আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

যে রাষ্ট্রে স্বামী কখনোই ধর্ষক নয়!

শারমিন শামস্  

পৃথিবীতে ৫৩টা আশ্চর্য দেশ আছে, যেখানে বৈবাহিক ধর্ষণকে কোন অপরাধ বলে বিবেচনা করা হয় না। এইসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এই ৫৩টি দেশের মধ্যে আরো আছে ভারত, চীন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, সৌদি আরবের মত দেশ।

এদিকে পৃথিবীর ৫২টি দেশে বৈবাহিক ধর্ষণকে সুনির্দিষ্টভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে আইন হয়েছে। আর ৭৪টি দেশে সাধারণ ধর্ষণ আইনেই বৈবাহিক ধর্ষণের বিচার হয়। বৈবাহিক ধর্ষণকে সুনির্দিষ্টভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে আইন করেছে যেসব দেশ তাদের মধ্যে আমাদের প্রতিবেশি দেশ নেপালও আছে, যাকে আমরা অনুন্নত দেশ বলে ডাকি! আছে তুরস্ক, মালয়েশিয়া, বলিভিয়ার মত দেশও।

প্রশ্ন জাগে, যে ৫৩টি দেশ বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ মনে করে না, সেইসব দেশে কি বৈবাহিক ধর্ষণ বলে কোন বস্তু নাই?

আমার বোন মানবাধিকার সংস্থায় কাজ করে প্রায় দেড় যুগ। এই দেড় যুগে ওর কাছে যেসব ঘটনার বিবরণ জেনেছি তার একটা বড় অংশ হলো, বৈবাহিক জীবনে স্বামীর দ্বারা নিয়মিত ধর্ষণে অতিষ্ঠ ও অসুস্থ নারীদের জীবন কাহিনী। এইসব মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত মেয়েও যেমন আছে, আছে একেবারে অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত মেয়েও। অশিক্ষিত দরিদ্র অনেক মেয়েই স্বামীর জোরজবরদস্তি, কোন কোন ক্ষেত্রে বিকৃতিকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেবার চেষ্টা করেছে, এটাকেই নিয়ম বলে জেনেছে। কিন্তু তারপরও একটা পর্যায়ে গিয়ে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গেছে, সেও নিরুপায় হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ লিখিয়েছে, নিষ্কৃতি চেয়েছে এর হাত থেকে।

অন্যদিকে, উচ্চপদে চাকুরীরত উচ্চশিক্ষিত নারী, সেও নিজের ঘরে নিজের শয্যায় নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অহরহ ধর্ষিত হচ্ছে স্বামীর দ্বারাই। এইসব স্বামীদের অনেকেই আবার পর্ণগ্রাফি আসক্ত। ফলে যৌনজীবনকে ঘিরে তাদের রয়েছে নানারকম বিকৃতি আর অসুস্থ চিন্তা। সেই অসুস্থতা তারা চাপিয়ে দিতে চায় স্ত্রীদের ওপর। তা সে স্ত্রীর ভালো লাগুক বা না লাগুক। এক্ষেত্রে বিয়ে করা বউটি লিগ্যালাইজড সেক্সশ্লেভ, যাকে চাহিবামাত্র হাজিরা দিতে বাধ্য করা হয়। আর তা না হলে চলে নানা ধরণের মানসিক আর শারীরিক নিপীড়ন। আর নিজের স্বামীর কাছে প্রতি রাতে ধর্ষণের চেয়ে বড় শারীরিক নিপীড়ন তো আর কিছু হতে পারে না।

আমার এক বন্ধু একটি মানবাধিকার সংস্থায় কাজ করে। সেখানে একবার একটি মেয়ে আসলো অভিযোগ নিয়ে। নানা অভিযোগ তার স্বামীর বিরুদ্ধে। স্বামী বকাবকি করে, ঠিকমত সংসার খরচের টাকা দেয় না, বেড়াতে নেয় না- এরকম আরো অনেক টুকটাক অভিযোগ। তো এইসব সমস্যা জানিয়ে মেয়েটি এখন ডিভোর্স চায়। সে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে। আর ফিরতে চায় না স্বামীর কাছে। এদিকে তিনটি বাচ্চা রয়েছে। তো মানবাধিকার কর্মীরা চাইলেন মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। মেয়েটিকে বোঝালেন। স্বামীকে ডেকে পাঠালেন। দুই পক্ষের মধ্যস্থতার মাধ্যমে সংসারটা টিকিয়ে রাখা যায় কি না সেই চেষ্টা নিলেন। তো স্বামী লোকটি গদগদ হয়ে প্রতিজ্ঞা করলো এবার থেকে সে ভালোমানুষ হয়ে যাবে। বৌয়ের যা যা অভিযোগ, সব সে মেনে নিয়ে সব ভুল ঠিক করে ফেলবে। তো, তারপরও মেয়েটি ফিরতে নারাজ। সে কিছুতেই স্বামীর ঘরে যাবে না। কিন্তু আসল কারণটিও কিছুতেই বের করা যায় না।

