আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বর্ণমালা ভয় শিখায়

জহিরুল হক বাপি  

মাননীয়, আমরা কুশিক্ষায় শিক্ষিত - ১

অনেক দিন তুমুল বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। স্রোতস্বিনী নদীতে সাঁতার দেওয়া হয় না। শরতের কাশবনে ঢুকে অকারণ চিৎকার দিয়ে নীরবতা আরও বাড়িয়ে দিই না। না দেখলাম বৃষ্টি, না দিলাম সাতার, নাই বাড়ালাম নীরবতা, গ্রামের কুয়াশা দেখা যাবে, শীত শীত রাতে পোকা মাকড়ের ডাক শোনা যাবে, কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে পরিচয় হবে কম কি? দেই ছুট। দুধের সাধ দুধেই মিটাই!

এক সময় প্রচুর ঘুরে বেড়ানোর কারণে রাস্তা-ঘাট সম্বদ্ধে একটা ধারনা ছিল। মানুষজনের চাল চলন সম্বদ্ধে ধারনা ছিল। বেশিরভাগ রাস্তা ঘাটই ভাঙাচোরা ছিল। এখন অবস্থা ধারনার বিপরীত। গুটিকয়েক রাস্তা বাদ দিলে বেশিরভাগ রাস্তাই ভালো। কোথাও কোথাও ফোর-লেন হচ্ছে, কোথাও আবার নতুন রাস্তা হচ্ছে। কোন কোন রাস্তা দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না এটা বাংলাদেশের রাস্তা কিনা। কোন কোন জোছনা রাতে এসব রাস্তায় কেউ কেউ যাওয়ার সময় নিশ্চয় মনে মনে ভাবে ভাববে “আহা এখন যদি সে থাকতো” “একবার তার সাথে বা তারে নিয়ে আসতে হবে”।

মানুষগুলোও এখন বেশ চকচকে। চোখে মুখে দারিদ্রের ছাপ বেশ খানিকটা কম। চেহারার আগের হতাশা বেশ কম। মনে হলো আগের মতোই কঠিন পরিশ্রম করে তারা আজ আর না খেয়ে থাকছে না, শীতে কষ্ট কম করছে। কোথাও কোথাও আবার নতুন নতুন মডেলের ট্রাক্টর দেখলাম। উন্নতি হচ্ছে বিত্তে, সড়কে, পোশাকে, গৃহে, রুচিতে। কিন্তু চিত্তের কি উন্নতি হচ্ছে?

কয়েক বছর আগেও দেখেছি গ্রামের সাধারণ মধ্যবিত্ত গেরস্থ বা মধ্যবিত্ত পরিবার নিজের জমি, ভূমিহীন কাউকে দিয়েছে বসবাস করতে, ছোটখাটো কোন ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছে। অন্যের ছেলেকে নিজের বাড়িতে রেখে পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছে। দরিদ্রতা ছিল চারপাশেই। তবুও মানুষ অন্যর জন্য করেছে। মানুষ ছিল বড়। সদ্য আইন হয়েছে নিজের বাবা-মার ভরণ-পোষণ না করলে, যত্ন-আত্তি না করলে জেল-জরিমানা হবে। সরকার বাধ্য হয়েই এ আইন করেছে। মানুষ যত বেশি অপরাধপ্রবণ হয়, নৈতিকতা বিবর্জিত, বর্বর হয় তত বেশি আইন করতে হয়।

নেদারল্যান্ডসে কারাগার বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে অপরাধীর অভাবে, অন্য দিকে সৌদী আরবে প্রতি বছর প্রকাশ্যে কল্লা কাটা চলছে এবং তা উত্তরোত্তর বাড়ছে। কেন? আমাদের যখন দরিদ্রতা ছিল, তখন আমাদের ভিতর নৈতিকতা ছিল, মানবিকতা ছিল, আজ নিজ বাবা-মাকে ভরণ পোষণ দেওয়ার আইন করতে হয় কেন? আগে মানুষ নিজের না শুধু অন্যের বাবা-মাকেও খাইয়েছে, বাবা মারা যাওয়ার পরও সৎ মায়ের পরম যত্ন নিয়েছে! আজ কেন এ অবস্থা?

আমাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, ঝকঝকে রাস্তা, চকচকে নতুন স্কুল ভবন কিন্তু অন্তরে আমরা মলিন হচ্ছি কেন? এর উত্তর খোজা জরুরি। জরুরি বাঙালির গন্তব্য নির্ধারণ। আগের মতো অহরহ ভাঙা চাল বেয়ে জোছনা ঢুকে না, বারান্দায় বসে আরাম করে জোছনা স্নান হয় এখন। চন্দ্র, আসমান, রাস্তা, ঘর, গরু, ধান ক্ষেত, পরনের পোশাক, হাতের মোবাইল সবই চকচকে, কিন্তু ভিতর আগেও চেয়েও মলিন! কেন??

