আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

বঙ্গবন্ধুর কারা-সান্নিধ্যের স্মৃতিঘেরা দুটি মাস

রণেশ মৈত্র  

বঙ্গবন্ধুকে ডাকতাম মুজিব ভাই বলে। তাঁর সাথে প্রথম পরিচয় ১৯৫৩ সালে পাবনাতে। তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সহ তখন পাবনা গিয়েছিলেন জনসভা করতে।

মুজিব ভাই ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আবদুর রব বগা মিয়ার শালগাড়িয়ার বাড়ীতে। আমি তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি। ছাত্র ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে গিয়ে তাঁর এবং মওলানা সাহেবের কাছে দাবী জানাতে যে তাঁরা যেমন উদ্যোগ নিয়ে মুসলিম লীগ বিরোধী সকল অসাম্প্রদায়িক দল নিয়ে ঐক্যবদ্ধ মৌজা গড়ে তোলেন যাতে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করা সম্ভব হয়। ঐ দিনই প্রথম পরিচয়।

অত:পর বহুবার তিনি পাবনা সফরে গেছেন এবং প্রায় প্রতিবারই তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়েছে-কথাবার্তা হয়েছে দেশের রাজনৈতিক করণীয় প্রভৃতি নিয়ে।

যখন তিনি কারারুদ্ধ হতেন তখন আমিও গ্রেফতার হতাম তবে আমি পাবনা থেকে গ্রেফতার হয়ে দিন কয়েক পাবনা জেলে থাকার পর রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলি হয়ে যেতাম। কারণ দীর্ঘ মেয়াদী জেল যাঁদের খাটতে হবে
তাদেরকে জেলা কারাগারে না রেখে নিকটস্থ কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখাই ছিলো কারা-কর্তৃপক্ষের নীতি। সে কারণে আমার ১৪/১৫ বছরের কার্য জীবনের বেশীর ভাগ সময়ই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কেটেছে রাজশাহী বিভাগের সকল জেলার রাজবন্দীদের সাথে একত্রে।

অপরদিকে বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে গ্রেফতার হতেন এবং তাঁর জেল-জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তাই কারা প্রকোষ্ঠে তাঁর সুযোগটা অবশ্য অকল্পনীয় ভাবে জুটে গেল যখন আমি ল‘ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে থেকে বদলি হয়ে গেলাম ১৯৬৬ সালে।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ঐ সময়টা অত্যন্ত ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ - বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার ও সামরিক আইন প্রত্যাহার করে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে সোচ্চার।

আগের বছর ১৯৬৫ সালে ভারত - পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ-পাকিস্তান পরাজিত ও তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে সতের দিনের মাথায় যুদ্ধের সমাপ্তি। ফলে পাকিস্তান সরকারের সামরিক শক্তি প্রশ্নবিদ্ধ এবং পূর্ব বাংলার নিরাপত্তা নিয়েও ঐ সরকার তখন সমালোচনার সম্মুখীন।

এই পরিস্থিতিতে আমাকে ঐ যুদ্ধ লাগার সাথে সাথেই গ্রেফতার করা হয় “ভারতের দালাল” হিসেবে চিহ্নিত করে। লাহোরে সরকার বিরোধী সর্বদলীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু গেলেন এবং তাঁর ছয় দফা কর্মসূচী পেশ করলেন। সম্মেলনে অংশগ্রহণ কারী অপর দলগুলি ঐ কর্মসূচীর মধ্যে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করলে বঙ্গবন্ধু ফেরত চলে এসে ঢাকায় পুনরায় ঐ ছয় দফা কর্মসূচী জনগণের সামনে পেশ করেন। ইতোমধ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের এগার দফা কর্মসূচী পেশ করলে বঙ্গবন্ধু ঐ কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানান। অত:পর বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিন, ময়মনসিংহ থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ বেশ কয়েকজন প্রথম সারির নেতা গ্রেফতার হন।

বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রেখে অপরাপর নেতাদেরকে বিভিন্ন জেলে বদলি করে দেওয়া হয়। পাবনা থেকে এক বছরেরও বেশী আগেই গ্রেফতার করে আমাকে রাখা হয়েছিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে আমি ল ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেলাম এবং কিছু দিনের মধ্যেই আমাকে সেখানে বদলি করে দেওয়া হলো।

যে সময়ের কথা বলছি তখন রাজশাহী থেকে ট্রেনে ঢাকা যেতে প্রায় দেড় দিন সময় লেগে যেতো। আগের দিন সকালে রাজশাহী থেকে রওনা হয়ে সারাদিন সারারাতও পার করে বেলা ১০-১১ টার দিকে ঢাকার তৎকালীন ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে পৌঁছালাম।

