প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬
প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোলাহল মুখর সন্ধ্যারাতের ক্যাম্পাস।
রাজনীতি ও শিল্পচেতনার ভুবন থেকে সদ্য বিদেয় নেওয়া এক তরুণ কবির জন্য অকালশোক করতে করতে হাকিম চত্বর থেকে সাবেক ছাত্রনেতা অঞ্জন দা ( অঞ্জন দেবনাথ) আর আমি হেটে হেটে যাচ্ছিলাম নীলক্ষেত। কিছুদিন আগেও ক্যাম্পাসের পিচঢালা কালো পথের আকাশজুড়ে ছিল নিয়ন আলোর মায়াবী রূপ। এখন আর নিয়ন আলো নেই। শাদা ফকফকা আলো। হাত থেকে সূচ পড়লে খোঁজে পাওয়া যায়। এ আলোয় কেমন যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। উন্নয়নের ঢেউয়ে চেনা ক্যাম্পাস রোজ বদলাচ্ছে । উপড়ে ফেলা হচ্ছে কলাভবনের চত্বরজুড়ে থাকা সবুজ ঘাস। মখমল সবুজ বিছানায় উন্নয়নের তোড়জোড়ে ঘাসের বদলে বসছে কংক্রিট। টিএসসি থেকে ভিসি চত্বর, ফুলার রোডের দুধারে নিরবচ্ছিন্ন সবুজ বৃক্ষেরা উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন শত বছরের পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণেরা উচ্ছেদের ভয়ে ।
বৃষ্টিতে, বর্ষায় বিরামহীন জারুল ফুলের নীলাভ মোহনীয় সৌন্দর্যে মোহিত, কোন এক মুগ্ধ প্রেমিক যুগলের অন্তর্গত কান্নার ধ্বনি শুনি। ছয়শো একরের রমনা গ্রিনের সবুজ ক্যাম্পাসে বছর বছর জায়গা দখল করছে বেঢপ কংক্রিট। সেই জোয়ারে বিপন্ন প্রিয় ফুলার রোড। শালিক চত্বরে অভিমানে আর আসে না প্রণয়ে প্রলুব্ধ জোড়া শালিকের দল। মধুর ক্যান্টিনের পাশের সেই চত্বরে এখন দাঁড়িয়ে আছে ঢাউস সাইজের এক বিল্ডিং। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজিমউদ্দীন খানের কাছ থেকে শোনা প্রাসঙ্গিক একটি অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। উনি একদিন নতুন সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের সামনে রিক্সা থেকে নামছেন। নেমে ভাড়া পরিশোধের পর রিকশাওয়ালা বলছে স্যার, “ইউনিভার্সিটিতে এতো বড় মার্কেট বানাইল, চলব তো ?” ভাবতে অবাক লাগে স্থাপত্যের নন্দনতত্ত্বের একাডেমিক জ্ঞানহীন একজন রিকশাওয়ালার মননের যে সৌন্দর্যচেতনা তাও আজ আমাদের উচ্চশিক্ষিতদের, নীতিনির্ধারকদের নেই ! রুচির এতো আকাল পড়েছে বঙ্গে। রুচির নিদারুণ দৈন্য আর বিচ্ছিরি শ্রী দেখে কষ্ট লাগে বইকি।
সেদিন বিষণ্ণ হয়ে বাসায় ফিরে আসার পর দূষণ আর শোষণের শহরে ক্লান্ত এক বন্ধু বলছিল, “এ শহর ছেড়ে প্রায়ই আমার কোন নিভৃত গ্রামে চলে যেতে ইচ্ছে করে। যেখানে সন্ধেবেলায় চারদিক অন্ধকার। নিভৃতে বসে দেখা যাবে বহুদূরে হারিকেনের মৃদু আলো। গঞ্জ থেকে হয়ত তখন ফিরবে ঘোরলাগা অন্ধকারে আগুনের একটু ঝিলিক দেওয়া বিড়ি ফুঁকে ফুঁকে কোন এক বেখেয়াল মধ্যবয়স্ক যুবক। হাতে তার সদাই করা ব্যাগ। বউ অঘ্রানের মাঠে পড়ে থাকা খড়ে - উঠোনের কোণে শীতরাতে একটু উষ্ণ সুখ নিচ্ছে আগুন ধরানো নতুন চুলোর পাশে বসে। মাকে ঘিরে বসে আছে অভুক্ত সন্তানেরা গরম ভাতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে। এমন বিশুদ্ধ গ্রামে চলে যেতে মন চায়।”
