আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিজয়

ড. কাবেরী গায়েন  

পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জেতাটা খুব সহজ কাজ ছিলো না। বিশেষত, যখন পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়েছিলো মার্কিন আর চীনের সমর্থন। জাতিসঙ্ঘের ভূমিকাও ছিলো মার্কিন অবস্থানের প্রতি অনুগত। সেই যুদ্ধে বাঙালি জিতেছে। ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আর সাহায্যের কথা ভুলিনি। কিন্তু জীবন দিয়েছেন এদেশের মানুষ। ৩০ লক্ষ। নির্যাতিত হয়েছেন অন্তত দুই লক্ষ নারী।     

তবে, বাংলাদেশ প্রত্যয় আমার সামনে যে বিশালতা নিয়ে দাঁড়ায়, সেখানে আমাদের নিজেদের সাথে নিজেদের লড়াইয়ে আমরা কতোটা জিতেছি, বলা মুশকিল।     

আজো মানুষ ক্ষুধার্ত। থানচিতে মানুষ আক্ষরিক অর্থে দুর্ভিক্ষের ভেতর কাটিয়েছেন মাত্র কয়েকদিন আগেও। মাত্র ক'দিন আগেই সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, এই মর্মে প্রতিবেদন বেরিয়েছে বিশ্বগণমাধ্যমে। জানি না, দ্বিজেন টুডুর ক্ষত চোখ নিয়ে বেঁচে থাকা জীবন এই বিজয় দিবসকে কীভাবে দেখছে। নাসিরনগর-মালোপাড়া-সাতক্ষীরা-দিনাজপুর-চিরির বন্দর-বেগমগঞ্জ-সাঁথিয়া-পাথরঘাটা-রামু। বাংলার হিন্দু, বাংলার খৃস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালি- এই শ্লোগান আপ্তবাক্যই  থেকে গেলো বুঝি। রাষ্ট্রধর্ম-অর্পিত সম্পত্তি আইন। শ্যামলকান্তি-উত্তম বড়ুয়া-রাজীব-রসরাজদের বাড়িতেও কি আজ বিজয় পতাকা উড়ছে? অন্যান্য জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজো মেলেনি যথা-মর্যাদায়।     

তনু-রিসা-পূজা-আফসানা। অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। ধর্ষণ শুধু নয়, ধর্ষণ-খুন-অঙ্গ বিকৃতিকরণ চলেছে সমানে, সারা বছর। আমি নিশ্চিত এইসব খুনি-ধর্ষণকারীও আজ পতাকা রাঙ্গিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছে। 'বাংলার মায়েরা-মেয়েরা প্রত্যেকেই আজ এক একজন মুক্তিযোদ্ধা'- দেশটির জন্মকালীন এই পোস্টার ছবি হয়েই লটকে থাকলো।      

একদিকে রাষ্ট্র শিশু সনদে ১৮ বছরের আগে পর্যন্ত সবাইকে শিশু ঘোষণা করেছে, অন্যদিকে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়েকে বৈধতাও দিয়েছে। অর্থাৎ শিশু বিয়েকে বৈধতা দিয়েছে। খুব বেশি কিছু বলার নেই। এর অর্থ এতোটাই মারাত্মক যে লিখবার সাহস করতে পারছি না জনপরিসরে। আমি বরং একই রাষ্ট্রের দুই সনদের পারস্পরিক সাংঘর্ষিক অবস্থানটুকু উল্লেখ করেই থেমে যাই আজ।    

এবছরে ছেলে শিশুদের মেরে ফেলার অদ্ভুত কিছু পদ্ধতিও দেখেছি। বিশেষ করে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে মেরে ফেলা। স্বাধীন মন কি আসলে এতোটাই বিকৃত হতে পারে?     

একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশ খানিকটা হলেও গ্লানিমুক্তির দিকে যাত্রা করেছে, অন্যদিকে ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মতোই মুক্তচিন্তার উপর চূড়ান্ত আঘাত নেমে এসেছে। আমরা গত দুই বছরে প্রিয় বন্ধু, সহযোদ্ধাদের হারিয়েছি। অভিজিত রায়-এর বাবা মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক অজয় রায়, দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের বেদনা খানিকটা দেখার সুযোগ যদিবা হয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবুর সেই বোন যিনি বলেছিলেন যদি বাবু ধর্ম-বিরোধী কিছু লিখেও থাকে সেটা বিচার করার মালিক তো আল্লাহ, ওরা কে?- কেমন আছেন সেই বোন? কেমন আছেন নিলয়ের মা, অনন্তের মা, রাজীবের বাবা, তন্ময়ের পরিবার, হলি আর্টিজানে নিহত  মানুষদের স্বজনরা? তাঁরাও কি আজ বিজয় উদযাপন করছেন?

বাইরের শত্রুকে যদি বা পরাস্ত করা যায়, নিজেদের ভেতরে ক্রমশ বেড়ে ওঠা শত্রুকে পরাস্ত করার উপায় কি নেই কোন? সুন্দরবন ধ্বংস হতে চলেছে। কেনো শুধু কয়েকজন মানুষই রাস্তায়? কেনো সারাদেশ এই একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনকে রক্ষার জন্য সোচ্চার নন? যে মন স্বাধীন নয়, সে-মন প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার বিষয় কীভাবে আত্মস্থ করবে? আমাদের সমগ্র পাঠ্যক্রমের ভেতর বন আর পরিবেশ রক্ষার কোন পাঠ নেই সেভাবে।

কীভাবে বিজয় উদযাপন করছেন পোশাক-কারখানায় চাপাপড়া, পুড়েমরা শত শত শ্রমিকের পরিবার?      

