প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ফরিদ আহমেদ | ০৬ নভেম্বর, ২০১৬
গত ২৮ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার হরিণবেড় গ্রামের এক প্রায় অশিক্ষিত রসরাজ দাসের ফেসবুকে একটা আপত্তিকর ছবি পোস্ট হয়। এতে দেখা যায়, মুসলমানদের পবিত্র কাবা শরিফের উপর হিন্দুদের দেবতা শিব বসে আছে। এই ছবিটা এলাকায় চাঞ্চল্য এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীরা রসরাজকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে দেয়। পবিত্র কাবা শরীফ অবমাননার করে আপত্তিকর ছবি পোষ্ট করার প্রতিবাদে ও তার ফাঁসির দাবিতে উপজেলা ও জেলায় বিক্ষোভ মিছিল হয়। রসরাজ দাবি করেছে যে, সে এই ছবি পোস্ট করেনি। ফটো এডিটিং করার মতো জ্ঞান তার নেই। তার একাউন্ট হ্যাকড হয়েছে।
ঘটনা এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে অসুবিধা ছিলো না। কিন্তু, এখানেই এর সমাপ্তি ঘটে না। রসরাজ গ্রেফতার হওয়ার পরও একটি সংঘবদ্ধ চক্র জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খবর ছড়িয়ে দিয়ে গত ৩০ অক্টোবর রোববার সকাল থেকে নাসিরনগর উপজেলা সদরের কলেজ মোড় এবং খেলার মাঠে একাধিক ইসলামী দলের নেতাকে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠেছে, তিনি যেহেতু গ্রেফতার হয়েছেন তাই নতুন করে সমাবেশ ডাকার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা না করে উল্টো স্থানীয় প্রশাসন বিক্ষোভ সমাবেশের অনুমতি দিয়ে পরিস্থিতি আরো বেশি ঘোলাটে করে। শুধু তাই নয়, নাসিরনগর হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ সমাবেশে উপস্থিত থেকে বক্তৃতা দেন বলে অভিযোগ ওঠে। তার সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা।
অভিযোগ ওঠে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সমাবেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পর সমাবেশ চলাকালে হঠাৎ তিন থেকে চারশো লোক সংঘবদ্ধ হয়ে এ ঘটনার জন্য হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর চড়াও হয়ে নির্বিচারে নিরীহ পুরো উপজেলা সদরের হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবারের মন্দির ও বাড়িঘর এবং বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালায় ও ব্যাপক লুটতরাজ করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর ও ব্যাপক লুট করে। তাদের হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন আহত হন। শুধু তাই নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোকে বাঁচাতে গিয়ে বেশ কয়েকজন মুসলিমও আহত হন। নাসিরনগরের সংখ্যালঘুরা নেতারা বলেছেন, ঘটনার আগের দিন এলাকায় মাইকিং করে পরদিন হামলা করা হয়। ঘটনাটি নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারা সময়মতো ব্যবস্থা নেননি। এর ফলে সহিংসতা বেশি হয়েছে। এদের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত এবং সর্বস্ব হারানো সংখ্যালঘুদের বিলাপে ভারি হয়ে এসেছে নাসিরনগরের আকাশ এবং বাতাস।
এই সহিংসতার মধ্যেই সরকারের এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের একটা অভিযোগ উঠে আসে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক স্থানীয় এমপি। ঘটনা ঘটার পরে তিনি ঢাকা থেকে নাসিরনগরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি পরিস্থিতি সামাল দেবেন, এটাই সবার প্রত্যাশা ছিলো। কিন্তু, ঘটনা ঘটেছে উল্টোটা। নাসিরনগরের ডাকবাংলোতে স্থানীয় সংখ্যালঘু নেতাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘মালাউনের বাচ্চারা বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। আর এ ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে অতিরঞ্জিত করেছে সাংবাদিকরা। অথচ ঘটনা কিছুই নয়।