প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জান্নাতুল মাওয়া | ০৫ নভেম্বর, ২০১৬
সুনন্দার দাদার বাড়ির রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে আমরা সবাই বিজয়া দশমীর দিনের রান্নার জোগাড় যন্ত্রে কাকিমাদেরকে সাহায্য করেছি। এখন আর ওই বাড়িটাকে দুরের অন্য কারো বাড়ি বলে মনে হয়না। আমার নিজের দাদার বাড়ি থেকে কোন অংশেই এই বাড়িটা কম নিরাপদ, কম উষ্ণ না। আজকে যদি একদল সন্ত্রাসী এসে এই বাড়িতে হামলা চালায় আমি ঠিক একইরকম কষ্ট পাবো যেমন পেতাম আমার দাদার বাড়িতে কেউ হামলা করলে!
এটা সম্ভব হয়েছে কারণ তাদেরকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এখন আর আমার নিজেকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ মনে হয়না। যে কোন যুদ্ধের, সহিংসতার শুরুটা হয় বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে। বিভিন্নভাবে আমরা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন ভাবা বা আমাদেরই পাশে থাকা ভিন্ন ধর্মের ও ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদেরকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার হাত থেকে রক্ষা করতে পারি।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এবং জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে অন্য ধর্মের উৎসবে যোগ দেয়া।
‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ - এই কথাটা কেউ এমনি এমনি বের করেনি। সবাইকে ‘হিন্দু’ বা ‘খ্রিষ্টান’ বানিয়ে ফেলার জন্যেও এই কথার প্রচলন হয়নি। যেসব দেশে মুসলিমরা সংখ্যায় কম সেসব দেশেও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার লক্ষ্যে এইরকম ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ টাইপের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। গত রোজায় কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো ইফতারি করেছিলেন মুসলমানদের সাথে। সেই ছবি দেখে এই দেশের মুসলমানরাও ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলেন। খুব শেয়ার করেছিলেন ছবিগুলো। ট্রুডোকে তারা নিজেদের একজন বলে ভাবতে পেরেছিলেন। তাহলে আমাদের বোঝা দরকার, কানাডায় যেই মুসলিমরা আছেন তাদের কতটা ভালো লেগেছে এই ব্যাপারটা!
এই ইফতারিতে অংশ নিয়ে কি ট্রুডো মুসলিম হয়ে গিয়েছেন? তিনি কি একটু কম খ্রিষ্টান হয়ে গিয়েছেন? না। এই কাজের মাধ্যমে, তিনি তার দেশের সাধারণ মানুষকে শুধু একটা বার্তা দিলেন যে তোমরা সবাই মিলেমিশে থাকো। এই বার্তায় হয়তো কানাডার খ্রিষ্টানরা আলোকিত হবেন। তারা মুসলমানদেরকে জঙ্গি ভেবে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। মুসলিম প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে খাবেন । তখন ওই মুসলিম প্রতিবেশিও নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করবেনা। সবার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বোধ কেটে যাবে। বিশ্ব শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে এখন কানাডা জায়গা করে নিয়েছে, কারণ কানাডার সরকার তার দেশের কাউকেই বিচ্ছিন্ন ভাবার সুযোগ দিচ্ছেনা।
তো বাংলাদেশেও এই যে যারা ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ স্লোগান প্রচার করে তাদের উদ্দেশ্য হলো একটা শান্তিপূর্ণ দেশের অংশ হওয়া। যেখানে মানুষের পরিচয় ধর্ম দিয়ে নয় মনুষ্যত্ব দিয়ে হয়। শুধু বাংলাদেশে না সব দেশেই এমন একদল লোক আছেন যারা সম্প্রীতির পক্ষে কথা বলেন। গত বছর ঠিক এই সময়ে ভারতে গরুর মাংস খাওয়ার দায়ে এক মুসলিমকে হত্যা করে হিন্দু উগ্রবাদীরা। আর এর প্রতিবাদে জাতীয় পুরষ্কার ফিরিয়ে দেন ভারতের প্রায় ৫০-৬০ জন বুদ্ধিজীবী, এদের মধ্যে হিন্দুরাও আছেন। বিখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায় তার জাতীয় পুরষ্কার ফিরিয়ে দেয়ার পর বলেন, “আমরা এখন এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন দুর্বৃত্তরা কাল্পনিক গো-হত্যাকে অবৈধ হত্যা মনে করে খুব চিন্তিত। কিন্তু সেই কারণে একজন মানুষকে মেরে ফেলতে তাদের দ্বিধা নেই"।
