প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬
বিজয় দিবস! শতাংশের হিসাবে বড় জোর পাঁচ থেকে সাত ভাগ মানুষ এই দিবসটিতে হুল্লোড়ে মাতে। এখন পতাকার আদলে পোশাকও তৈরি হচ্ছে। এক শ্রেণির মানুষ তা পরছেও। শহর-নগর পতাকায় ছেয়ে যায়। রাজধানীর ভবনগুলো রঙিন আলোয় ঝলমল করে। গলির মোড়ে মোড়ে মাইক লাগিয়ে বাজানো হয় দেশাত্মবোধক গান। মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি। উদ্দেশ্যহীন ছোটাছুটি। আর শহুরে উচ্চবিত্তরা এই দিবসটিতে অঢেল অপচয়ের আয়োজন করে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গেলাসের ঠোকাঠুকিতে রঙিন হয় রাত।
আজ গেলাসের সঙ্গে গেলাস ঠুকে চিয়ার্সের বদলে— দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক, ঘুষখোর অফিসার, ওষুধে-খাবারে ভেজাল মেশানো ব্যবসাদার আহ্লাদী গলায় বলবে, ‘জয় বাংলা-আমার সোনার বাংলা’ কিংবা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। স্বাধীনতা অথবা বিজয় তো তাদেরই জন্য। বিজয়ের উৎসবে শামিল আজ তারাই। এই স্বাধীনতা তারা পেয়েছে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। প্রাপ্তির ভাঁড়ার এমন টইটম্বুর যে ভার বহন করতে সানন্দে সম্মত হয়েছে বিদেশের ব্যাঙ্ক। এরা আজ উৎসবে মাতোয়ারা হবে না তো কে হবে?
উল্টোদিকে দেশের যে লক্ষকোটি নিরন্ন বুভুক্ষু মানুষ খালি পেট-খালি পা-খালি গা-রুক্ষ চুল-কোটরে বসা চোখ-মাথায় দুনিয়ার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমোতে যাবে। গত কাল, গত পরশু-দিনের পর দিন যেমন ঘুমোতে যায়। আজ সকালে যেমন সূর্য উঠেছিল, কালও তেমন উঠবে। তবু এককণা আলো প্রবেশ করবে না তার জীবনে। প্রতিদিন গাঢ় থেকে গাঢ় হবে অকুল অন্ধকার।
আমি এই মানুষের প্রতিনিধি। আমার স্বজনরা নাসিরনগরে সর্বস্ব হারিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। আমার বোন তনু ক্ষমতাবানদের লালসার শিকার হয়ে খুন হয়েছে, অথচ সুষ্ঠু বিচার হচ্ছে না। গোবিন্দগঞ্জে আমার প্রিয় সাঁওতাল ভাই-বোনেদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে বসত-ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। খোদ পুলিশ তাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে বলে বিদেশি গণমাধ্যমে ভিডিওচিত্র দেখানো হয়েছে। তবুও রাষ্ট্রযন্ত্র নীরব। এমন না-খাওয়া, না-পাওয়া সব-হারানো মানুষের জীবনে কিসের বিজয়, কিসের স্বাধীনতা? একাত্তরের উদ্বাস্তু শিবিরের সঙ্গে আজকের নাসিরনগর কিংবা গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীর পার্থক্য কোথায়? রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কি তাদের জীবনের অভিশাপ ঘোচাতে পেরেছে? চরম সর্বনাশ থেকে রেহাই দিতে পেরেছে?
তাই আমি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ বলতে পারি না। সবার সুরে সুর মিলিয়ে ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’ গাইতে পারি না। এই বিজয়, এই স্বাধীনতা আমার চিত্তে দোলা দেয় না।
আমি যেমন দেশপ্রেমী নই, দেশদ্রোহীও নই। এ দুটোর কোনও একটা হতে গেলে আর কিছু না হোক তার কাছে একটা দেশ থাকতে হবে। আমার, আমাদের সত্যিই কি কোন দেশ আছে? এই দেশ যদি আমারই হবে, তাহলে কেন ক্ষমতাবানরা আগুন দেয় আমাদের বাড়িঘরে? কেন একজন স্কুল শিক্ষক শ্যামলকান্তিকে কান ধরে উঠবস করতে হয়? মুষ্টিমেয় মানুষের আহ্লাদী স্বাধীনতা আমাদের জীবনের বঞ্চনা আর নির্যাতনের খড়গ থেকে কী রেহাই দিতে পেরেছে? পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিতে পেরেছে? এদেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সত্যিই কী নাগরিক অধিকার পেয়েছে? তারা কি মাথা তুলে কথা বলতে পারে? বুক ফুলিয়ে চলতে পারে?