অনেক কষ্টে নানা কাউন্সিলিং এর পর আবিষ্কার হলো আসল কাহিনী। প্রতি রাতে স্বামীর নিত্যনতুন বিকৃতির খোরাক মেটাতে গিয়ে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত মেয়েটি। স্বামী তাকে প্রতি রাতে বলে, ‘আজ তুমি অমুক নায়িকা, আজ তুমি তমুক পর্ণস্টার। এইবার ওদের মত কর।’ এখন মেয়েটি সে মত করতে না চাইলে বা না পারলেই তাকে সেই শয্যাতেই অকথ্য গালিগালাজ করা হয়। আর স্বামীর আরো নানা আজগুবি আবদার তো আছেই। মেয়েটি এতদিন জেনে এসেছে, স্বামী মাত্রই এইরকম। স্বামী যা চাইবে, স্ত্রীরাও তাই করতে বাধ্য। তাই এই বিষয়গুলো যে অভিযোগ আকারে বলা যেতে পারে, সেটাই সে জানতো না। সে ভেবে আসছিল, সে যে মেনে নিতে পারছে না, সেটা তারই অপরাধ। যাই হোক, সেই ঘটনার সমাধানটা কী হলো? সমাধান হল, স্বামী নামের লোকটাকে শাসানি দিয়ে সোজা করার চেষ্টা করলেন মানবাধিকার সংস্থার লোকজন। কিন্তু কুকুরের লেজ কি এত সহজে সোজা হয়! মেয়েটা তিন সন্তানের টানে ফিরে গিয়েছিল সংসারে। এবং এখন পর্যন্ত সেই বিকৃতির খোরাক মিটিয়ে চলেছে সম্ভবত। দেশে এমন কোন আইন নেই, যা ওই বিকৃত ধর্ষক স্বামীটিকে শাস্তির আওতায় আনবে এবং মেয়েটিকে মুক্তির পথ দেখাবে।

বিবাহিত ধর্ষণ এদেশের আইনের চোখে অপরাধ নয় বলেই, বিয়ের নামে কিছু পুরুষ ধর্ষণের বৈধতা পেয়েছে বলে মনে করে। তারা স্ত্রীকে জীবনসঙ্গী নয়, যৌনদাসী ভাবে। স্ত্রীর ইচ্ছা, অনিচ্ছা, ভালো লাগা, খারাপ লাগা, অসুস্থতা কোন কিছুই তারা গ্রাহ্য করতে বাধ্য নয়। মেয়েটির যৌনসুখের দিকেও তারা বিন্দুমাত্র লক্ষ্য রাখে না। এই সব পুরুষের বিবাহিত জীবনের যৌনতা তার একার উপভোগের- এক্ষেত্রে স্ত্রী সেবাদাসী, যার নিজস্ব কোন চাহিদা বা পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে না।

আমি একবার কোন একটি লেখায় বিবাহিত ধর্ষণ সম্পর্কে প্রসঙ্গক্রমে মাত্র দুই তিনটি বাক্য লিখেছিলাম। তো কিছু পুরুষ আমাকে তুলোধোনা করলো এই বলে যে, ‘‘এই লেখকের কি মাথা খারাপ? স্বামী বৌয়ের সাথে শুলে রেইপ হয়! এইটা কী ধরণের কথা!”

তো যে স্বামীরা বিবাহিত জীবনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে, তারা সেটাকে বৈধ মনে করে। মানে কলেমা পড়ে, মন্ত্র জপে কিংবা গির্জায় গিয়ে শপথ করে, দেনমোহরের দামে তারা যে নারীটিকে নিজের অধিকারে নেয়, জীবনভর নিজের উত্তেজনার উদ্রেক হওয়ামাত্র শয্যায় শুয়ে পড়ার দাসখত তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। এই দাসখত নারীও মেনে নেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। অধিকাংশই জানে না যে, এই দাসখত অবৈধ। কেউ কেউ প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ করলে জোটে লাথি ঝাঁটা জুতোর বাড়ি। আর কোন কোন মেয়ে লজ্জায় সংকোচে জীবনভর লুকিয়ে রাখে স্বামীর পাপাচারের কাহিনী। আর যারা মুক্তি চায়, অত্যাচারের প্রতিকার চায়, স্বামীর বর্বরতার বিরুদ্ধ দাঁড়াতে চায়, রাষ্ট্র এবং আইন তাদের পাশে নেই।

রাষ্ট্রও মনে করে, বিয়ে করে স্বামী অধীনস্থ দাসী হওয়াই মেয়ের জীবনের মূল লক্ষ্য। এটি তারা ভাঙ্গলে পারিবারিক কাঠামোতে ঝামেলা তৈরি হবে- এ ধরণের কিছু খোঁড়া ও সেকেলে যুক্তি টেনে এনে রাষ্ট্র ক্রমাগত নারীকে ধর্ষণের পক্ষে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

বিবাহিত নারীর ধর্ষণের যন্ত্রণার কথা তাই কোথাও লিপিবদ্ধ হয় না। এখন তো আরো হবে না। বিশেষ বিধান টেনে এনে ১৬ বছরের কিশোরীকে ঢুকিয়ে দেয়া হবে আধবুড়োর খোঁয়াড়ে। তারপর দিনমান ধর্ষণ আর বিকৃতির যে মহোৎসব চলবে, তা রাষ্ট্রের চোখে বৈধ, পবিত্র। রাষ্ট্রের কাছে তা পারিবারিক জীবন। কারণ পুরুষের সুখ এবং স্বেচ্ছাচারই পরিবার, সমাজ, ধর্ম এবং রাষ্ট্রের বৈধতার সংজ্ঞার ভিতরে সাড়ম্বরে স্থান পায়, মর্যাদা লাভ করে। আর এই সুখ ও স্বেচ্ছাচারকে সেবা দিয়ে দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে বিলীন করে দেবার শিক্ষা দেয়া হয় এই নোংরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যেকটা মেয়েকে!

জানি না, কবে এই মেয়েরা নিজেদের দাসত্বকে ঘৃণা করতে শিখবে। জানি না কবে বিবেক জাগ্রত হবে ‘নারীবান্ধব’ পরিচয়ে গলা-ফাটানো এই রাষ্ট্রের!

শারমিন শামস্, লেখক, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