প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
দেব প্রসাদ দেবু | ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬
২০১৫ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় রাখা হয়নি সালমান রুশদি এবং তসলিমা নাসরিনকে। আয়োজকরা বলেন-‘অসম্ভব। কলঙ্কিত লেখকদের ডেকে আমরা কলকাতার মুখ পোড়াতে চাই না।’ প্রবল প্রতিক্রিয়া হয় শহর জুড়ে; ফেসবুকে-টুইটারে। যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের ডাকে পর দিনই অ্যাকাডেমির সামনে ‘আবার হোক কলরব’ আন্দোলন শুরু। তসলিমা ও রুশদিকেই কলকাতা বইমেলার উদ্বোধনে আমন্ত্রণ জানানো হোক- দাবিতে বহু সাধারণ মানুষ কলেজ স্ট্রিটে গিল্ড অফিসের সামনে ধর্নায় বসেন। ২৫ জানুয়ারি আয়োজিত মৌন মিছিলে অভূতপূর্ব জনপ্লাবন। মিছিলের শেষ সভায় শপথ পড়া হয়: তসলিমা ও রুশদিকে এই বইমেলায় আমন্ত্রণ না জানানো হলে আমরা একজনও বইমেলায় যাব না। এটাই প্রতিবাদ।
২৬ জানুয়ারি বইমেলা উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কিছু মাওবাদী গোলমাল পাকাচ্ছে। ও-সব ছোট ঘটনা, পাত্তা দেবেন না। কিন্তু পর দিন মেলা শুরু হতেই দেখা যায়, সব স্টল খোলা, একজনও ক্রেতা নেই। বাইরে চিপস-ফুচকা-ঝালমুড়িওলাদের সামনে অজস্র লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন, অথচ কেউ গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকছেন না। মাইকে বার বার ‘বই কেনায় ৭০% ছাড়’ ঘোষণা করেও লাভ হয়নি। পর পর তিন দিন এই একই ঘটনা।
যে বইমেলায় রোজ কয়েক লক্ষ মানুষ আসতেন, সেখানে গুটিকয় মন্ত্রী, আমলা ও গিল্ড-কর্তা ছাড়া কেউ নেই। বিশাল চত্বর খাঁ খাঁ। ফুড পার্কের স্টল-মালিকরা অভিযোগ জানান, তিন দিনের সব খাবার নষ্ট হয়েছে। সব প্রকাশনীর সদস্যরা গিল্ড-সম্পাদকের সঙ্গে সভায় জানান, তাঁদের একটা বইও বিক্রি হয়নি। এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী গিল্ড-কর্তাদের সঙ্গে নবান্নে জরুরি বৈঠক শেষে প্রেস মিট-এ ঘোষণা করেন, বইমেলা এক মাসের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হল। ২৬ ফেব্রুয়ারি আবার বইমেলার উদ্বোধন হবে, উদ্বোধন করবেন তসলিমা ও রুশদি। [সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা]
আর আমরা কী করেছি? অভিজিৎ খুন হলেন, আমরা নাচতে নাচতে হাত ধরাধরি করে মেলায় ঘুরলাম। রোদেলা বন্ধ হলো, ক্যায়া ফারাক পড়তা হ্যায়! ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারীকে কোমরে রশি বেঁধে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা আনন্দ ফুর্তি করে মেলায় সেলফি তুললাম। মুষ্টিমেয় মানুষ সেদিন প্রতিবাদ করেছিলেন। লক্ষ পাঠক, হাজারো লেখক, শত প্রকাশক হাতে চুড়ি পড়ে, মুখে কুলূপ এঁটে ছিলেন। ফলাফল হিসেবে দীপনকে জবাই করা হলো, টুটুলকে কোপানো হলো। আমরা মজে থাকলাম খুনসুটি নিয়ে। ফলাফল সেই মুষ্টিমেয় প্রতিবাদকারীদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করেছে বাংলা একাডেমি। দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে শ্রাবণ প্রকাশনীকে। বাহ্! এইতো আমাদের একুশের চেতনা। এইতো আমাদের একুশ মানে মাথা নত না করা!
