প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ফরিদ আহমেদ | ১৫ অক্টোবর, ২০১৬
এই বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন সঙ্গীত শিল্পী এবং গীতিকার বব ডিলান। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছে ১৯০১ সাল থেকে। নোবেল পুরস্কারের এই একশো পনেরো বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোন গীতিকার সাহিত্যে এই সম্মাননা পেলেন। বব ডিলানের নোবেল জয় ব্যাপক বিস্ময় হয়ে এসেছে তাই বাংলাদেশ সারা বিশ্বেই।
নোবেল কমিটি “‘মার্কিন ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতে নতুন কাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করায়”তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণা যখন স্টকহোমের সুইডিশ একাডেমির হেডকোয়ার্টারে দেওয়া হয় তখন উপস্থিত সাংবাদিক এবং অন্যান্যরা বিপুল হর্ষের সাথে এটাকে বরণ করে নিয়েছিলো। বব ডিলান যে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন মানুষ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
বব ডিলান নিঃসন্দেহে তাঁর প্রজন্মের অন্যতম সেরা একজন কবি-সঙ্গীতশিল্পী। সঙ্গীতের শক্তি এবং বাণীর আবেদন দিয়ে গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকান সঙ্গীত জগতকে সমৃদ্ধ করে আসছেন তিনি। তাঁর গান ‘ব্লোয়িং ইন উইন্ড’এবং ‘দ্য টাইমস দে আর চ্যাঞ্জিং’তো হয়ে উঠেছিলো ষাটের দশকে আমেরিকান নাগরিক অধিকার এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক।
পপুলার কালচারে ডিলানের প্রভাব অপরিসীম। গীতিকার হিসাবে তাঁর প্রভাব গত পঞ্চাশ বছরে প্রায় সব বিখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব এবং গীতিকারের উপরেই পড়েছে। বিটলস থেকে শুরু করে ব্রুস স্প্রিংস্টিন, কেউ-ই বাদ যাবে না এই তালিকা থেকে। গত কয়েক বছর ধরেই তিনি সাহিত্যে নোবেল পেতে পারেন, এই গুঞ্জন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা এটাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। তাঁদের ভাবনা ছিলো যে, শতবছরেরও বেশি প্রাচীন এই পুরস্কারটি একজন মূলত সঙ্গীতজ্ঞকে দিতে নোবেল কমিটি দ্বিধাগ্রস্ত থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা যে ভুল ছিলেন, সেটা এখন আমরা জানি। নোবেল একাডেমির পার্মানেন্ট সেক্রেটারি সারা ডানিয়াস বলেছেন, “ডিলান তাঁর কাব্যকে গানের ঢঙে পরিবেশন করেছেন।”এর সাথে প্রাচীন গ্রিসের হোমার বা সাফোর কাজের তেমন কোনো ভিন্নতা নেই বলেই সারা উল্লেখ করেছেন। এদের কাব্যকেও একসময় সংগীত হিসাবে পরিবেশন করা হতো। সারা-র ভাষ্যে, ”আমরা যদি ৫০০০ বছর পিছনে ফিরে যাই, আমরা হোমার আর সাফোকে পাব। তাদের গীতিকবিতা লেখাই হত গেয়ে শোনানোর জন্য। বব ডিলান একই কাজ করেছেন।” সারা ডানিয়াস এটাও বলতে ভোলেননি যে, এই কমিটির আঠারো জন সদস্যের প্যানেলের বেশিরভাগই বব ডিলানের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ডিলানের এই সাহিত্যে নোবেল জয় তাই খানিকটাই অপ্রত্যাশিত এবং অপ্রচলিত ধারার। এর আগে ১৯৯৭ সালে এরকম অপ্রত্যাশিতভাবেই মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন ইটালিয়ান নাট্যকার ডারিও ফো।
ডিলানের জন্ম ১৯৪১ সালে মিনেসোটাতে। এক ইহুদি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসাবে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর প্রথম তারুণ্যেই তিনি লোক সংগীতের জগতে ঝড় তুলেছিলেন। সেই সময় থেকে শুরু করে প্রতি মুহূর্তে তিনি নিজেকে পুনঃ আবিষ্কার করেছেন, বাঁক নিয়েছেন অপ্রত্যাশিত পথে। এতে তাঁর অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়েছে। কিন্তু, সময়ে তিনি আবার তাঁদের মন জয় করেছেন। এর সাথে নতুন দর্শক-শ্রোতা তৈরি হয়েছে তাঁর। তাঁর সমগ্র ক্যারিয়ারটাই এতো জটিল এবং এতো বেশি পরিবর্তন ঘটেছে রাজকীয় স্টাইলের সাথে যে ২০০৭ সালে তাঁর জীবনী নিয়ে “আই এম নট দেয়ার”নামে যে চলচ্চিত্রটি তৈরি হয়, সেখানে ছয় ছয়জন অভিনেতাকে তাঁর চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হয়েছিলো। এমনই বর্ণিল এবং বাঁক শোভিত তাঁর পেশাগত এবং ব্যক্তি জীবন। গান লেখা আর গাওয়া ছাড়াও ডিলান ছবি এঁকেছেন, অভিনয় করেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন। ১৯৭১ সালে তার লেখা গদ্য আর পদ্য নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘ট্যা রেন্টুলা’, ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘রাইটিংস অ্যা ন্ড ড্রইংস’, আর ২০০৪ সালে তার স্মৃতিকথা ‘ক্রনিকলস’।
যদিও সাধারণত তাঁকে রক মিউজিসিয়ান হিসাবেই বিবেচনা করা হয়, তিনি আসলে নানা ধরনের সংগীত দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে কান্ট্রি মিউজিক, গসপেল, ব্লুজ, ফোক, পপ এবং রিদম। এদের সবগুলোকে আলাদা করে কিংবা সবগুলোকে একত্রে বিবেচনায় নিলে আমেরিকান সংগীত এবং পপুলার কালচারের উপর তাঁর যে প্রভাব, সেটাকে অতিক্রম করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথেও বব ডিলান জড়িত হয়ে রয়েছেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে পণ্ডিত রবিশংকরের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান এবং ও জর্জ হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। প্রথম লং প্লেতে পাঁচটি গানই আছে, তবে ২০০৫ সালের ডিভিডিতে রাখা হয়েছে চারটি গান। দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর পর মানবতার কল্যাণে এরকম আরো অনেক কনসার্ট হয়েছে। কিন্তু পথিকৃৎ হয়ে আছে 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'।
বব ডিলানের এই পুরস্কারপ্রাপ্তি অবশ্য সমালোচনার ঊর্ধ্বে যেতে পারেনি। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের অনেক জায়গাতেই এই অভিযোগ উঠেছে যে, সাহিত্যের পুরস্কার অনেকটা জোর করেই একজন সঙ্গীতজ্ঞকে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য হচ্ছে, গীতিকবিতা ঠিক সাহিত্যের মধ্যে পড়ে না। বব ডিলানের নোবেল পাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। এটাকে বিচার করার মতো সাহিত্যিক জ্ঞানের সক্ষমতা আমার নেই। আমার ছোট্ট একটু বক্তব্য রয়েছে গীতিকবিতা নিয়ে। গীতিকবিতাকে সাহিত্য থেকে বাদ রাখার কারণটা আমি ঠিক বুঝি না। এটা সাহিত্যের সবচেয়ে আদিরূপ। সাহিত্য দীর্ঘকাল গীতিকবিতার কোলেই মানুষ হয়েছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যের কথাই যদি ধরেন। সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত পুরোটাই কিন্তু গীতিকবিতার একচ্ছত্র আধিপত্যের যুগ। শুধু বাংলা সাহিত্য না, পৃথিবীর প্রায় সব সাহিত্যেরই একই দশা। শুরুটা হয়েছে গীতিকবিতা দিয়েই। আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এতো গর্ব এবং অহংকার করি, যিনি এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেল বিজয়ী। সেই নোবেল আবার এসেছিলো এই সাহিত্য ক্যাটাগরি থেকেই। তাঁর নোবেল প্রাপ্তি ছিলো গীতাঞ্জলীর উপর ভিত্তি করে। যে গীতাঞ্জলীর জন্য তিনি নোবেল পেয়েছিলেন, সেই গীতাঞ্জলী কিন্তু মূলত গীতিকবিতারই সমাহার।
এই সমালোচনার বিপরীতে গিয়ে কেউ কেউ আবার বলছেন যে, ষাটের দশকে বব ডিলান আমেরিকার সামাজিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনে যে ভূমিকা রেখেছেন তাঁর সংগীত এবং গীতিকবিতা নিয়ে, তাতে তাঁর এই পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিলো বহু আগেই। সালমান রুশদি যেমন বব ডিলানের পুরস্কারপ্রাপ্তির পরে টুইট করেছেন এই বলে যে, “From Orpheus to Faiz, song and poetry have been closely linked. Dylan is the brilliant inheritor of the bardic tradition. Great choice.”
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য