এমন বর্ণনা শুনে কার না মনের ভেতরটা হু হু করে উঠে। গ্রামে যাদের শৈশব কেটেছে এই দৃশ্যের সঙ্গে মোটামুটি সবাই পরিচিত। সন্ধ্যা নামলে হারিকেনের আলো জ্বলত। ঝোপঝাড়ে নামত থোকা থোকা জোনাক। বাড়ির পাশে বনে রাত হলে ভূতের সমাবেশ। ভয়ে সিটকে থাকত ছোটরা। আমাদের অধিকাংশ গ্রামগুলো এখন বিদ্যুতায়িত। বন নাই। রাতারাতি উজাড় হয়ে গেছে শত বছরের বৃক্ষরা সব। উঁচু মগডালে আশ্রয়ের অভাবে কতো বিচিত্র প্রজাতির পাখিরা আজ বিলুপ্তপ্রায়। পরিবেশের জন্য উপকারী শকুন আজ মহাবিপন্ন প্রজাতির তালিকায়। ভয় পাওয়া ভূত নির্বাসনে। অথবা রাতে গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া তৎপর এলিট ফোর্সের ক্রসফায়ারে বলি হওয়ার ভয়ে নিজেরাই গুম হয়ে গেছে। গুলশানের ডুপ্লেক্স ভবন, বিল্ডিং এখন নিভৃত গ্রামেও রোজ উঠছে। ঘরে ঘরে টিভি, বাজার দখলের হিন্দি সিরিয়াল। উইলিয়াম এফ অগবার্নের "সাংস্কৃতিক ব্যবধান তত্ত্বে" ফেলা প্রযুক্তির প্রাথমিক সামাজিক ধাক্কা সামলানোর নয়া চ্যালেঞ্জ তো আছেই ।
গ্রামের চিরচেনা কাশবন, জলাধার, সবুজ ধানক্ষেতে দেখি আচমকা উঠছে বেশুমার নতুন নতুন স্থাপনা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি তাদের এক গবেষণায় বলছে, দেশে বছরে বাড়ছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। কমছে দুই লাখ একর কৃষি জমি। বেসরকারি আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান "Association for Land Reform and Development/ALRD" তাদের এক গবেষণায় দেখাচ্ছে প্রতিদিন কমছে দুই হাজার বিঘা কৃষি জমি। আর আশি শতাংশ জমি ব্যবহৃত হচ্ছে বাড়ি নির্মাণে। এই যখন অবস্থা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০১০ সালে দ্রুত জমি কমে যাওয়া রোধ করতে কঠোর আইন পাশ করাসহ ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরে। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, শুধু নির্মাণ কাজে প্রতি বছর তিন হাজার হেক্টর জমি বিলীন হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ১০ বছরে আবাদি জমি বিলুপ্তির মুখে পড়বে। ঘনবসতির এ দেশে এসব উদ্বেগ উৎকণ্ঠার পরও এখনো আলোর মুখ দেখেনি 'জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০', 'কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন ২০১০।'
নানাভাবেই বিরূপ জলবায়ুর প্রভাবে হুমকির মুখে পড়া প্রাণ ও প্রতিবেশের কথা আমরা হররোজ ভুলে যাচ্ছি। ভুলে যাচ্ছি আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য বাংলাদেশ রেখে যাওয়ার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। মুনাফার বাড় বাড়ন্তে যেন বড়ো আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর ও উদাসীন সময়। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের জন্মস্থান বিক্রমপুর নিয়ে এক বুক শোকের "ভাঙন" কবিতার মতো আমারও অনাগরিক বুক তাই হাহাকার করে উঠে, "বিক্রমপুরকে শুধু পদ্মা ভাঙছে না, ভাঙছে দিনার, ইয়েন, ডলার, আরো কতো বিচিত্র মুদ্রা/ বিক্রমপুরে এখন ঠা-া ডাবের থেকে অনেক সুলভ কোকাকোলা, রাখালের বাঁশরির থেকে সুলভ এখন হিন্দি সিনেমার গান"।