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করে ভোরের কাগজকে বলেন, ফেসবুকে ফেইক জিনিস দিয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হামলাটি ঘটেছে এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের নীরব থাকার কারণে হিন্দুরা মার খেয়েছে। আক্রান্ত হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীকে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, নাসিরনগরের সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী গত মঙ্গলবার রাতে নাসিরনগরে এসেছেন। কিন্তু আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনে যাননি। বরং সংখ্যালঘু নেতাদের ‘মালাউনের বাচ্চা’বলে গালি দিয়ে দেখে নেবেন বলে জানান।
সরকারের একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের প্রতি সাম্প্রদায়িক এবং ঘৃণ্য মন্তব্য করার অভিযোগ এই প্রথম। এই ধরনের সাম্প্রদায়িক শব্দ আমাদের দেশে অনেকেই ব্যবহার করে। কেউ বুঝে করে, কেউ বা না বুঝে করে। কিন্তু সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে, সরকারের উঁচু স্তরে থাকা দায়িত্বসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ঘৃণ্য মন্তব্য একেবারেই অপ্রত্যাশিত, অপ্রীতিকর এবং অবাঞ্ছিত। ফলে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই তাণ্ডব ছাপিয়েও তাঁর মন্তব্যই বেশি আলোচিত হচ্ছে মিডিয়া জুড়ে। তিনি যদি সত্যি সত্যি এমনটা বলে থাকেন, তবে অবশ্যই এটি একটি গভীর আশংকা এবং আতংক আমাদের জন্য। এমনিতেই আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের নানা উৎপাত সহ্য করে, নানা বিপদ মাথায় নিয়ে চলতে হয়। এখন যদি সরকার এবং প্রশাসনও তাদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী মন্তব্য বা গালি ঢেলে দেয়, তবে তাদের আশার শেষ সীমাটাও গুঁড়িয়ে যায়। ইতোমধ্যে মন্ত্রী অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে আনিত এই অভিযোগকে অস্বীকার করেছেন।
কিছু কিছু শব্দ থাকে, যেগুলোর জন্ম হয় খুব নিরীহভাবে। কিন্তু, এক পর্যায়ে গিয়ে সেগুলো পরিণত হয় ভয়ংকর বর্ণবাদী শব্দ বা গালি হিসাবে। এই যেমন ধরুন ‘নিগার’শব্দটা। এটা একটা ল্যাটিন শব্দ নিগার থেকে এসেছে। এর অর্থ কালো। সরাসরি অবশ্য ল্যাটিন থেকে এসেছে বললে ভুল হবে। ল্যাটিন নিগার এই বিশেষণটির স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ বিশেষ্য হচ্ছে নিগ্রো। এই নিগ্রো থেকেই ‘নিগার’শব্দের উৎপত্তি। শুরুর দিকে এটা একটা নিরীহ এবং নিরপেক্ষ শব্দ ছিলো। কালো মানুষদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে মানুষের মনের তীব্র ঘৃণা মিশে যায় এতে। শব্দটা হয়ে পড়ে দূষিত এক বর্ণবাদী শব্দে। পাশ্চাত্য বিশ্বে এখন এটা একটা নিষিদ্ধ শব্দ। কেউ উচ্চারণ করলেই তার জেল-জরিমানা হয়ে যাবে। আমাদের বাংলাতেও 'মাগি' বলে একটা শব্দ আছে। এটা মেয়েদেরকে দেওয়া একটা গালি। অথচ এই শব্দটা উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে অহরহ ব্যবহৃত এক শব্দ। নারী শব্দের খুব প্রচলিত একটা প্রতিশব্দ ছিলো এটা। মাগ মানে পুরুষ, এর স্ত্রীবাচক শব্দ ছিলো মাগি। এখন এই শব্দটা নারীদের প্রতি পুরুষের ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান সবসময় সুখকর ছিলো না। এরা মিলেমিশে থেকেছে, আবার একে অন্যকে সন্দেহের চোখেও দেখেছে, আলাদা করেও ভেবেছে। বাংলা অঞ্চলে একসময় হিন্দুরা মুসলমানদের ‘নেড়ে’’বলে ডাকতো। শরৎ চন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসেই মুসলমানদের ‘নেড়ে’বলে ডাকার উদাহরণ আছে। হিন্দুরা কিন্তু শুরুতে ‘নেড়ে’ বলতে মুসলমানদের বোঝাতো না। হিন্দুদের প্রথম সংঘাত শুরু হয়েছিলো বৌদ্ধদের সাথে। মুসলমানরা তখনও এখানে পা দেয়নি। কিংবা দিলেও সংখ্যায় ছিলো অপ্রতুল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মাথা ন্যাড়া করে রাখে বলে বৌদ্ধদের গালি দিতে তারা 'নেড়ে' শব্দটাকে ব্যবহার করতো। সেই 'নেড়ে' শব্দটাই, হিন্দুদের প্রতিপক্ষ হিসাবে বৌদ্ধরা সরে গিয়ে মুসলমানরা চলে আসাতে, মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য হয়ে যায়। মুসলমানদের ‘যবন’বলে ডাকারও প্রচলন ছিলো। আগে 'যবন' শব্দটা বিদেশি আক্রমণকারীদের (খুব সম্ভবত গ্রিক আক্রমণকারীদের যবন বলা হতো) বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। সেই শব্দটাই পরে মুসলমানদের জন্যও ব্যবহার করা শুরু হয়। যেনো ভারতীয় মুসলমানরা ভারতের কেউ না, এরা সব বিদেশি আক্রমণকারী।
