প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শারমিন শামস্ | ৩০ নভেম্বর, ২০১৬
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চোখ বন্ধ করে রাখবো। কোথায় কোন শিক্ষককে খুন করে ফেললো পুলিশ, কোথায় কোন হিন্দুবাড়িতে আগুন দিলো অনুভূতিসম্পন্ন মুসলমানরা, কোথায় কোন কিশোরী হত্যা মামলার সব আসামি বেকসুর খালাস পেয়ে গেল- এই সব কিছুই আর চোখে দেখব না, কানে শুনবো না, অনুভব করবো না। তারচেয়ে সেজে-গুজে ফোক আর ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালে গিয়েছি, সেলফি-টেলফি তুলে, নর্থ এন্ড কফি খেয়ে বাসায় এসে ঘুম দিয়েছি বেঘোরে।
যদি কিছু লিখতেই হয়, লিখেছি আমার বারান্দার বাগানে ফোটা শীতের ফুল আর রোদে খেলতে আসা চড়ুই পাখি নিয়ে। এই বেশ ছিলাম। তো মেয়ের গা হালকা গরম, তাই বাচ্চাদের নাপা সিরাপ খাওয়ালাম। তারপর এক কাপ চা হাতে অনলাইন নিউজগুলোতে চোখ বুলাতে-বুলাতে চোখে পড়ল,‘তদন্তের গাফিলতিতে’ রীড ফার্মার সবাই খালাস’।
খবরটা এড়িয়ে যেতে পারতাম, ঠিক যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- কোন কিছু গায়ে না মাখার, সেই মত। কিন্তু সকালবেলা মেয়েকে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়ানোর পর পর এই সংবাদ পড়ে ইচ্ছে হলো, একটা জুতো হাতে ছুটে গিয়ে সেটা মেরে আসি সপাটে কারো মুখে। কিন্তু কার মুখে এই জুতো মারবো সেটাই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি অসহায়, সাধারণের চেয়েও অতি সাধারণ এক নাগরিক মাত্র, আমার জুতো জোড়ার শক্তিও তেমন প্রবল নয় যে আঘাতে সব চুরমার হয়ে যাবে। তাই কিছুক্ষণের মাঝেই আমি নেতিয়ে গেলাম, যেরকম আমরা সবাই যাই।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছিল, রীড ফার্মার প্যারাসিটামলে বিষাক্ত উপাদানের কারণে শিশু মৃত্যু র ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলেন, ওই প্যারাসিটামলে ডাই ইথিলিন গ্লাইকল পাওয়া যায়নি। তবে ওই ওষুধ ছিল নিম্নমানের।
সব সম্ভবের এই দেশ বটে। মামলা করা হলো প্যারাসিটামলে বিষাক্ত উপাদানের অভিযোগ তুলে। আর তদন্ত করে বলা হলো- বিষাক্ত পদার্থ নাই!তো আদালত আর বিচার করবে কি। বিচার যা করার ঐ তদন্ত কর্মকর্তাই তো করে দিয়েছে। এখন এই তদন্ত কর্মকর্তার তদন্ত কাজের একটা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত যদি আমরা দাবি করি, সেটি কি কখনও পূরণ হবে?
২০০৯ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত রীড ফার্মার প্যারাসিটামল সিরাপ পানে সারাদেশে ২৮ শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠলে ১০ আগস্ট ঢাকার ঔষধ আদালতে মামলা হয়। পাঁচ আসামির মধ্যে রীড ফার্মার মালিক মিজানুর রহমান ও তার স্ত্রী কোম্পানির পরিচালক শিউলি রহমান রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিল। মিজানুর এই মামলাটিকে হয়রানিমূলক দাবি করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেছে, “আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি।”
এই দেশে আজ বিচার শব্দটির চেয়ে বড় কৌতুক কিছু নাই। ওই মিজানুরের কান্নার চেয়ে বড় কমেডি নাই। এর দর্শক এদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ আর ওই আটাশটি শিশুর বাবা-মা। যার দর্শক আমরা যারা কাঁপা হাতে ওষুধ কিনে এনে ভবিষ্যতেও তুলে দেব সন্তানের মুখে। শিশু মৃত্যু এই দেশে এত সাধারণ, আজকাল মনে হয়, শিশুর মা বাবা হওয়াটাই হয়তো অনেক বড় অপরাধ আর পাপ।
দেশে আজ সবচেয়ে বড় চলমান সংস্কৃতির নাম খালাসের সংস্কৃতি। ফুলকে হত্যা করা হয়েছিল ১৫ বছর আগে। সব আসামি খালাস পেয়ে গেল। রীড ফার্মার লোকেরা গুনে গুনে আটাশটা বাচ্চার প্রাণ কেড়ে নিলো, সব্বাই খালাস হয়ে গেল। পূজা নামের বাচ্চাটার যোনিপথ ব্লেড দিয়ে কেটে ধর্ষণ করেছিল যে সাইফুল তার কাছ থেকে নাকি এখনও কোন কথাই বের করতে পারেনি পুলিশ। আরেকটা আসামি কবিরাজ এখনও ধরাই পড়েনি। মিতু, তনু, আফসানা, রুনি, সাগর নামগুলো কোথায় কোন কালের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে, আমরাও আর মনে করতে পারিনা।
খাদিজা সেরে উঠেছে। তার চিকিৎসার সব ব্যয়ভার লাখ লাখ টাকা কারা দিচ্ছেন, সেই তথ্য দিতে নারাজ স্কয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে বদরুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। ভালো। আমরা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি শুধুমাত্র খাজিদার ঘটনায়। কিন্তু কোথায় যেন একটা কিন্তু রয়ে গেল। কার যেন কলঙ্ক মোচনের তোড়জোড় চলছে, আর সব কিছু ভুলিয়ে দেবার প্রস্তুতি। খাদিজা সেরে উঠুক, ঘুরে দাঁড়াক। বদরুল ফাঁসিতে ঝুলুক দ্রুত। কিন্তু তার মানে এই নয় তনু, মিতু আর আফসানার মা বাবা হতাশা যন্ত্রণায় ক্ষোভে মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে থাকুন। তার মানে এই নয় রীড ফার্মার মালিক ওই শিশু হত্যাকারীরা আটাশটি শিশুর রক্ত গায়ে মেখে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকুক, তার মানে এই নয় ফুল হত্যার আসামি প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সদর্পে ঘুরে বেড়াক মনুষ্যসমাজে।
আচ্ছা! মনুষ্য সমাজই বা বলছি কেন? আমরা কি মানুষ? এই দেশ কি মানুষের দেশ? এটা কি আদৌ কোন দেশ? আমরা কি বেঁচে আছি? নাকি মনুষ্যত্ব দর্শন থেকে খালাস পেয়ে মৃত রাষ্ট্রের খোলসে মুখ ডুবিয়ে শুধু ঘোৎ ঘোৎ করছি?
উত্তর জানা নেই! শুধু জানি, সাত সকালে যে জুতোখানা হাতে নিয়ে ছুটে যেতে চেয়েছিলাম, সেটি নিষ্ক্রিয়, নিরাবেগ পড়ে আছে মেঝেতে, আলমিরার কিনারে!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য