আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মৌলবাদী বনাম স্বঘোষিত প্রগতিশীল!

খুরশীদ শাম্মী  

সারা বিশ্বে এখন ধ্বনিত হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিরক্তিকর ঝনঝন আওয়াজ। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে পৌঁছেও সাম্প্রদায়িকতার যেন কোন শেষ নেই। বরং দিনদিন বেড়েই চলছে। আর এই মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আমরা পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করছি। অথচ আমরা কেউই গভীরভাবে সমস্যার মূল উৎস এবং এর থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে ভাবছি না, কিংবা ভাবতে চাই না। কারণ এই সকল সাম্প্রদায়িকতার জন্য তো আমারাই দায়ী! বিশ্বের জন্মলগ্ন থেকে সাম্প্রদায়িকতা; গোত্র, বর্ণ, ধর্ম এবং জাতিভিত্তিক হতে দেখা গেলেও, ধর্ম ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ মৌলবাদ সমাজে সংক্রামিত হচ্ছে খুব দ্রুত গতিতে এবং মারাত্মক বিষাক্ত আকারে। এই মৌলবাদ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় প্রগতিশীলতা।

মৌলবাদ থেকে মৌলবাদী এবং প্রগতি থেকে প্রগতিশীল দু’টোই বাংলা শব্দ। আপাতদৃষ্টিতে শব্দ দু’টোকে অমাবস্যা-পূর্ণিমা কিংবা রাত-দিনের মতো একে অপরের উল্টো পিঠ বলেই মনে করা হয়। কারণ মৌলবাদ শব্দটির অর্থ ধর্মের প্রতি অন্ধ ও গোঁড়ামিপূর্ণ বিশ্বাস। আর যারা কেবলমাত্র নিজেদের ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের কারণে ধর্মের গোঁড়ামিতে ডুবে থেকে ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে অন্যের ক্ষতি সাধন করতে বিন্দু পরিমাণ চিন্তা করে না, তারাই মৌলবাদী। মৌলবাদীদের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তাদের নিজেদের ধর্ম এবং বিশ্বাস।

একই ভাবে, প্রগতি শব্দের অর্থ অগ্রগতি। যারা সময়ের সাথে সাথে সমাজ, বিজ্ঞান এবং মানুষের প্রয়োজন ও ভাবনার পরিবর্তনের অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের চালিত করে, প্রয়োজনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তারা সমাজে প্রগতিশীল বলে পরিচিত। প্রগতিশীলদের কাছে নিজের ধর্ম নয়, বরং মানবতা তথা সমাজের সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এবং শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের ন্যায্য দাবী আদায়ই সবকিছুর ঊর্ধ্বে বলে বিবেচিত হয়। যদিও অনেকে মনে করেন, কেবলমাত্র মার্ক্সবাদ লেনিনবাদের অনুসারীরাই প্রগতিশীল, এবং প্রগতিশীলরা বামপন্থি রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। কালের বিবর্তনে এই প্রগতিশীলতাও বিস্তৃত হয়েছে। তবে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য, মানব সমাজে মানবতা টিকিয়ে রাখা কিন্তু পরিবর্তন হয়নি। তাই প্রগতিশীলদের মানবতাবাদী বললে ভুল হবে না।

মানুষের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস জন্মাবার পর থেকেই, বিজ্ঞানীরা যখনই কোন কিছু আবিষ্কার করেছেন কিংবা দার্শনিকেরা যখনই যুক্তির স্তবকে মিথ্যাকে মিথ্যা প্রমাণ করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছেন, সর্বদাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিটি ধর্মের ধর্মান্ধ মানুষদের গোঁড়ামি এবং তাদের অজ্ঞতা। তবুও তারা থেমে থাকেন নি। আবিষ্কার করেছেন একের পর এক নতুন বিস্ময়। দিনদিন তাঁদের নতুন নতুন আবিষ্কারের কারণে পরিবর্তন এসেছে সমাজ ব্যবস্থায়। বিশ্বকে ছোট করে মানুষের হাতের মুঠোয় তুলে দিয়েছেন তাঁরা। এমনকি তাঁরা তাঁদের যুক্তিতর্ক এবং আবিষ্কারের মাধ্যমে কালের বিবর্তনে স্বার্থলোভী মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন ধর্মের প্রতি মুক্তমনের মানুষদের নানান প্রশ্ন এবং সন্দেহের বিনাশ ঘটিয়ে তাদের ধর্মান্ধতা থেকে রেহাই পেতেও সহায়তা করেছেন।

এই বিষয়গুলো একদিনে সম্পন্ন হয় নি। ধীরে ধীরে করতে হয়েছে এই সকল কাজ। মোটকথা সমাজের অগ্রগতি অব্যাহত আছে নানান প্রতিকূলতায়ও। ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাস, অজ্ঞতা, স্বল্পশিক্ষা, দরিদ্রতার মতো বিভিন্ন প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে মানব কল্যাণের কথা বিবেচনা করে, বিজ্ঞান এবং দর্শন অনুসরণ করে যারা নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন এনে মানব সমাজ এবং সভ্যতাকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সামনে অগ্রসর হতে সহায়তা করেছেন তারা সকলেই প্রগতিশীল। এদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।

