প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ | ১৭ অক্টোবর, ২০১৬
আমৃত্যু ফকির লালন ছেঁউড়িয়াতেই ছিলেন। মৃত্যুর পর ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতেই তার সমাধি নির্মিত হয়। ছেঁউড়িয়াভিত্তিক লালনের জীবন-বৃত্তান্ত বিস্তৃতভাবে খুঁজে পাওয়া যায় ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ সম্পাদিত ‘লালন সংগীত’ নামক গ্রন্থে। লালন কোথায় ছিল, কীভাবে কালিগঙ্গা দিয়ে ভেসে এলে এসব বিষয়ে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা সর্বজনগ্রাহ্য নয়। কথিত আছে, গঙ্গাস্নান সেরে ফেরার পথে লালন বসন্ত রোগে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। রোগের প্রকোপে অচেতন হয়ে পড়লে সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে মৃত মনে করে রোগ সংক্রমণের ভয়ে তাড়াতাড়ি নদীতে ফেলে দেয়।
প্রায় ২১৭ বছর আগে একদিন ভোর বেলায় ষোল-সতের বছর বয়সের অচেতন অবস্থায় কিশোর লালন ভাসতে ভাসতে কালিগঙ্গা নদীর তীরে আসেন। ওই দিন ভোরবেলা মাওলানা মলম শাহ ফজরের নামাজ পড়ে কালিগঙ্গা নদীর দিকে সকালের মৃদু বাতাসে শরীর জুড়ানোর জন্য গিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন এক অচেনা সংজ্ঞাহীন কিশোর অর্ধ-জলমগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে, ছেলেটির মুখে ও শরীরে বসন্ত রোগের দাগ। তিনি কাছে গিয়ে দেখলেন ছেলেটি বেঁচে আছে, খুব ধীরলয়ে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস।
নিঃসন্তান হাফেজ মলমের বুকের ভেতর হু হু করে উঠল, এ কোনো অচেনা যুবক নয়, খোদা যেন তার সন্তানকেই ভাসিয়ে এনেছেন তার কাছে। মলম শাহ তখনই বাড়ি ফিরলেন এবং তার অপর তিন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। এবার চার ভাইয়ে ধরাধরি করে অচেনা যুবককে নিজের বাড়িতে আনলেন। মলম শাহ ও মতিজান দিনরাত সেবাযত্ন করতে লাগলেন। দিন দিন অচেনা যুবকটির মুখে জীবনের আলো ফিরে এলো। মতিজান জিজ্ঞাসা করল, বাবা তোমার নাম কী?
ফকির লালন।
কুষ্টিয়া শহরের অদূরে একটি ছায়াঘেরা নিবিড় গ্রাম ছেঁউড়িয়া। এক পাশে শান্ত নদী গড়াই, অন্য পাশে কালিগঙ্গা নদী। এখানেই বাউল সম্রাট লালন শাহের সমাধি। এই মাজারকে ঘিরে প্রতি বছর বসছে লালন মেলা। প্রতি বছর দুটি অনুষ্ঠানে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও আসেন লালন ভক্তরা। বাউল ফকিরদের কণ্ঠে সুরের মূর্ছনা তৈরি করে লালনের গান। লাখো ভক্তের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হয় লালন আখড়া।
লালনের জন্ম আসলে কোথায় তা আজও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কোনো কোনো লালন গবেষক মনে করেন, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালি থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। এই মতের সঙ্গে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন এই বলে যে, ছেঁউড়িয়া থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের ভাড়ারা গ্রামের ষোল-সতের বছরের একটি যুবক নিখোঁজ হলো অথচ তার দীর্ঘ জীবদ্দশায় কোনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিত জন কেউ তাকে চিনতে পারল না, তা হতে পারে না। ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামের মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়।