এলেন রাজবন্দীদের দায়িত্বে নিয়োজিত ডেপুটি জেলার। তিনি পূর্ব পরিচিত। কাগজপত্র রেডি করে সঙ্গে আশা পুলিশেল এসকর্ট টিমকে বিদায় দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন জেনারেল ওয়ার্ডে সমমনা বন্দীদের সাথে থাকতে চাই কি না। আমি বললাম, যদি সম্ভব হয় আমাকে পরীক্ষা পর্যন্ত সেলে রাখুন। তারপরে জেনারেল ওয়ার্ডে যাব। এখন আমাকে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য নিরিবিলি পড়াশুনা করতে হবে। তার জন্য সেলই আমার ভাল হবে।

ডেপুটি জেলার আমাকে সঙ্গে নিয়ে পুরাতন ২০ সেলে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, প্রধান গেট পর্যন্ত আমি যেতে পারব কিন্তু তার বাইরে যাওয়া বা ঐ গেট খোলা নিষিদ্ধ। কেন তা জিজ্ঞেস করিনি কারণ সেলটি যদিও সেকেলে তবুও দিব্যি নিরিবিলি পড়াশুনার জন্য ভাল। ডেপুটি জেলার চলে যাওয়ার পরে খাট, চেয়ার, টেবিল ঠিকঠাক করে স্নান করে খাটে বিশ্রাম নিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘণ্টা খানেক পরে পাহারাদার এসে ডেকে বললো, স্যার খাবার এসেছে খেয়ে ঘুমান। উঠে হাতমুখ ধুয়ে আহারাদি সেরে আবার ঘুম। কারণ রাতে ট্রেনে আদৌ ঘুমানো যায় নি। তার উপর আবার গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম।

বিকেল ৫টার দিকে হেড ওয়ার্ডার এসে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কাপড় চোপড় পরে নিয়ে মেইন গেইটের বাইরে যেতে বলায় প্রথমে বেশ খানিকটা থতমত পেয়ে গেলাম। তবুও জিজ্ঞেস করলাম হঠাৎ কি ডি.এস.বির ইন্টারভিউয়ের তলব? যা হোক তাড়াহুড়া করে মুখ হাত ধুয়ে কাপড় চোপড় পরে বাইরে বেরুতেই দেখি চোখে কালো ফ্রেমের চশমা পরে বিশাল-দেহী সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরিহিত এক হাতে চুরুট নিয়ে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে।

বিস্ময়ে হতবাক হতেই তিনি জড়িয়ে ধরে দীর্ঘক্ষণ আলিঙ্গন করলাম আপনি এই জেলে আছেন তা জানতাম - কিন্তু কোন ওয়ার্ডে তা জানা ছিল না। মুজিবভাই বললেন, এই তো আপনার জেলের ঠিক বিপরীতে এবং সামনাসামনি। তবে আজ থেকে আমার দুজন সকালে এক ঘণ্টা এবং বিকেলে এক ঘণ্টা করে এক সাথে হাঁটাহাঁটি করব-গল্পগুজব করবো। কি রাজী তো?

বললাম, আমি এসেছি পরীক্ষা দিতে পড়াশুনার সুবিধায় এই সেল নিজেই বেছে নিয়েছি। তবে সকাল বিকেলে হাঁটতে তো কোন অসুবিধাই নেই বরং জেল জীবনে এটি একটি অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত কিন্তু দুর্লভ সুযোগ এটাকে হাতছাড়া করব কেন? সানন্দে রাজী।

অত:পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন ট্রেনে চলার পথে মানুষের এই ছয় দফা এগার দফা আন্দোলন সম্পর্কে ও সরকার সম্পর্কে কেমন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম? বললাম, যতটা অনুভব করতে পেরেছে তাতে শতভাগ মানুষই সামরিক শাসন-বিরোধী এবং বাংলার স্বায়ত্ত শাসনের প্রশ্নে অনমনীয়। কিন্তু আপনার উপর অসীম আস্থা থাকলেও আপনার আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট নেতা কর্মীরা ভয়ে কাঁপছে এবং ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়। তদুপরি একটি ক্ষুদ্র অংশ ছয় দফার বিরুদ্ধে তাঁরাও মনে করেন এটা পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র মুসলমানদের স্বার্থেরও অনুকূল নয়।

