প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
দেবজ্যোতি দেবু | ২৩ নভেম্বর, ২০১৬
বাংলাদেশে খুব প্রচলিত একটা বিষয় হচ্ছে নাম শুনে ধর্ম আন্দাজ করে নেয়া। নাম শুনে বুঝতে না পারলে কেউ কেউ সরাসরি প্রশ্নই করে বসেন, 'আপনি হিন্দু না-কি মুসলিম'! এটা আজকের নতুন কিছু না। আমাদের সময়ের আগেও আমাদের বাপ-দাদাদের সময়েও এমনটা ছিল। নিজের সম্প্রদায়ভুক্ত কেউ হলে তার সাথে এক ধরনের ব্যবহার, আবার ভিন্ন ধর্মের কেউ হলে তার সাথে ব্যবহার ভিন্ন। এমনকি অনেক জায়গায় কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলেও হিন্দু-মুসলমান পরিচয় যাচাই করে জায়গা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এইতো কিছুদিন আগেও একটা আর্ট স্কুলে দেখলাম তৃতীয় শ্রেণীর একটা শিশু তার নব্য পরিচিত এক বন্ধুর নাম জেনেই সরাসরি প্রশ্ন করে বসলো, 'তুমি হিন্দু'! হিন্দু জেনে সে খুব অবাকই হয়েছিল। তার চেহারাতে সেটা খুব পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল। কোন কোন শিশুরাতো ধর্মের অজুহাতে টিফিনটাও ভাগাভাগি করতে চায় না!
বাস্তব একটা উদাহরণ দেই। ফেইসবুকে কোন কিছু নিয়ে তর্ক শুরু হলেই দেখবেন সবার আগে আপনার নাম দেখেই আপনার ধর্মীয় পরিচয় নির্ধারণ করে নেয়া হয়। কথায় না পারলে ধুম করে বলে দেয়, আপনি হিন্দু আপনি ভারতে যান। নতুবা বলবে, আপনি হিন্দু বলেই কি নাসিরনগর নিয়ে আপনার এতো আক্ষেপ? সাম্প্রদায়িকতার চরম দৃশ্যায়ন আমাদের চোখের সামনেই প্রতিনিয়ত দেখতে হচ্ছে।
সম্প্রতি ২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রথমদিনে ইংরেজি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সৈকত ইসলাম নামে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রের বাবা-মা, তাদের পেশা ও তাদের অবস্থান নিয়ে একটি অনুচ্ছেদ দেওয়া হয়। অনুচ্ছেদ থেকে মোট ৪টি প্রশ্নের উত্তর করতে বলা হয়। প্রথম প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে ১০টি প্রশ্ন। উত্তরপত্রে শুধু শূন্যস্থানের উত্তরটি লিখতে বলা হয়। এখানে প্রতিটি উত্তরের জন্য বরাদ্দ ১ নম্বর করে। তিন নাম্বারে প্রশ্ন হচ্ছে-
সৈকত একজন- ক) মুসলিম, খ) হিন্দু, গ) খ্রিষ্টান, ঘ) বৌদ্ধ।
একটু ধাক্কা লাগলো মনের মাঝে। সৈকত কে সেটা জানতে চাওয়া এক বিষয়, আর তার ধর্ম পরিচয় জানতে চাওয়া অন্য। ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রশ্ন করা হচ্ছে সৈকতের ধর্ম পরিচয় কি! কেন? এই প্রশ্নটার যৌক্তিকতা কি? সে হিন্দু হোক আর মুসলিম, তাতে এই ছোট ছোট বাচ্চাদের কি? পরিষ্কার ভাবেই লক্ষ্য করা যায় এতে বাচ্চাদের সাম্প্রদায়িকতা শেখানো হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় খুব সুকৌশলে সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের মধ্যে শুরু থেকেই হিন্দু-মুসলিম দেয়াল তুলে দেয়া হচ্ছে। তাদের শেখানো হচ্ছে কিভাবে নাম দেখে মানুষের ধর্মীয় পরিচয় নির্ধারণ করতে হয়!