বাংলা একাডেমি কারো পৈত্রিক সম্পত্তি নয়, কারো পৈত্রিক জমিদারী নয়। জমিদারী মেজাজে সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা ওটা নয় মাননীয় মহাপরিচালক। আপনি তিন মেয়াদে সরকারের কোন কোন এজেন্সির আস্থাভাজন হয়ে চেয়ার আঁকড়ে আছেন মানুষ সেটা জানে। কিন্তু এই নতজানুতা না দেখিয়ে আপনার দরকার ছিলো বাংলা একাডেমিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে, সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে সাহায্য করা, আপনি সেটা না করে বারে বারে নতজানু হয়েছেন, স্বেচ্ছাচারী হয়েছেন, বাধাগ্রস্ত করেছেন মুক্তচিন্তাকে। আপনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়েও জানেন না ব্যক্তির প্রতি বিরাগভাজন হয়ে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া যায় না। সেটা না জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আজ থেকে প্রায় ৪০ দিন আগে। কিন্তু এটাও আপনি জানেন না যে, কোন প্রতিষ্ঠান একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলে বিপরীতপক্ষকে সেটা অফিসিয়ালি জানাতে হয়, আপনাদের সিদ্ধান্ত অফিসিয়ালি শ্রাবণ প্রকাশনীকে জানানো উচিৎ ছিলো, আপনারা জানাননি। আপনারা এটাও জানেন না যে, কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হয়, তার অপরাধ কী সেটা জানাতে হয়, আপনারা সেটাও করেননি। বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য এটা লজ্জার। দয়া করে আপনি আর মোসাহেবি করে চেয়ারে বসে থাকবেন না, পদত্যাগ করুন। বাংলা একাডেমিকে বাঁচতে দিন, বাংলাকে বাঁচতে দিন, মুক্তচিন্তাকে বাঁচতে দিন, বাক-স্বাধীনতাকে বাঁচতে দিন।
অন্যদিকে বধির হয়ে আছেন আমাদের প্রজ্ঞাবান লেখককুল, আমাদের প্রকাশক নেতারা। এমন ভাব যেনো কিছুই হয়নি। কিংবা এগুলো নিয়ে হৈচৈ করার মানে নেই। উট পাখির মতো মুখ লুকিয়ে বাঁচাই উত্তম। খামোখা গণ্ডগোল করে কী লাভ! হ্যাঁ, সমাজের অধিকাংশ মানুষই এখন আন্দোলন মানে বুঝে গণ্ডগোল। এই রোগ নতুন নয়। পুরোনো। একাত্তর সালেও মুক্তি সংগ্রামকেও অনেকে গণ্ডগোল ভেবেছিলো। এখনো বলে 'গণ্ডগোলের সময়'। এই মানসিকতা ছাড়ুন। ছাপোষা আলু পটল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেদের না ভেবে প্রকাশকরা এগিয়ে আসুন। রাজদরবারের আনুকূল্যের আশায়, 'গণ্ডগোলের' ভয়ে গুটিয়ে না থেকে সম্মানিত লেখক মহাশয়রা এগিয়ে আসুন, আপনারা আসলে মাঠে পাবেন হাজারো সাধারণ মানুষকে। মনে রাখবেন নেহাত টু-পাইস কামাতে আপনারা সৃজনশীল বই লিখেন না, সমাজকে জাগাতে লিখেন। সেই সমজাকে কুঁজো হতে শেখাবেন না দয়াকরে। আমাদের সবারই শিরদাঁড়া সোজা করা দরকার, আজকাল বড্ড বেঁকে আছে ওটা। বেঁকে আছে বলেই দেখতে পাচ্ছেন না মাথার উপর দিয়ে কী চলে যাচ্ছে।
আজ শ্রাবণ নিষিদ্ধ হয়েছে, কাল অন্যটা হবে, পরশু হয়তো আপনার বইই নিষিদ্ধতার কবলে পড়বে। তাই সবাই মিলে জাগতে হবে, উঠতে হবে, দাঁড়াতে হবে শক্ত করে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য