বর্তমান ভেজালে জর্জরিত সমাজে আর একদল নকল প্রগতিশীল আছে। যাদেরকে আমি বলি স্বঘোষিত প্রগতিশীল। এই স্বঘোষিত প্রগতিশীলেরা মনেপ্রাণে ধর্মভীরু এবং ডানপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, কিন্তু কেবল স্বার্থের খাতিরে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে, আধুনিকতার আলগা-লেবাস পরে, নিজেদের বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত করে। এবং নিজেরাই বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তা প্রচারে ব্যস্ত থাকে সর্বদা। জীবনে কোন এক জনসভায় উচ্চকণ্ঠে বক্তৃতা করে নিজেদের ঢোল নিজেরাই এত পেটায় যে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় সর্বক্ষণ, সারাজীবন। অথচ তাদের অনেকের শরীরে এখনও পাওয়া যায় মসজিদের মিলাদে ব্যবহৃত আগরবাতি, গোলাপজল কিংবা মন্দিরের পূজা মণ্ডপে ব্যবহৃত ধূপের গন্ধ। যদিও এগুলো সবই সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবুও এই গন্ধের মধ্যেও তারা খুঁজে বেড়ায় বিভাজন। তারা নিজেদেরকে ধর্ম নিরপেক্ষ বলে দাবী করলেও, তারা এখনও শেখেনি, কোনো পার্টিতে খাবার টেবিলে কচ্ছপ, শুকর কিংবা গরুর মাংস পরিবেশিত হলেও কোন প্রকার নেতিবাচক আওয়াজ না করেও পরিবেশক এবং উপস্থিত সকলের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে কেবল তার জন্য পরিবেশিত এবং তার জন্য উপযুক্ত খাবার খাওয়াও মুক্তমনের প্রতিচ্ছবি। তারা সারাদিন নিজেদের প্রগতিশীলতার খবরের প্রতিধ্বনিতে তুষ্ট হয়ে গা ভাসিয়ে থাকলেও, রাতে নিজের বাড়িতে প্রবেশ করে শুরু করে উল্টো পিঠের অনুশীলন। পালিত চাটুকারদের নিয়ে বাড়িতে দরজা-জানালা বন্ধ বৈঠক হয় আলাদা আলাদা। চাটুকাররা দিনের বেলায় জনসম্মুখে তাদের স্যার বলে সম্বোধন করলেও রাতে তারা হয়ে যায়, হুজুর কিংবা গুরুজী! সারাদিন লোক দেখানো অন্যধর্মের সহযোদ্ধার পেছনেই হয়তো লেলিয়ে দেয় নিজের পালিত চাটুকারদের। এভাবে নিজেদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা অন্ধত্বকে প্রশ্রয় দিয়ে পরস্পর পরস্পরের বিশ্বাসে আঘাত করে। মৌলবাদীদের মতো তারাও সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করে। আবার পরের দিন, দিনের আলোতে সেটাকে নিয়েই শুরু করে অলোচনা, সভা, সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি, মিটিং-সিটিং। সাধারণ জনগণ এই স্বঘোষিত প্রগতিশীলদের স্বার্থপরতা, রাজনীতির মারপ্যাঁচ না বুঝেই আবেগে আপ্লুত হয়ে বিষয়টির সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। এভাবেই তারা সমাজে জিইয়ে রাখে ধর্মীয় কোন্দল, শ্রেণী ভিত্তিক বিভাজন, বর্ণবাদ, রাজনৈতিক এবং লিঙ্গ কেন্দ্রিক অন্যায়।

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, প্রকৃত প্রগতিশীলরা প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে সমাজকে কলুষমুক্ত করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়, আর মৌলবাদ সমাজকে বিভাজিত করে পেছনে ঠেলে দেয়। তবে বর্তমান সমাজে সাধারণ জনগণ এবং প্রকৃত প্রগতিশীলরা স্বঘোষিত প্রগতিশীলদের মারপ্যাঁচে দিশেহারা। সত্যিকার অর্থে, মৌলবাদ এবং স্বঘোষিত প্রগতিশীলদের মধ্যে নীতিগত কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য নেই তাদের বিশ্বাসেও। পার্থক্য শুধু এই যে, মৌলবাদীরা স্বীকার করে ধর্মের প্রতি নিজেদের অন্ধ বিশ্বাসের কথা, আর স্বঘোষিত প্রগতিশীলরা সাধারণ মানুষদের চোখের আড়ালে যার যার নিজের ধর্মের মানুষদের প্রতি স্বজনপ্রীতি করে। তাদের মধ্যে সাধারণ জনগণকে বোকা বানিয়ে ধর্মান্ধদের থেকে এক কদম এগিয়ে থাকার একটা প্রতিযোগিতা লেগে থাকে সর্বদা। তাদের দু’দলই নিজেদের ধর্ম, দেশ, জাতি এবং বিশ্ব মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তাই সাধারণ শান্তিপ্রিয় মুক্তমনের জনগণ যেমন ঘৃণা করে মৌলবাদে, ঠিক তেমনি এক পর্যায়ে প্রত্যাহার করে ঐ সকল প্রগতিশীলদের আহ্বান। মৌলবাদী এবং স্বঘোষিত প্রগতিশীলদের দু’দলই সমানভাবে পরাজিত হয় নিজেদের প্রতিযোগিতায়। আর প্রতিটি দেশ, জাতি এবং বিশ্ব মানব সমাজ হারায় শান্তি। বর্তমান বিশ্বের সকল অশান্তির মূল কারণ, মৌলবাদীদের সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ এবং স্বঘোষিত প্রগতিশীলদের ভণ্ডামি।

এদের দু’দলই মানবতার শত্রু! মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে এদের দু’দলেরই পরিবর্তন অপরিহার্য!

খুরশীদ শাম্মী, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