকদের কেউই তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনকালে এবং তাদের পিতা-প্রপিতামহের জীবনকালেও একটি রবীন্দ্র সংগীত রচনা করে যেতে পারেন নি।

সাত.
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ তার 'ইস্ট পাকিস্তান টু বাংলাদেশ' গ্রন্থে শহীদ মিনারের বর্ণনা লিখেছে-

"...হাই স্কুল পেরুবার সময় আমরা দেখলাম একটা শহীদ মিনার, কোথাকার কোন ভাষা আন্দোলনের সময় নাকি ঢাকার দুই তিনজন ছাত্র মারা যায়... তারপর থেকেই হিন্দুয়ানী বাংলার প্রতিটি স্কুলে স্কুলে শহীদ মিনার গজায়। জিনিসটার একটু বর্ণনা দেই। মিনারের পাদদেশে আছে একটি কবর। প্রতিদিন সকালে মিনার প্রদক্ষিণ একটা রিচুয়াল। খালি পায়ে, হাতে ফুল নিয়ে প্রভাতফেরিতে অংশ নিতে হয়..."
-ইস্ট পাকিস্তান টু বাংলাদেশ

আট.
স্বাধীনতার এতগুলো বছর চলে গেল। একাত্তরে যেমন ঢাকা মসজিদের শহর ছিল, করাচী থেকে ঢাকায় দশগুণ বেশী মসজিদ ছিল- এখনও ঠিক তেমনি আছে। স্বাধীনতা পর বাংলাদেশে মুসলমানদের সংখ্যা যত ছিল সেটা সবসময় বেড়েছেই; কোন হিন্দুত্ববাদীর প্রভাবে বাংলার মানুষ কাতারে কাতারে হিন্দু/নাস্তিক হয়ে গেছে এমন কখনো হয়েছে বলে শোনা যায় নাই।

এসব কথা কিন্তু বাঙালিরা ঠিকই জানে। কিন্তু জানার পরেও বাঙালি এই ধর্ম ব্যবসার দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারে না। একাত্তরে যারা নাস্তিক-মালাউন কতল করতে বলতো আজও তারাই বলে। একাত্তরে রবীন্দ্রনাথকে যারা বর্জন করতে বলতো আজও তারাই বলে।

আমরা সব দেখি-শুনি-বুঝি। তারপর নিজেদের লুঙী উঁচু করে দেখি সব ঠিকঠাক আছে কি না। তারপর মাথা নিচু করে আন্দোলন ছেড়ে চলে যাই।
পাছে জাত-ধর্ম সবই যায়...
পাছে লোকে নাস্তেক বলে...
পাছে হিন্দুদের দালাল বলে...

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ছিল নাস্তিক আর হিন্দু... আমাদের মেয়েরা ছিল গনিমতের মাল... নাস্তিক আর হিন্দু বলে ওরা আমাদের তিরিশ লক্ষ মেরেছিলো... জাহানারা ইমামের আন্দোলন ছিল নাস্তিক আর হিন্দুদের আন্দোলন... আজকে মৌলবাদের বিরুদ্ধে যে কথা বলেছে সেই নাস্তিক হয়েছে, হিন্দু হয়েছে...

আরিফ রহমান, লেখক, অনলাইন এক্টিভিষ্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