কাগজে-কলমে অনেক উন্নতির খতিয়ান দেখানো হলেও দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে এখনও জীবন বাঁচানোটাই প্রধান দায়। অনাহার, উপবাস নিত্য সঙ্গী। এই দরিদ্র পরিবারের শিশুদের যখন বই বগলে স্কুলে গিয়ে অআকখ শ্লেটে শেখার কথা, তখন তাদের কাজ হয় চায়ের দোকানে গেলাস ধোয়া, আর একটু বড় হয়ে মুটে-মজুর, ভ্যান-রিকশা চালানো। এই যে জীবন-মহান স্বাধীনতা আমাকে, আমাদেরকে যে জীবনযাপনে বাধ্য করেছে, তার শেষ পরিণতি কী হতে পারে?
পাহাড় শীর্ষ থেকে যে জল গড়িয়ে আসে, কোনও বাধা না পেলে স্বাভাবিক ছন্দে সে চলে যায় সাগরে। কিন্তু মাঝে একটা বাঁধ দিয়ে দিলে প্লাবিত করে দেবে দু’পার। এ দেশের দরিদ্র ও সংখ্যালঘুরা সাবলীল স্বাভাবিক গতিতে বইতে পারেনি। চলতে পারেনি। বসবাস করতে পারেনি। তাইতো তাদের আবিষ্কার করতে হয় অনেক অভিশাপের কেন্দ্রে। অনেকের অনেক আর্তনাদ, ক্ষয়ক্ষতির কারণ হিসেবে।
এই জীবন কারও কাছে প্রণত হতে পারে না। না খাওয়া মানুষের গলায় বাঁশির সুর বেসুরো বাজে। সে কী করে বলবে, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি? কী করে বলবে স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়?
এই মুক্ত স্বাধীন দেশের রেলস্টেশনে, ফুটপাথে কত শত দলিত-দরিদ্র মানুষ খিদের জ্বালায় ককিয়ে মরে। কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। স্বাধীনতার এত বছর পরও খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা তো দূরস্থান-সামান্য সম্মান, তা থেকেই বঞ্চিত হয়ে আছে-শুধু জন্মজনিত অপরাধে।
আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, এই দেশ, দেশের স্বাধীনতা যার কাছেই শ্রেয় হোক, আমার কাছে, আমার মতো অসংখ্য সংখ্যালঘু ও দরিদ্র মানুষের কাছে মহান কিছু নয়।
অনেকে বলে থাকেন বাংলায় কোনও বর্ণবাদ নেই। ধর্মবাদ নেই। আমরা জানি যে ভারতের বিহার, কিংবা উত্তর প্রদেশের মতো উগ্রতায় নয়-অন্তঃশীলা ফল্গুর মতো আমাদের সমাজেও তা বহমান। তেতো ওষুধকে যেমন ক্যাপসুলের মিষ্টি খোলায় ঢেকে দেয়, এখানে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, উঁচু জাত, নিচু জাত-এই বিভাজনকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ভদ্রলোক আর ছোটলোক, এই শব্দের অবগুণ্ঠনে। এখন এখানে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও গরিবরা ছোটলোক! তারা অনাকাঙ্ক্ষিত। তারা দেশপ্রেমহীন!
তাই সারা বাংলাদেশে, আজ যা কিছু উৎসব আনন্দ উল্লাস-তার সবটাই উঁচুজাত, বিত্তবান, ভদ্দরলোক শ্রেণির নিজস্ব বিষয়। আজকের এই ‘আনন্দযজ্ঞ’ ছোটজাত, ছোটলোক দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষের কাছে অনাবশ্যক অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় আয়োজন ছাড়া আর কী?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য