অন্যদিকে পানজু শাহের ছেলে খোন্দকার রফিউদ্দিন তার ‘ভাবসঙ্গীত’ নামক গ্রন্থে ফকির লালনের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘ফকির লালন শাহের জন্মভূমি যশোর জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার অধীন হরিশপুর গ্রামেই ছিল, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।’ লালনের জন্মস্থান সম্পর্কে লালন গবেষক ড. আনোয়ারুল করিমের ধারণাটি ছিল অনবদ্য, ‘আমি দীর্ঘ ১০ বছর লালন ফকিরের জীবনী সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করে বেড়িয়েছি। কিন্তু তার জাতিত্ব পরিচয় রহস্যাবৃত।’ আসলে লালন নিজেও তার জন্ম পরিচয় দিতে উৎসাহবোধ করেননি, তা তার গানেই স্পষ্ট।
‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের কি রূপ/ দেখলাম না এই নজরে।’ সত্যিই তাই, জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে লালন নিজেকে শুধুই মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন।
লালন হিন্দু কী মুসলমান, এ নিয়েও বিস্তর মতামত পাওয়া যায়। কারও মতে, লালন কায়স্থ পরিবারের সন্তান যার পিতা মাধব এবং মাতা পদ্মাবতী । গবেষকদের মতে, বেশিরভাগই মনে করেন লালন মুসলিম তন্তুবায়ী পরিবারের সন্তান। লালন ফকির নিজের জাত-পরিচয় দিয়ে গিয়ে বলেছেন ‘সব লোকে কয় লালন ফকির কোন জাতের ছেলে/কারে বা কী বলি আমি/দিশে না মেলে।’
রোগমুক্তির কিছুদিন পর লালন ফকির বিদায় চাইলেন, বললেন ‘আমি সংসারত্যাগী মানুষ; এই ভবসংসারে আমার ঠাঁই নেই।’ কথিত আছে, লালন অলৌকিকভাবে হেঁটে ওই সময়কার প্রমত্তা কালিগঙ্গা পার হয়ে যান। পরে অবশ্য মলম ডিঙি নৌকা নিয়ে পার হয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে লালনকে ধরে ফেলেন এবং ছেঁউড়িয়া ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যথিত হৃদয়ে অনুরোধ করেন। লালন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন, ‘যেতে পারি তবে আমার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে।’ নিঃসন্তান মলম তার প্রিয় সন্তানের কথা রাখলেন।
কালিগঙ্গা নদীর তীরে শ্যামল বৃক্ষমণ্ডিত মলমের বাগানে তৈরি হলো চৌচালা ঘর আর আখড়াবাড়ি। চৌচালা ঘরটি লালন সাধনকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতেন। কালের নিয়মে ছনের ঘরটি বিলীন হয়ে গেলেও মহান সাধক লালনের পরশমাখা সাধনকক্ষের কপাটজোড়া এবং জলচৌকি এখনও লালন একাডেমির জাদুঘরে রাখা আছে। এই আখড়াবাড়িটিই ক্রমে লালন সাধনার পুণ্যধামে পরিণত হয়।
ফজরের নামাজের পর মাওলানা মলম কোরআন তেলাওয়াত করতেন, ফকির লালন মনোযোগ দিয়ে তেলাওয়াত শুনতেন, মানে জিজ্ঞাসা করতেন। লালন কোরআনের কিছু কিছু আয়াতের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করতেন, ব্যাখ্যা শুনে মাওলানা মলম অভিভূত হয়ে যেতেন।
লালনের প্রতি অপরিসীম ভক্তি ও অনুপ্রাণিত হয়ে এক সময় মলম ও মতিজান লালনের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। মলম কারিকর থেকে হয়ে যান মলম শাহ, অন্যদিকে মতিজান হয়ে যান মতিজান ফকিরানী। ফকির মলম শাহ ছিলেন লালনের সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ শিষ্য। মলমের অপর দুই ভাই কলম ও তিলম সস্ত্রীক পর্যায়ক্রমে লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
