প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসুদ পারভেজ | ১৬ নভেম্বর, ২০১৬
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া অনেকাংশে ছিল প্রান্তিক পর্যায়ের সাদামাটা তরুণ। তাদের ছিল নিখাদ দেশপ্রেম। কোন ধরনের সমীকরণের তোয়াক্কা না করে প্রতিটি অভিযানে এসব তরুণদের অগ্রযাত্রায় স্বাধীনতা তরান্বিত হয়েছিল অনেকখানি। মুক্তিযুদ্ধের সামান্যতম একটা অংশকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এমন অনেকে ছিলেন যারা বীরত্বে অন্য যে কারো চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। স্বীকৃতি না পেলেও এদের বীরত্বে ভাস্বর এসব সাহসী প্রাণগুলো। যদিওবা আমাদের কাছে প্রত্যেক যোদ্ধাই একেক জন বীরশ্রেষ্ঠ।
জগৎজ্যোতি, তেমন একজন বীর। মুক্তিযুদ্ধের অনেক সফল অভিযানের নিউক্লিয়াস এই তরুণের জন্ম ১৯৪৯ সালে। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জে কলেজের ছাত্র। ছাত্র থাকাকালে তিনি গেরিলা দলে যোগ দেন। গেরিলা যুদ্ধের জন্য মনোনীত ১১৪ জনের প্রথম দলে ছিলেন জগৎজ্যোতি।
৩২ দিনের কলাকৌশল তিনি সাফল্যের সাথে সমাপ্ত শেষে টেকেরঘাট সাব- সেক্টর হেড কোয়ার্টারে ৪২ জনের দলের নেতৃত্ব পান। এই দলটি “দাস পার্টি” নামে পরিচিত পেয়েছিল। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের কিছু এলাকা নিয়ে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের আওতাধীন ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু ও অতর্কিত আক্রমণে ঠিকতে না পেরে পাকবাহিনী জলপথ ব্যাবহার করা শুরু করেছিল। শত্রুসেনাদের জলযান ডুবানোর দায়িত্ব পায় “দাস পার্টি”। কার্গো
নৌযানের বহর ডুবিয়ে দেওয়া সহ ডুবিয়ে দেওয়ার নতুন কৌশল আবিষ্কার করে জগৎজ্যোতি পাক সেনাদের তটস্থ করে রেখেছিলেন। পানিতে ডোবানো খুঁটিতে বাঁধা দড়িতে মাইন ঝুলিয়ে নৌযান ধ্বংসের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে একের পর এক কার্গো-ভেসেল ডুবাতে থাকেন জগৎজ্যোতি। এভাবে অসংখ্য সফল অপারেশন চালিয়েছিল দাস পার্টি, যার অগ্রভাগে ছিল জগৎজ্যোতি। বানিয়াচং থানা দখল, পাহাড়পুরে হানাদার বাহিনীকে অ্যামবুশ, বদরপুরে ব্রিজ ধ্বংস, জামালগঞ্জ থেকে পাক সেনা রাজাকার বিতাড়ন, তাহিরপুর আক্রমণ, খালিয়াজুড়ি থানায় হামলা ইত্যাদি অন্যতম। সবগুলোর দলনেতা ছিলেন জগৎজ্যোতি। নতুন নতুন উদ্ভাবন পদ্ধতি আবিষ্কার করা, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া, নিজ দলের সৈন্যদের উজ্জীবিত করা সহ জগৎজ্যোতি ছিলেন সবার মধ্যমণি।
১৬ নভেম্বর ১৯৭১। হানাদাররা ১০০ গজের মধ্যে চলে আসলো উভয় দল। জগৎজ্যোতি ভেবে পারছেন না কি করবেন। সহযোদ্ধা ইলিয়াস বললেন, কি করবে? জগৎজ্যোতি বললেন, তোর যা ইচ্ছা তাই কর। কিন্তু ছাড় দিতে নারাজ। গোলাগুলির এক পর্যায়ে ইলিয়াসের বাম পাঁজরে গুলি লাগলো। জড়িয়ে ধরে নিজের মাথার গামছা বেঁধে দিলেন। আহত ইলিয়াস নিচু স্বরে বললেন, চল আত্মরক্ষা করি। জগৎজ্যোতি বলেন- পালাব না, সবটাকেই শেষ করে তবেই যাব। বিকাল ৫টার দিকে গুলিবিদ্ধ হলেন তিনি। বীরের অমিত তেজের দেহকে পানিতে ডুবিয়ে দিলেন ইলিয়াস। সূর্যাস্তের রক্তিম আভায় এক বীরের দেহাবসান ঘটল কিন্তু বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জগৎজ্যোতি।
জগৎজ্যোতি, মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। অসীম সাহসে লড়াই করে তিনি তার সাথীদের বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। নিজে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করে গেছেন অসংখ্য সাথীদের।
৭১-এ এরকম লাখো তরুণদের যবনিকা ঘটেছিল আর তার বিনিময়ে দেশ শত্রুমুক্ত হলেও এদের খোঁজ কেউ রাখে নি, লিপিবদ্ধ হয়নি এদের বীরত্বের ইতিহাস। কেউ কেউ কিছু ইতিহাসের অবতারণা করেছেন বটে কিন্তু তা নেহাত সামান্য।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নাম না জানা অগণিত বীরদের জানাই মননের গভীর থেকে অন্তহীন শ্রদ্ধা ও সংগ্রামী অভিনন্দন।
তথ্যসূত্র – আমার একাত্তর ও অন্যান্য – দ্বিজেন শর্মা
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য