এই বিক্রমপুর এখন গোটা বাংলাদেশে। উজানে বাঁধে আর জল আগ্রাসনে বিপন্ন বিশাল নদী তিস্তা, পদ্মা, মেঘনা আর যমুনার জলে জনপদ না ভাঙলেও অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর নগরায়ণে ভাঙছে । শহরগুলোর চারপাশে কৃষিজমি, জলাশয়ের উপর দেখি দাঁড়িয়ে আছে শত শত ছদ্মবেশী ভূমিদস্যুদের সাইনবোর্ড। নাড়ীর সঙ্গে সম্পর্কিত কৃষি থেকে গরীব কৃষক প্রবল ক্ষমতাবান ভূমি দস্যুদের দ্বারা প্রতিদিন উৎখাত হচ্ছে। ধানি জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা রঙচঙা অতিকায় সাইনবোর্ডগুলো সেই ধামামা বাজিয়ে চলছে। জানান দেয় বিশ্বায়নের নয়া বিশ্বে এখানেও শিগগিরই গড়ে উঠবে মনোরম মনোটনাস শহর। যথারীতি সেখানেও বৃষ্টি ও বর্ষার এ দেশে দুরন্ত কিশোরের জলে ভেজার মাঠ থাকবে না। গগনচুম্বী ভবন থাকবে কিন্তু কিশোরেরা আকাশ দেখবে না। আকাশের মত উদার হবে না তার মননের মহৎ জগত। হবে অনুদার, ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ। আর এভাবে একদিন সমৃদ্ধি ও সংরক্ষণের বদলে বিনাশের পৃথিবী রচিত হতে পারে।
অথচ আমাদের ভূমি সুরক্ষার প্রস্তাবিত আইনে কথা ছিল কোন কৃষি জমি কৃষি কাজ ছাড়া অন্যকোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কৃষি জমি, জলাশয় ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্প কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোন অকৃষি স্থাপনা কোনভাবেই নির্মাণ করা যাবে না । অর্থাৎ ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না । কিন্তু বাস্তবায়ন ও তদারকির অভাবে গ্রাম থেকে নগর সর্বত্র আজ অরাজকতা চলছে। উন্নয়নের বাড় বাড়ন্ত চলছে অদূরদর্শীভাবে। যেন দেখার কেউ নেই। আগামীর জন্য কোন অঙ্গীকার নেই, স্বপন নেই। আমরা নিশ্চয়ই উন্নয়ন বিরোধী নই। আমরা উন্নয়ন চাই। সমৃদ্ধ আত্মমর্যাদাবান বাংলাদেশ চাই। পূর্বপুরুষের রক্তভেজা শপথে উদার গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ চাই। উন্নয়ন হোক সুপরিকল্পিত, টেকসই, লাগসই ও সমন্বিত। ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল। যতই সামান্য হোক যখন তখন বনবিনাশী টিস্যু ব্যবহারের আগে বুক পকেটে সংরক্ষিত স্মৃতির সুগন্ধি রুমাল আমাদের একবার বিহ্বল করুক।
সে রাতে আমার ওই বন্ধুকে বলেছিলাম, আমি আর এমন বিশুদ্ধ গ্রাম কোথায় পাবো বল। যেখানে, গ্রামে গোধূলির মিইয়ে যাওয়া নরম আলোয় সন্ধ্যা নামবে। দূরে হারিকেনের মিটিমিটি আলো দেখা যাবে। দেশকে আপন অস্তিত্বের প্রতি অনুরণনে অনুভব করা নির্জন নিস্তব্ধ সৌন্দর্যের কবি আর আমি কোথায় পাবো ? যিনি পুনর্জন্মেও শঙ্খচিল শালিকের বেশে হলেও আবার ফিরে আসতে চাইবেন ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে - এই বাংলায়। বাংলার মাঠ ক্ষেত নদী ভালোবেসে যিনি ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আবার আসতে চাইবেন এ মাটির কাঠাঁলছায়ায়; সারা দিন যার কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে; জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়।"
কবির কবিতার, জীবনবাদী সব শিল্পীর সৃষ্টির অন্তর্গত অঙ্গীকারের মতো, সৃজন ও সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতিসহ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে আজ শত শত বিকশিত সাহসী স্বাপ্নিক মানুষ দরকার। আশাবাদী মানুষ দরকার। যাদের হাতে নতুন আগামীর ইশতেহার রচনা ও বাস্তবায়ন হবে। বিপন্ন হবে না গ্রাম, আরো সম্পন্ন হবে; আরো সমৃদ্ধ হবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি - বাংলাদেশ।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য