আমার কাছে বিজয় মানে নিজের কাছে ফেরা। পাকিস্তান আমাদের মেরেছিলো, আমরা সেই বাইরের শত্রুকে মোকাবেলা করেছি নয় মাসে লক্ষ জীবনের বিনিময়ে। সে উদযাপন হোক যথাযথ মর্যাদায়। কিন্তু যে শত্রু নিজের দেশে, নিজের ঘরে, নিজের ভেতর- সেই শত্রুকে মোকাবেলার পাঠ কেউ দেয়নি গত ৪৫ বছরে। তবু তরুণ প্রজন্মকে ভরসা করতে চাই। আমার প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে সেনা-শাসনের ভেতর, ইতিহাস বিকৃতির রান্নাঘরে। লড়াইটা চলেছে সেখানে। কিন্তু যারা সেনা-শাসনমুক্ত বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছেন, তাঁদের উপর ভরসা করতে গিয়েও থমকে দাঁড়াই। বাস্তবতা হলো, তাঁরা পড়েছেন তথাকথিত বিশ্বায়নের যাঁতাকলে, বাজার-পৃথিবীর বাস্তবতায়। শুধু নিজের ভালো থাকার, 'দরোজা বন্ধ করে খাও' বিজ্ঞাপনের জগতে।     

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে তবে আশার কিছু কি নেই? আছে অবশ্যই। একাত্তরের কাছে নতজানু হয়ে শেখার মধ্যেই  আমাদের মুক্তি। যুদ্ধটা শুধু পাকিস্তানের কাছ থেকে পতাকা নিজের করে পাবার স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিলো না। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানবাহিনী যুদ্ধ চাপিয়ে দেবার আগেও বাংলার মানুষ নিজেদের এক বৃহত্তর মুক্তির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। ৪৭ থেকে ৭১ কালপর্বে যুদ্ধটা তৈরি হয়েছিলো একটি শোষণহীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের। যুদ্ধটা ছিলো মুক্তি অর্জনের।

সেই যুদ্ধের প্রধান দৃশ্যমান শত্রু নিঃসন্দেহে পাকিস্তান। কিন্তু ৪৭-৭১ কালপর্বে তৈরি হয়েছিলো এক 'বাংলাদেশ অভিমুখী মন'। দুঃখের বিষয় হলো, পাকিস্তানকে পরাজিত করা গেলেও 'পাকিস্তান-মন' বলে যে বাস্তবতা সেই বাস্তবতা ছাড়িয়ে 'বাংলাদেশ-মন' বাস্তবতায় আমরা কখনোই সম্যকভাবে উন্নীত হতে পারিনি নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমীকরণে।     

বাংলাদেশের সত্যিকারের বিজয় নিহিত আছে 'বাংলাদেশ-মন' প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে। এবং সে যুদ্ধ এক দীর্ঘযুদ্ধ। জানি না, ৭১-এর আগে যে যুদ্ধটা শুরু হয়েছিলো, এবং ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পরে যে যুদ্ধটা ম্রিয়মাণ হতে শুরু করেছিলো, সেই যুদ্ধটা আমরা আদৌ শুরু করতে পারবো কি না। আমি ভরসা করি এ'কারণে যে, আমাদের খুব দক্ষ এক তরুণ প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। তাঁদের হাতে প্রযুক্তি আছে, বাংলা ভাষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিনিময় ভাষায় দক্ষতা আছে। সারা পৃথিবীর জানালায় তাঁরা উঁকি দিতে পারেন। শুধু দরকার 'বাংলাদেশ-মন'টাকে গ্রথিত করার প্রয়াস। আজকের দিনের শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিকরা যদি ডাকটি দেন তো ভালো, না দিলেও তাঁরা খুঁজে নেবেন, খুঁজে পাবেন পথ, সেই আশা করি। প্রাক-মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত সেই পথে তাঁদের সাহায্য করুক। আমাদের সবাইকে সাহায্য করুক।   

আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে যদি শুধু পাকিস্তান-বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলি, সে বিজয় তখন খণ্ডিত। আমাদের যুদ্ধটা যে আসলে অনেক বড় এক যুদ্ধ, 'একটি ফুলকে বাঁচানোর যুদ্ধ'- সে'কথা ভুলেই গেছি বোধহয়। ভুলে গেছি স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাপত্রের ডাক- স্বাধীনতা, সাম্য আর মানবিক মর্যাদার ডাক। ভুলে যাওয়ায় লাভ অনেকের।     

আমাদের সমস্ত আনন্দ-আয়োজনের নীচে বাংলাদেশ-মন চাপা পড়ে গেছে  অনেকটাই, যে মন 'পাকিস্তান’ নামের দর্শনের বিপরীত। যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন- তাঁদের ঘোষণা ছিলো সেই পাকিস্তান দর্শনকে পরাস্ত করার যুদ্ধ। সেই আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ-মন ফিরিয়ে আনার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে আমাদের সকল  প্রচেষ্টা নিয়োজিত হোক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শন যেনো আমরা বুঝতে পারি, আত্মস্থ করতে পারি।  

জয় বাংলা।

ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