লালনের মুখে বসন্তের দাগ ছিল, তার হাত দুটো এত লম্বা ছিল যে দাঁড়ালে আঙুলগুলো হাঁটুর নিচে পড়ত। উঁচু নাক, উন্নত কপাল আর গৌরবর্ণের লালনের ছিল গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন চোখ। কাঁধ বরাবর চুল, লম্বা দাড়ি, হাতে ছড়ি, পায়ে খড়ম, গায়ে খেলকা, পাগড়ি, আঁচলা সব মিলিয়ে লালন যেন বকে সিদ্ধপুরুষ, পরিপূর্ণ সাধক। লালন মুখে মুখেই গানের পদ রচনা করতেন। তার মনে নতুন গান উদয় হলে তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন, ‘পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে।’ লালন গেয়ে শোনাতেন, ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ সেই বাঁধা গান লিখে নিতেন।
লালনের জীবদ্দশাতেই তার গান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ফকির মানিক শাহ সেই সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন। লালনের শিষ্যদের ধারণা, তার গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এত বিপুলসংখ্যক গান পাওয়া যায় না। শোনা যায়, লালনের কোনো কোনো শিষ্যের মৃত্যুর পর গানের খাতা তাদের কবরে পুঁতে দেয়া হয়। এছাড়াও অনেক ভক্ত গানের খাতা নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি।
ছেঁউড়িয়ায় কয়েক বছর থাকার পর লালন তার শিষ্যদের ডেকে বললেন, আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, তোমরা আমার সাধনকক্ষটার দেখাশোনা করো। সপ্তাহ তিনেক পর তিনি একটি অল্পবয়স্কা সুশ্রী যুবতীকে নিয়ে ফিরলেন। মতিজান ফকিরানী জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটা কে বাবা? জানান, তোমাদের গুরুমা। একথা শোনার পর আখড়াবাড়ির সবাই গুরুমাকে ভক্তি করলেন। বিশখা নামের এই মেয়েটি সারাজীবন লালনের সঙ্গে ছিলেন। লালনের মৃত্যুর ৩ মাস পর তিনি মারা যান।
বিশখা ফকিরানী প্রায় একশ’ বছর ধরে ছেঁউড়িয়ায় ছিলেন, কিন্তু তার প্রকৃত নাম-পরিচয় জানা যায়নি। এমনকি মৃত্যুর পরও তার কোনো আত্মীয় বা পরিচিত জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অচিন মানুষ ফকির লালনের মতোই বিশখা ফকিরানী আজও এক অচিন নারী।
ফকির লালন একদিন তার সাধনঘরে একা একা বসে ছিলেন। এমন সময় খোকসা থানার কমলাপুর গ্রামের দুজন ভক্ত এসে জানালেন যে তাদের গ্রামে কলেরা লেগেছে, সেখানকার ভক্ত ফকির রহিম শাহ তার নাবালক ছেলে এবং স্ত্রীকে রেখে কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সব শুনে লালন খুব মর্মাহত হলেন। ফকির রহিম শাহের নাবালক ছেলে শীতলকে নিজের কাছে আনলেন।
বিশখা ও লালন তাকে পুত্রস্নেহে লালন-পালন করতে লাগলেন। অন্যদিকে বেশ কয়েক বছর পর ফকির শুকুর শাহ তার মাতৃহারা মেয়েকে লালনের কাছে নিয়ে আসেন, লালন সস্নেহে তাকে কোলে তুলে নিলেন এবং বিখশাকে বললেন আজ থেকে এই শিশুটিও তোমার মেয়ে। পরীর মতো সুন্দর এই মেয়েটিকে লালন পরী না বলে ‘প্যারিনেছা’ বলে ডাকতেন। ভোলাই শাহ লালনের একান্ত শিষ্যদের অন্যতম, বাল্যকাল থেকেই সে আর শীতল একই ঘরে থাকতেন। ভোলাই শাহ বড় হয়ে কোনো এক দোল পূর্ণিমার রাতে প্যারীনেছার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
ফকির লালনকে নিয়ে বেশকিছু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। একবার লালন তার শিষ্যদের নিয়ে গঙ্গা নদী পার হয়ে নবদ্বীপ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ধামে পৌঁছলেন। মন্দিরের লোকজন আগন্তুকদের বেশভূষা দেখে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। লালন শিষ্য শীতল শাহ বললেন, আমরা কুষ্টিয়া থেকে এসেছি, সবাই ফকির মতবাদের সাধক। তখন মহাপ্রভুর কাছে গিয়ে বলা হলো, কুষ্টিয়া থেকে কিছুসংখ্যক ফকির এসেছে যাদের বেশিরভাগ মুসলমান। মহা প্রভু সব শুনে তাদের বসার ব্যবস্থা করতে বললেন। আঙ্গিনার এক পাশে বড় নিমগাছের তলায় তাদের জায়গা করে দেয়া হলো।