অপর পক্ষে দ্বিতীয় বৃহৎ দল আমার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তখন রুশ চীন কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শগত দ্বন্দ্বের ফলে আদর্শিক প্রশ্নে বিভক্তির সম্মুখীন। তবুও রুশ-পন্থী অংশ তখনও অবিভক্ত ঐ দলের অভ্যন্তরে থেকেও ছয় দফা এগার দফা আন্দোলনের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন ঘোষণা করে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন এবং সাধ্যমত যৌথভাবে আন্দোলনে অংশও নেন। কিন্তু সংগঠনের অবধারিত শক্তিহ্রাস জনিত কারণে কোন অংশই দেশবাসীর সক্রিয় সমর্থন পেতে পারছিলেন না আগের মত। ফলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এক ধরণের শূন্যতার সৃষ্টি হওয়ায় হতাশা ক্লিষ্ট হয়ে পড়েছিল মানুষ অন্তত: সাময়িকভাবে। বঙ্গবন্ধুও বিষয়টি অনুভব করেন এবং তাঁর সাধ্য অনুযায়ী কারাভ্যন্তর থেকেই কর্মীদের উৎসাহিত কওে আন্দোলনে জোরদার ভাবে নামাতে চেষ্টা করবেন বলে জানালেন।

প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় বেড়ানোটা ছিল শুধুই হাঁটাহাঁটি নয়-সময়টা ব্যয়িত হতো সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তরিক মতবিনিময়ের। মুজিব ভাই ন্যাপের রুশ-পন্থী অংশের বিবৃতিতে স্বাগত বললেন, মওলানা সাহেব তো বাঙালি-অন্ত প্রাণ। তিনি কিভাবে ভিন্ন পথে চলে গেলেন-এটা দুর্বোধ্য। আমি বললাম, আমার ধারণা তিনি যখন চীনে যান-সেখানে মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যথেষ্ট আলোচনা হয়। চীন পাকিস্তান সম্পর্কের গভীরতার ফলে মাওয়ের পরামর্শে তিনি প্রভাবিত হন বলে আমর ধারণা। তবে চূড়ান্ত মুহূর্তে তিনি অবশ্যই বাংলার দাবীর সপক্ষে অবশ্যই উপযুক্ত ভূমিকা নেবেন বলে এখনও বিশ্বাস রাখি।

হঠাৎ একদিন মুজিব ভাই হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ছয়-দফা-এগার দফা আসলে আমার দফা নয়-আমার হলো আসলে এক দফা।” হেসে বললাম,“কী? বাংলার স্বাধীনতা?” তিনি সজোরে বললেন,“অবশ্যই এবং এটা হতেই হবে।”

আমি হঠাৎ বলে ফেললাম, “পারবেন না মুজিব ভাই”। তিনি বললেন, “কেন?” উত্তরে বললাম, “আপনার কেবলা তো আমেরিকা। ওরা কি কখনও কোন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দিয়েছে? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা করবেই বাংলার মানুষের দাবীকে। মুজিব ভাই বললেন সহাস্যে, “হ্যাঁ আমেরিকা ভায়া ইন্ডিয়া।” বললাম, “কথা একই।

ভারতের প্রশাসনে দু’টি লবি এটি আমেরিকার অপরটি রাশিয়ার পক্ষে। আপনি সত্যিই স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করতে চান দ্রুত সমাজতান্ত্রিক বিশ্বর নেতা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ করুন”। মুজিব ভাই বললেন, “দেখি তো”।

একদিন হঠাত বিশেষ অফিস থেকে শ্লিপ এলো-আমার ইন্টারভিউ; রেডি হলাম অপরদিকে জানলাম কার সাথে আমি তো কারও সাথে ইন্টারভিউ চেয়ে দরখাস্ত করিনি। যাহোক নিয়ম মাফিক detesters order সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ছুটলাম অফিসের দিকে। ঢুকেই দেখি বাঁদিকে বঙ্গবন্ধু এক মহিলা আর এক কিশোরীর সাথে কথা বলছেন।

আমাকে দেখেই বললেন,“ইনি আপনার ভাবী। আমি তাড়াতাড়ি আদাব দিয়ে শ্রদ্ধা জানালাম। পরক্ষণেই তিনি কিশোরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের মেয়ে হাসিনা-ও ইডেনে পড়ে। মেয়েকে বললেন, উনি রণেশ মৈত্র পাবনার ন্যাপ করেন- পাবনার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা। তোমার চাচা-সালাম কর। কথাগুলি শেষ না হতেই হাসিনা এগিয়ে এসে কদমবুসি করতে নিলে দ্রুত সরে গিয়ে বলি “না, তোমাকে কদমবুসি করতে হবে না। তুমি অনেক বড় নেতার মেয়ে - ভালভাবে পড়াশুনা কর-নিজেই ভবিষ্যতে বড় হবে আশা করি।”