আমাদের উন্নতির এসব সম্পদ কি অবৈধ, চুরির? আমরা কি চুরি করে ধনী হচ্ছি? পদ্মা সেতু করছি, বিদ্যুৎকেন্দ্র করছি? আমরা কি চুরির টাকায় নতুন নতুন বিদ্যালয় ভবন করছি?

“না, মোটেও না” আমাদের উন্নয়নের অর্থ পুরোটাই ঘামে, নি:সঙ্গতা, শরীর ব্যথায় কেনা। প্রবাসীদের রক্ত পানি করা টাকা তার সাথে সরকারের দক্ষ পরিকল্পনা। বৈধ টাকায় নিজের প্রথা, অভ্যাস, পরিচয় ভুলে আমরা এমন ছোট মানুষ, না মানুষ হয়ে যাচ্ছি কেন? উন্নতি মানে তো সব কিছুর উন্নয়ন। আমাদের আর্থিক উন্নতি হচ্ছে কিন্তু কিন্তু আত্মিক এত অবনতির কারণ কি? আবারও আমাদের আত্মাকে বড় করার কার্যক্রম কবে নাগাদ শুরু হবে?

আমি ছোট বেলায় পড়েছিলাম-

“অ-তে অজগরটি ঐ আসছে তেড়ে
আ-তে আমটি আমি খাবো পেড়ে” ।

সুন্দর বর্ণমালা শিক্ষার শুরু হিংস্র একটা প্রাণীর ভয় দেখিয়ে। এ ভয় থেকেই হয়তবা আমার সাপের প্রতি প্রবল একটা ঘৃণা আছে। আম খাওয়ার ইচ্ছা আমাকে এমনভাবে পড়ানো হয়েছে যেন আমি আমটি খাবো এটাই প্রধান বিষয়। কথা শেষ। কি ভাবো খাবো, কার আম, কেমন আম সেটা জরুরি না, আম খাওয়াটা জরুরি। আবার ছন্দ মেলানোর জন্য দুইটি লাইন জোড়া দেওয়া হয়েছে। দুই লাইন মিলে কোন অর্থ তৈরি করে না। আমাদের অবস্থাও তেমন। জীবনের অর্থ ঠিক তৈরি করতে পারছি না। বলা যায় বুঝতেই তো পারছি না , তৈরি করবো কি?!

আমাদের যে এই স্খলন এটা আরোপিত। ৭৫ পরবর্তী থেকে চেষ্টার সফল ফল নৈতিকতাহীন, জীবনহীন এই আমরা। একাডেমিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা সব ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে ভাইরাস ঢুকানো হয়েছে।

“স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্য পুকুরে
গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাতার”

আমাদের হাই স্কুলে পাঠ্যসূচিতে এ লাইনগুলো আছে। এগুলো পড়ার পর বোঝার পর একটা মানুষ দেশপ্রেমিক না হয়ে, মানুষকে সম্মান না দিয়ে, নারীকে সম্মান না দিয়ে পারে না স্বাধীন বাংলাদেশে। অথচ এখানে শিক্ষক নিজেই ধর্ষক। সে হিসাবে ছাত্রের এ লাইনগুলো মনে পড়লে চোখের সামনে ভেসে উঠবে – বিকিনি পরা সানি লিওন। শিক্ষক লাইনগুলো পড়তে পারেন, কিন্তু অনুভব করতে পারেন না। তাকে আসলে অনুভব করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। সার্টিফিকেট জরুরি। তিনি নিয়েছেন এবং দিয়েছেন। এমন করা হয়েছে ইচ্ছা করেই। আজ হিসাব করলে দেখা যাবে ৭১-এর চেয়েও এখন মৌলবাদীর সংখ্যা অনেক বেশি। কেন? তাদের মৌলবাদী বানানো হয়েছে।

আমাদের আত্মিক পুনরুত্থানের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যক্রম জরুরি। না হলে বিত্তের সাথে সাথে নৃশংস, আরও লোভী, প্রবল মাত্রায় ভোগবাদী জীবনে ঢুকা আমাদের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভালো সরকার, ভালো রাষ্ট্র তাকেই বলা সম্ভব যে রাষ্ট্রর জনগণ পৃথিবী এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক। যারা সামগ্রিক অর্থে খুশি এবং সুখী। ধনী রাষ্ট্র সৌদী আরবও। কিন্তু তাকে তো সুখী রাষ্ট্র বলা যাচ্ছে না। এবছরের এখন পর্যন্ত সেখানে দেড়’শর মত কল্লা ফালানোর শাস্তি হয়েছে।

বাবা-মায়ের ভরণ পোষণের জন্য আইন মানুষ হিসাবে, বাঙালি হিসাবে, ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের জন্য প্রবল অপমানের। এর থেকে বের হওয়ার জন্য কার্যক্রম আরও আগেই শুরু করা দরকার ছিল। আইন দিয়ে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে আনা যায় না। দরকার শিক্ষা, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত শিক্ষা, প্রচার। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী, ও সংস্কৃতিমন্ত্রী এখন নজর দিচ্ছেন না কেন এসব বিষয়ে?

জহিরুল হক বাপি, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