এইসব শব্দ, যেগুলো উল্লেখ করলাম, সেগুলো শুরুতে নিরীহ বা নির্বিবাদী শব্দ ছিলো। পরবর্তীতে তা মানুষের ঘৃণার দিয়ে আবৃত হয়ে বিষাক্ত শব্দে পরিণত হয়েছে। কিন্তু, বাংলা অঞ্চলে একটা শব্দ শুরু থেকেই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। আজো তা। এই শব্দটা সাম্প্রদায়িক মুসলমানরা হিন্দুদের জন্য বরাদ্দ করে রেখেছে। শব্দটা হচ্ছে মালাউন। এখন এটা সংক্ষেপে মালুও হয়ে গেছে। মালাউন আরবি শব্দ। এর মানে হচ্ছে অভিশপ্ত। মূলত ইবলিশ শয়তানকে বোঝানোর জন্য মালাউন শব্দটা ব্যবহার করা হয়। ইবলিশ হচ্ছে আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত। সেই মালাউন শব্দটাকে ভারতীয় মুসলমানরা বিশেষ করে বাংলার মুসলমানরা নিয়ে আসে হিন্দুদের জন্য। আগে কম ব্যবহৃত হতো শব্দটা আমাদের সমাজে। এখন বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। মালাউন, বা মালাউনের বাচ্চা এখন একটা অতি ব্যবহৃত গালি বাংলাদেশে। এর সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে পশু সম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের হিন্দুদের 'মালাউনের বাচ্চা' ডাকার মাধ্যমে।
একজন হিন্দুকে যখন মালাউন বলে ডাকা হয়, তখন একজন কালোকে নিগার ডাকলে যে অনুভূতি হয়, তার সমান অনুভূতি হয় তার। কিন্তু, সেটা বোঝার সক্ষমতা আমাদের সকলের আছে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে আমার। অন্যের অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করা, অন্যকে সম্মান দেওয়া, আমাদের সমাজের সংস্কৃতি না। এগুলো আমরা মুখে মুখে বলি, কাগজে লিখি, কিন্তু বাস্তবে অনুশীলন করি না। বাস্তবে বরং অন্যকে অপদস্থ করে, অন্যকে বাজে কথা বলে, অন্যকে গালি দিয়ে, অন্যদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মনের মাঝে প্রবল সুখ এবং অপরিসীম আত্মতৃপ্তি পাই। একজন কালো মানুষকে নিগার বলে কেউ ডাকলে, এর বিরুদ্ধে সে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। পুলিশ ডাকতে পারে কিংবা আদালতের কাছে যেতে পারে। বাংলাদেশের একজন হিন্দুর মালাউন গালি শুনেও নিশ্চুপ থাকতে হয় নতুবা মুখে হাসি ধরে রেখে কিছু হয়নি এমন অভিনয় করে সরে পড়তে হয়।
এই সব ঘৃণামূলক, জাতি-বিদ্বেষমূলক শব্দগুলোকে সারা বিশ্ব যেখানে ক্রমে ক্রমে নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে, আমরা সেখানে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এগুলো বলে সাধারণ মানুষকেও উৎসাহ দিয়ে চলেছি। শেখ হাসিনা সরকারের উচিত হবে মন্ত্রী ছায়েদুলের এই কর্মকাণ্ডের বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা। তিনি যদি এই বর্ণবাদী মন্তব্য করে থাকেন, তবে অবশ্যই তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে। আশংকিত এবং উদ্বিগ্ন মানুষকে এই মেসেজ দিতে হবে যে, সরকার এই সব জাতি-ঘৃণা বা জাতি-বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেয় না। তার কাছে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই। প্রতিটা মানুষই এই দেশের নাগরিক, সবারই সমান অধিকার রয়েছে এই মাটি। ধর্ম-বিশ্বাস যার যার, কিন্তু বাংলাদেশটা সকলের।
কথা হচ্ছে, সেই শুভ বুদ্ধি কি এই আওয়ামী লীগ সরকারের আছে?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য