সারা রাতের অনুষ্ঠান শেষে সাধুগুরু এবং বোষ্টমীদের সেবা দেয়ার পর যুবকরা পিতলের থালায় করে সোয়াসের চুন নিয়ে এলো এবং সবাইকে বলা হলো পাতুন, মহাপ্রভুর প্রসাদ গ্রহণ করুন। চুনে মুখ পুড়ে যাবে এই ভয়ে শিষ্যরা কেউ হাত পাতল না। বরং একযোগে ক্ষমা চাইল। যুবকরা বলল আপনারা কেমন সাধু! চুনে মুখ পুড়ে যাওয়ার ভয়ে কেউ হাত পাতলেন না। প্রকৃত সাধুদের তো মুখ পোড়ার কথা নয়! লালন এক কোনায় বসে ছিলেন, যুবকদের এই কথা শুনে বলল ‘তামরা কী চাও?’ তোমরা কেমন সাধু হয়েছ তা দেখতে চাই।
লালন যুবকদের কলার পাতা এবং একটি চাড়ি আনতে বলল। অতঃপর তিনি খানিক চুন কলার পাতায় রেখে বাকি চুন চাড়িভর্তি পানিতে গুলিয়ে দিলেন। এবার তিনি নিজেই কলার পাতার চুনগুলো খেয়ে ফেললেন এবং শিষ্যদের চাড়ি থেকে গ্লাসে করে চুনগোলানো শরবত খাওয়ালেন। তারা সবাই শরবত পানের তৃপ্তি লাভ করল। এই শরবত পান চুন সেবা নামে পরিচিত। লালন ঘোড়ায় চড়তেন, মাঝে মাঝে গভীর রাতে চাঁদের আলোতে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন, কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন তা তার শিষ্যরা কেউ বলতে পারত না।
লালন একাডেমির খাদেমকে লালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, আমার দাদাগুরু ভোলাই শাহের কাছে শুনেছি, লালন রাতের বেলায় দুধ দিয়ে খই ভিন্ন অন্য কোনো খাদ্য খেতেন না। প্রায় সারা রাত জিকির-আসকার ও ইবাদত করতেন, একটু পরপর পান খেতেন। তখন আখড়াবাড়িতে পানের বরজ এবং অনেক ঝোপজঙ্গল ছিল। ভক্তরা ভারতের গোয়া থেকে ফকির লালনের জন্য চুন নিয়ে আসত, সেই চুনে তিনি পান খেতেন। এই প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, নবদ্বীপ থেকে এখনও কিছু লালনভক্ত আখড়ায় আসে।
তাদের কাছে সে শুনেছে, নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ধামে লালন ও তার শিষ্যদের যে চুনসেবা দেয়া হয়েছিল সেই চুনসেবায় লালনের যে আসন পাতা ছিল তা এখনও সংরক্ষিত আছে। খাদেম নিজামুদ্দিনের ধারণা, হয়তো দোল পূর্ণিমার তিথিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই লালন তার জীবদ্দশায় ফাল্গুন মাসের দোল পূর্ণিমার রাতে খোলা মাঠে শিষ্যদের নিয়ে সারা রাত গান-বাজনা করতেন। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও লালন একাডেমি প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের দোল পূর্ণিমার রাতে তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসবের আয়োজন করে থাকে।
লালন চত্বর ছাড়াও আখড়ার অভ্যন্তরভাগসহ সর্বত্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা হাজার হাজার বাউল ছোট ছোট দলে সারা রাত গান করে। এছাড়াও প্রতি বছর ১ কার্তিকে লালনের মৃত্যুদিবস উপলক্ষে অনুরূপ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার বাউল যোগ দেয় ওই উৎসবে, দোল পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় বাউলরা আকাশের দিকে হাত তুলে গান ধরে... ‘এলাহি আল আমিনগো আল্লাহ বাদশা আলমপানা তুমি/ ডুবাইয়ে ভাসাইতে পারো, ভাসাইয়ে কিনার দাও কারো/ রাখো মারো হাত তোমার, তাইতে তোমায় ডাকি আমি।’