অত:পর, আমার অপেক্ষায় থাকা বাল্যবন্ধু সদ্য ব্যরিস্টারি পাশ করে, আমি অবিলম্বে সামনে নিয়ে সালাম করি নিজে থেকেই এসেছেন দেখা করতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর বললেন,“রণেশ যেই পত্রিকায় দেখলাম তুমি বদলি হয়ে ঢাকা জেলে এসেছ তখনই ভাবলাম তোমার আটকাদেশের বিরুদ্ধে রিট করবো। তাই তোমার সম্মতি আটকাদেশ এবং সঙ্গে আনা ওকালতনামায় তোমার সই চাই।”

একথা বলতেই মুজিবভাই বলে উঠলেন, “আমিরুল ওনার কেসটা ভাল করে করো। ওনাকে বাইরে বড়ই প্রয়োজন। বলেই ভাবীকে বললেন, রিটের খরচার টাকা ফি সহ তোমার ভাবী দেবেন।” বলেই ভাবীকে বললেন দু’একদিনের মধ্যে আমিরুলকে টাকা দিতে। আমিরুল তাড়াতাড়ি বললেন, “রণেশের রিট বাবদ আমি এক পয়সাও নেব না ও আমার বাল্যবন্ধু সেই ৫৪ সাল থেকে।

অত:পর আটকাদেশ ও ওকালতনামায় সই স্বাক্ষর দিয়ে কথাবার্তা শেষে সেলে ফেরত গেলাম। রাতে দেখি ওয়ার্ডাররা নিয়ে এলো বিস্তর খাবার ভাবী দিয়ে গেছেন মুজিব ভাইকে; মুজিবভাই তারই একটি অংশ পাঠিয়েছেন আমাকে। নানা রকমের সুস্বাদু খাদ্য ও ফলমূল। সে রাতের খাবার আজও জিভে লেগে আছে যেন।

পরে একদিন বাইরে হরতাল ডেকেছে আওয়ামী লীগ-শ্রমিকলীগ। ঐ দিন আমার একটি বিষয়ে পরীক্ষা। হরতাল ন্যায়সঙ্গত দাবীতে। স্থির করলাম ঐ দিনের পরীক্ষা দেব না-হরতালের সাথে সংহতি জানিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিবের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বরাবর দরখাস্ত লিখে হেড ওয়ার্ডারকে দিলাম অফিসে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। খানিক পরে দরখাস্ত হাতে ফিরে এলেন তিনি। এসে বললেন, শেখ সাহেব এই দরখাস্ত না দিয়ে আগামীকাল পরীক্ষা দিতে বলেছেন। আমি তা না মেনে দরখাস্ত দুটি অফিসে পৌঁছে দিতে বললাম।

বিকেলে হাঁটার সময় মুজিবভাই বললেন, “পরীক্ষা না দেওয়াটা কিন্তু ঠিক হবে না। কারণ তার সাথে ভবিষ্যৎ জীবন জড়িত। বললাম মানুষ বাইরে হরতাল করবে। আপনার দলের ডাকা ন্যায়সঙ্গত হরতাল ন্যাপ তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। আমি কি করে পরীক্ষা দিতে বসবো? এটা আমার রাজনৈতিক শিক্ষা বহির্ভূত কাজ হবে। পরদিন পরীক্ষা হলো না। হরতালের কারণে পরীক্ষা স্থগিত ঘোষিত হয়েছিল।

অত:পর পরীক্ষা শেষে জেনারেল ওয়ার্ডে চলে গেলাম। মুজিব ভাই থেকে গেলেন তাঁর ওয়ার্ডে। তাঁর বিরুদ্ধে চালু হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।

কিছু দিন পর পুনরায় আমাকে বামপন্থী জেলে বদলি করে দেওয়ায় মুজিব ভাই এর সাথে সাক্ষাতের কোন সুযোগ থাকলো না। অত:পর ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। পুনরায় গ্রেফতার হলাম। মুক্তির পর এলো ৭০ এর নির্বাচনের ব্যাপকতা। তা শেষ হলে, ঐতিহাসিক একাত্তর। আর সাক্ষাত নেই মুজিব ভাইয়ের সাথে।

এলো বাহাত্তর সাল। সম্ভবত: ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু পাবনা এলেন। স্টেডিয়াম মাঠে আমরা তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে লাইন করে দাঁড়িয়েছি। প্রথম সারিতে দলীয় নেতাদের সাথে করমর্দন করতে করতে বঙ্গবন্ধুর নজর পড়লো তৃতীয় সারিতে দাঁড়ানো আমার প্রতি। ছুটে এসে কোলাকুলি কওে বললেন,“কী, বলেছিলাম না স্বাধীন বাংলাদেশ হবেই।” উত্তরে হেসে বললাম,“মুজিবভাই, আপনার কেবলায় হয় নি আমার কেবলারে সহযোগিতায় হয়েছে।

পুনরায় কোলাকুলি। ঐ আমাদের শেষ সাক্ষাত।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