প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রণেশ মৈত্র | ০৬ নভেম্বর, ২০১৬
এ দুঃখ রাখি কোথায়? এ বেদনা প্রকাশের ভাষাই বা কি?
গত ৩০ অক্টোবর, ২০১৬’র কথা বলছি। রয়েছি বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে-অস্ট্রেলিয়ায়। সেখান থেকে মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে চলেছি বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ক্রিকেট সিরিজ। জানতাম না ঐদিন খেলাটা অর্থাৎ শেষ টেস্ট ম্যাচটার খানিক পতন ঘটবে।
কারণ ওটা ছিল দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের শেষ ম্যাচের তৃতীয় দিন। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম ব্যাটিং করে ২৯৬ রান তুলে অল-আউট হয়ে যায় টাইগাররা। আর শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ২৭৩ রানের টার্গেট নিয়ে বীরের মত ব্যাটিং শুরু করেছিল। ২৯৬ রান তো কম নয় আবার ইংল্যান্ড প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় এবং আড়াই দিন সময় পাওয়ায় ওটা খুব একটা বেশিও নয়। তাই শঙ্কা, উদ্বেগ প্রভৃতিও কম ছিল না। এ শঙ্কার আরও বেশী কারণ হলো যে এর আগের সবগুলি খেলাতেই বাংলাদেশ হেরেছে যদিও খেলেছে ভালই। তবুও শেষ পর্যন্ত সবগুলিতে হারার ফলে মনে জোর পাচ্ছিলাম না জেতার ব্যাপারে খুব একটা।
যখন দেখলাম ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে দৃঢ়তার সাথে রান সংগ্রহে সাফল্যের সাথে মেতে উঠলো তখনকার মনের অবস্থা লিখে বুঝানো মুশকিল। কিছুটা হতাশাগ্রস্তই হয়ে পড়তে হলো এই ভেবে যে সেদিন তো বটেই পরের দুই দিনও যদি ওরা এভাবে ব্যাট করতে পারে তবে তো বাংলাদেশের হার সুনিশ্চিত। সেক্ষেত্রে কতই না অপমানের ভাষায় বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাষায় প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
কিন্তু না। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ক্রিকেটের গতিটা সহসাই ঘুরে গেল। টাইগাররা একের পর এক উইকেট নিতে থাকলো এবং সহসাই জানা গেল ইংল্যান্ড ঐ দিনটা পার করার কোন সুযোগই পেল না-তারা ১০৮ রানে তাদের জীবনে এই প্রথম বাংলাদেশের কাছে টেস্ট ম্যাচে পরাজিত হয়েছে। সে আনন্দ রাখার জায়গাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
মনের আনন্দ পরিবারের ব্যস্ত সকলকে জানালাম। কিন্তু হঠাৎ করেই টিভি পর্দায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার হৃদয় বিদারক খবরের অতি সংক্ষিপ্তসার দেখলাম-মনটা ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল যেন। কোন চ্যানেল বা অনলাইন পত্রিকাই সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিংস্র ঘটনাবলী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারল না। তাই বাধ্য হয়েই পরদিন ৩১ অক্টোবরের পত্র-পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতে হলো। সকালে উঠে দেখি বিডি নিউজ ২৪.কম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দির-ঘরবাড়ী ভাংচুর-লুটপাট। শিরোনামে জানাচ্ছে: “ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে ১৫ টি মন্দির ভাঙ্গা হয়েছে, ভাংচুর-লুটপাট করা হয়েছে হিন্দুদের শতাধিক ঘর।”
আরও বলা হয়, রোববার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত নাসির নগরের এই তা-বের পর পাশের জেলা হবিগঞ্জের মাধবপুরেও দুটি মন্দিরে হামলা হয়েছে।
এই ঘটনার পর পাশাপাশি দুটি উপজেলা সদরে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত নানা বাহিনী সহ বি.জি.বি’ও মোতায়েন করা হয়েছে, কিন্তু ঘটনাসমূহ এমনই আকস্মিক, এমনই ব্যাপক ও ভয়াবহ ছিল যে আতংক কিছুতেই কাটছে না সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলির হিন্দু অধিবাসীদের মন থেকে।
ইসলামী ঐক্য জোটের নেতা প্রয়াত ফজলুল হক আমিনীর এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসলামী দলগুলো বেশ সক্রিয়। এই বছরের শুরুতে এবং মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ তা-ব সংঘটিত হয়েছিল নাসির নগরে অক্টোবরের শেষে এসে পুনরায় একই তা-ব প্রত্যক্ষ করা গেল। উল্লেখ্য, ঐ ঘটনায় যে ব্যাপক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল তাতে হিন্দুদের বহুসংখ্যক বাড়িঘরের সাথে সুর-সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গীতাদর্শন, উদীচী কার্যালয়, পাবলিক লাইব্রেরীর অসংখ্য ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে এবং ২০১৪ সালে পাবনা জেলা বনগ্রামে ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার তথাকথিত অভিযোগ তুলে বৌদ্ধ ও হিন্দু বসতিগুলিতে ও তাঁদের মন্দিরগুলিকে যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলা ঘটানো হয়েছিল-নাসির নগরের এই ঘটনা অতীতের ঘটনাগুলিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। অভিযোগে জানা যায় বিগত শুক্রবারের নাসির নগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণকেন্দ্র গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেইসবুকের পাতায় একটি পোষ্ট নিয়ে এই ঘটনার সূত্রপাত।