লালনের ভাবশিষ্যরা বিশ্বাস করে, শারীরিক প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে প্রকৃত শান্তি নেই; প্রকৃত শান্তি আছে স্বর্গীয় ভালোবাসায়। গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর সাধনার বিশেষ স্তরে পৌঁছলেই কেবল শিষ্যকে খেলাফত প্রদান করা যায়। লালনের অনুসারীরা বিবাহ এবং স্ত্রী সম্ভোগ করতে পারে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস, সন্তান উৎপাদনের ফলে আত্মা খণ্ডিত হয় আর খণ্ডিত আত্মা নিয়ে খোদার নৈকট্য লাভ করা যায় না। সেই কারণেই তারা সন্তান উৎপাদন থেকে বিরত থাকেন। তাছাড়া সন্তান উৎপাদনকে তারা বেদনাদায়ক বোঝা হিসেবেও বিবেচিত করেন।
বাকাবিল্লাহ ও ফানাফিল্লাহ অর্জন করার জন্য প্রয়োজন আত্মার পরিশুদ্ধতা। খেলাফত অর্জনের পর একজন সাধক সব পার্থিব বিষয় থেকে নির্মোহ হয়ে ওঠেন। পুরুষরা সাদা আলখেল্লা এবং সাদা লুঙ্গি পরে, অন্যদিকে মেয়েরা সাদা শাড়ি পরে, যাকে তারা বলে খিলকা। খিলকা হলো কাফনসদৃশ পোশাক তাদের ভাষায় জিন্দাদেহে মুর্দার পোশাক। খেলাফত প্রদানের সময় খেলাফত গ্রহণকারীকে চোখে সাদা কাপড় বেঁধে খিলকা গায়ে লালনের সমাধিকে কেন্দ্র করে সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হয়। এ সময় তারা লালনের একটি বিশেষ গান গাইতে থাকেন কে তোমারে এ বেশ-ভূষণ পরাইল বল শুনি/ জিন্দাদেহে মুর্দার বেশ /খিলকা তাজ আর ডোর কোপনী।’
লালন ফকিরের বয়স তখন ১১৬ বছর, একদিন তিনি শিষ্যদের ডেকে বললেন, এই আশ্বিন মাসের শেষের দিকে তোমরা কোথাও যেও না কারণ পহেলা কার্তিকে গজব হবে। গজবের বিষয়টি শিষ্যরা কেউ সঠিকভাবে অনুমান করতে না পারলেও আসন্ন বিপদের আশঙ্কা করতে লাগল। মৃত্যুর প্রায় এক মাস আগে তার পেটের ব্যারাম হয়, হাত-পায়ের গ্রন্থিতে পানি জমে। পীড়িতকালেও তিনি পরমেশ্বরের নাম সাধন করতেন, মধ্যে মধ্যে গানে উন্মত্ত হতেন। ধর্মের আলাপ পেলে নববলে বলীয়ান হয়ে রোগের যাতনা ভুলে যেতেন।
এসময় দুধ ভিন্ন অন্য কিছু খেতেন না, তবে ইলিশ মাছ খেতে চাইলে শিষ্যরা বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। দুপুরে সাধন ঘরের সামনে সামিয়ানা টানিয়ে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়। বিকাল থেকে শুরু করে সারা রাত লালন তার শিষ্যদের শাশ্বত বাণী শোনা, মাঝে মাঝে গাওয়া হয় তার গান। রাতে আলোচনা শেষ করে লালন সাধন ঘরে ফিরে গেলেন বিশ্রাম নিতে। শিষ্যদের বললেন, আমি চললাম।
লালন চাদর মুড়ি দিয়ে বিশ্রাম নিলেন, শিষ্যরা মেঝেতে বসে থাকলেন। এক সময় লালন কপালের চাদর সরিয়ে বললেন, তোমাদের আমি শেষ গান শোনাব। লালন গান ধরলেন, গভীর অপরূপ সুন্দর গান ‘পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে/ক্ষম হে অপরাধ আমার/এই ভব কারাগারে।’
গান শেষ হলো, চাদর মুড়ি দিয়ে চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন ফকির লালন। ফকির লালনের জন্ম সাল জানা যায়নি, তিনি ১ কার্তিক ১২৯৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান এবং তিনি বেঁচে ছিলেন ১১৬ বছর। সে হিসেবে তিনি জন্মেছিলেন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে। ছেঁউড়িয়াতে ফকির লালনের সঙ্গে তার পালিত মা মতিজান ফকিরানী, পালিত বাবা মলম শাহ, ফকির মণ্ডিত মানিক শাহ, শীতল শাহ, ভোলাই শাহ, বিশখা ফকিরানী এবং ফকির মনিরুদ্দিন শাহসহ অন্য আরও অনেক ভাবশিষ্যের সমাধি আছে।
প্রতি বছর ১ কার্তিক এখানে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার বাউল সমবেত হয়ে উদযাপন করেন তার মৃত্যুবার্ষিকী। সেই থেকে বছরের দুই সময়ে লালন আখড়ায় বসে ভক্তদের মেলা। লাখো ভক্তের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হয় লালনের সেই বসতভিটা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য