ভারতের মুসলিমদের পক্ষে কথা বলায় এই লেখিকাকে এদেশের মুসলিমদের খুবই ভালো লেগেছে। তাকে নিজেদেরই একজন মনে হয়েছে। তিনি কিন্তু এখানে ধর্ম নিয়ে বাক বিতণ্ডা করেন নি, তিনি শুধু নির্যাতিতের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তো এদেশের কিছু মানুষও ঠিক এই কাজটিই করেন। নির্যাতিতের পক্ষে দাঁড়ান। তখন আবার আমাদের অনেকেরই ভালো লাগেনা, আমরা সেই মানুষগুলোকে নানান রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিই।
অরুন্ধতীও নির্যাতিতের পক্ষে বলেছেন, এদেশের বিবেকবানরাও নির্যাতিতের পক্ষে বলেছেন, অথচ দুই ব্যক্তির প্রতি আমাদের দুই রকম মনোভাবই প্রমাণ করে দেয় যে আমরা আসলে নিজের সুবিধা ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারছি না।
কাবা ঘরের ছাদের ওপর শিবমূর্তির ফটোশপ করা ছবি দেখে আমরা এতই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছি যে শত শত মানুষের মাথার ওপর থেকে ছাদ সরিয়ে দেবার খবর শুনেও আমাদের হৃদয় বিন্দুমাত্র কাঁপছে না।
এটা হচ্ছে কারণ আমরা সেই মানুষগুলোকে নিজের মত মানুষ ভাবছি না। ভাবছি অন্য কেউ। ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে ঊনমানুষ হিসেবে ভাবাটা তখনই দূর হবে যখন আমরা তাদেরকে কাছ থেকে দেখতে শুরু করবো। গত কয়েকবছর ধরে যেভাবে ভিন্ন ধর্মের উৎসবে যাওয়া তো দূর সেই উৎসবে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেও ধর্মহীন হয়ে যাবার বানোয়াট ও বিকৃত গল্প চালু করা হচ্ছে এবং এদেশের যুব সমাজ গোগ্রাসে সেই গল্প গিলছে, এটি আসলে সমাজের বৈচিত্র্যময় মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া। যে মানুষগুলোকে আগাগোড়া আধুনিকতার খোলসে দেখেছি প্রায়ই তারাও কী সুন্দর করে এই প্রচারে অংশ নিচ্ছে। যখনই আমরা আমাদের পাশে থাকা মানুষগুলোর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবো, তখনই তাদের কোন দুঃখে আমরা স্বাভাবিকভাবেই আর বিচলিত হব না।
অথচ একবার ভেবে দেখি তো যদি আমি ভারতের একটি হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে থাকতাম, আমাকে ইদের দিন আমার হিন্দু প্রতিবেশী ঈদ মুবারক বললে আমার কতটা ভালো লাগতো! সেদিন আমার ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশী আমার বাসায় বেড়াতে এলে আমার মনে কত আনন্দ হত! অথবা কানাডায় কিংবা আমেরিকায় কোন খ্রিষ্টান প্রতিবেশী আমাকে ইদের শুভেচ্ছা দিলে তিনি কি মুসলিম হয়ে যেতেন? না। বরং আমি খুশি হতাম, যে আমার প্রতিবেশী আমাকে সম্মান দিলেন। নিজের জন্যে যে ব্যাপারটিতে আমরা খুশি হই ঠিক সেই ব্যাপারটিই অন্যের জন্য করার বেলায় শত শত খোঁড়া যুক্তি হাজির করে ফেলি আমরা।
অন্যের প্রতি সহমর্মী হওয়াটা খুবই উচ্চমাপের অনুভূতি। এই অনুভূতিটা তখনই আসে যখন আমরা নিজেকে ওই মানুষটার জায়গায় বসিয়ে দিতে পারি। এই মানুষটা অন্য (other) কেউ এই শিক্ষাটা যখন আমাদেরকে গ্রাস করে রাখে তখনই আমরা আর তার দুঃখে কাতর কিংবা সুখে আনন্দিত হতে পারিনা। সব সাধারণ মানুষের মধ্যে এই অনুভূতি আশা করা যায়না। তবে এই অনুভূতি জন্মানোর চেষ্টা করা যায়। তবে অন্য ধর্মের কিংবা অন্য সংস্কৃতির মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার মত পরিস্থিতি কিন্তু চাইলেই দূর করা যায়। আর এটিই সহকর্মী হবার প্রথম ধাপ।
আগেই বলেছি এটা খুবই উচ্চমাপের একটা অনুভূতি, সাধারণ মানুষের মধ্যে তা থাকেনা। আমরা সাধারণ মানুষেরা শুধু একটা কথা মনে রাখলেই ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে যায় সেটা হলো, অন্যের প্রতি তেমন আচরণই কর যা তুমি নিজের জন্যে প্রত্যাশা কর। (Treat Others as you wish to be treated).
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য