হয়তো বলবেন, এ আর নতুন কি? প্রতিটি পরিবার থেকেই তো বাচ্চাদের এমন শিক্ষা দেয়া হয় শিশুকালেই। তাহলে প্রশ্নটা দোষ করলো কি? উত্তর হচ্ছে, পরিবার থেকে যে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা দেয়ার উদাহরণ দেখাতে যাচ্ছেন সেটা সকল পরিবারে হয় না। হয় না বলেই এখনো এমন অনেক মানুষ বা পরিবার আছে যারা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে মানুষ হিসেবে চিনতে পারে। কিন্তু যখন এই সাম্প্রদায়িক শিক্ষাটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সকল শিশুর জন্য বাধ্যবাধকতায় রূপ দেয়া হবে তখন শিশুরা না চাইলেও সেটা শিখতে বাধ্য এবং সেখানে বাধা দেয়ারও কেউ নেই। উত্তর না দিলে মার্ক কাটা। রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থা বাধ্য করছে একটা শিশুকে এই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে। যেখানে একটা রাষ্ট্রের উচিত ছিল একটা অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়ার সে জায়গায় ব্যর্থ রাষ্ট্র উলটো সাম্প্রদায়িকতা শেখাচ্ছে শিশুদের। এমন দৃশ্য প্রমাণ করে একটা রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা সাম্প্রদায়িকতার হাতে কতোটা জিম্মি হয়ে পড়ছে।
রাষ্ট্র দাবি করছে সে অসাম্প্রদায়িক। সাধারণ শিক্ষিত জনগণ দাবি করছে তারাও অসাম্প্রদায়িক। জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকতে, জঙ্গিবাদ থেকে ফিরে আসতে, সরকার বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন তৈরি করে মানুষকে দেখাচ্ছেন। জঙ্গিবাদ থেকে ফিরে আসলে লোভনীয় আর্থিক পুরস্কারের ঘোষণাও সরকার দিলেন। বিশ্বের কাছে দেশে কোন ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী নাই বলে দাবি তুলছেন। কিন্তু আড়ালে মানুষকে সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা দিচ্ছেন। রাষ্ট্রধর্ম বলতে একটা কথা সংবিধানে সংযুক্ত করা আছে। এখন শিক্ষাক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িকতা চর্চা শুরু হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় চরম সাম্প্রদায়িক দাবি নিয়ে মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধনের অনুমতি দিয়ে উস্কে দেয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতাকে। এতোকিছুর পরে আমরা সরকারের অসাম্প্রদায়িক চেতনার চেহারা আর কোথায় গিয়ে খুঁজবো?
ছোট বেলায় বাবা বলতেন, 'তোমার প্রথম পরিচয় তুমি একজন মানুষ। দ্বিতীয়ত, তুমি একজন বাংলাদেশী। এরপরে তোমার পরিচয়, তুমি আমার সন্তান।' বড় হতে হতে দেখলাম আশেপাশে কোন মানুষ নাই! সবাই কোন না কোন ধর্মের লেবাস গায়ে লাগিয়ে ঘুরছে। একেক ধর্মের এজেন্ট একেক ধরনের ব্যবসার পসরা সাজিয়ে বসেছে, আর বাকিরা সকাল-বিকাল বিক্রি হচ্ছে পুতুল সেজে। প্রায়ই দেখা যায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সংগঠনের নাম নিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক দাবি জানানো হচ্ছে। করা হচ্ছে নোংরা সাম্প্রদায়িক উক্তি। কিছুদিন আগেও দেখেছি সরকার দলীয় মন্ত্রীর সাম্প্রদায়িক দাম্ভিকতা। আজ আবার দেখলাম শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের অপচেষ্টা।
আমরা সাম্প্রদায়িকতা চাই না। এই দেশ কোন সাম্প্রদায়িক দেশ নয়। অযথা এই দেশের আগামী প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িক করে তুলবেন না। এই শিশুরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তাই এই দেশকে অসাম্প্রদায়িক রাখতে, এই দেশের মানুষকে ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত রাখতে, সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ থেকে বাঁচাতে এই শিশুদের মানুষ পরিচয়ে গড়ে তুলুন। আমরা সকলেই মানুষ। আমরা বাংলা মায়ের সন্তান। আমাদের আগামীও যেন রবীন্দ্র-নজরুলের পরিচয় ধর্ম দিয়ে নয়, মানুষ হিসেবে নির্ধারণ করতে পারে, সেই মানের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিন। আমরা চাই 'ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু'।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য