ফেইসবুকে রসরাজ ইসলাম অবমাননা করে পোষ্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠার সাথে সাথেই পুলিশ রসরাজকে শনিবার গ্রেফতার করে এবং তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশ জানায়। ঐ ঘটনা নিয়ে “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত” ব্যানারে রোববার বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয় নাসির নগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে। হবিগঞ্জের মাধবপুরেও ডাকা হয় অনুরূপ কর্মসূচী।
এ ছাড়া রসরাজের শাস্তির দাবীতে একদল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব চত্বরে বিক্ষোভ দেখায়। আর কয়েকশ লোক সরাইল-নাসির নগর লাইন সড়ক অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, অবরোধ থেকে একদল লোক দেশী অস্ত্র নিয়ে নাসির নগর সদরের দত্তবাড়ির মন্দির, নমশুদ্র পাড়া মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, ঘোষপাড়া মন্দির, গৌরমন্দির গুড়িয়ে দেয়। উপজেলা সদরের দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া, মহাকাল পাড়া, নমোশুদ্রপাড়া, মালিপাড়া, শীলপাড়ায়ও ব্যাপক হামলা করে নির্দোষ নিরপরাধ হিন্দুদের প্রায় ২০০ বাড়ী-ঘর বিধ্বস্ত ও লুটপাট করা হয়েছে। হিন্দু নারী পুরুষ নির্বিশেষে বেশ কয়েকজনকে অস্ত্রের আঘাতে আহত করা হয়েছে।
পূজা উদযাপন পরিষদের নাসির নগর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক হরিপদ পোদ্দার বলেন,“১০-১৫ টি মন্দিরের পাশাপাশি দেড়শ’র বেশী বাড়ী-ঘরে হামলা চালানো হয়েছে। এ সময় কয়েকজন পূজারীসহ অন্তত: ২০ জন আহত হন বলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা সভাপতি আদেশ দেব জানান। তিনি বলেন, ছোট বড় মিলিয়ে ১৫টি মন্দির ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে।
উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল জ্যোতি দত্ত বলেন, “শত শত লোক অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় কিছু মুসলিম যুবকও আহত হয়। সুব্রত সরকার নামে একজন বলেন,“আমার বাড়ীতে ঢুকেই প্রথমে মারধর শুরু করে। মন্দিরে ভাংচুরের পাশাপাশি তারা মূল্যবান জিনিষপত্র নিয়ে যায়।”
প্রদীপ দাস নামে একজন বলেন, তার ভাই মানিক দাসের একমাত্র সম্বল মাছধরার জালটিও পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা-তৈরি করা হচ্ছে বলে জেলা প্রশাসক জানান। স্থানীয়রা জানান, হামলাকারীরা বেশীর ভাগই যুবক বয়সের এবং তাদের পরনে ছিল প্যান্ট শার্ট। পরবর্তীতে দুই দিনে মোকদ্দমা দায়ের হয়েছে দু’তিনটি অজানা ১২০০ জনের বিরুদ্ধে এবং ৮জন গ্রেফতারের খবর জানা গেছে। ঘটনা কারা ঘটালো, কারা নেপথ্যে ঠাণ্ডা মাথায় এমন ঘটনা ঘটাতে লোকজন অস্ত্রপাতি জোগাড় করে পাঠালো তার কোন হদিস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তবে আহলে সুন্নাত ওয়ালা এ ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামকে দায়ী করে তাদের শাস্তি দাবী করেছেন। অপর পক্ষে পুলিশ সুপার বলেছেন, তদন্ত না করেই , যে জামায়াত-শিবির এমন ঘটন ঘটিয়েছে সরকারকে বিব্রত করার লক্ষ্যে। এই দুই বক্তব্যের কোনটি সত্য-নাকি উভয় বক্তব্যই সত্য-নাকি আহলে সুন্নাত ঘটনার পেছনে ইন্ধনদাতা হিসেবে কাজ করেছে তা নিখুঁতভাবে তদন্ত করে সকল অপরাধীকে গ্রেফতার করে বিচার ও সকল অপরাধীর কঠোর শাস্তিদানে বিন্দুমাত্র অবহেলা গ্রহণযোগ্য হবে না।
তবে প্রশ্ন করা যেতে পারে:
আরও অনেক কিছু বলা যায়। যেদিন পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে “বিসমিল্লাহ্” “জামায়াত ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির বৈধতা প্রদানে এবং “ইসলাম”কে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বর্তমান সরকার সংবিধানভূক্ত করলো উগ্র ধর্মান্ধরা তখন বুঝে নিল-দেশটি মুসলমানের। তাই হিন্দু-বৌদ্ধ- খৃষ্টানদের বিতাড়ন বা তাদেরকে নির্যাতন কোন অবৈধ ব্যাপার নয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের সর্বশেষ ঘটনাবলী সরকারকে যে আরও একবার বুড়ো আঙুল দেখানো সরকার কি তা বুঝবেন?
দাবী করি অবিলম্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করুন। অথবা ব্যর্থতার দায়ে তাঁকে পদচ্যুত করা হোক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য