আজ বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

Advertise

কেমন গেলো ২০১৬

রেজা ঘটক  

বাংলাদেশের জন্য ২০১৬ ছিল একদিকে একটি আতংকের বছর। অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু সাফল্যও ধরা দিয়েছিল এ বছরে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ২০১৬ ছিল বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের চরম উত্থানের জন্য সবচেয়ে কলঙ্কিত একটি বছর।

২০১৫ সালে ঢাকার গুলশানে এক ইতালি নাগরিককে হত্যা ও রংপুরে এক জাপানি নাগরিককে হত্যাসহ প্রকাশ্যে লেখক, ব্লগার, প্রকাশককে হত্যা দিয়ে জঙ্গিবাদের যে উত্থান শুরু হয়েছিল, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানের সন্ত্রাসি হামলা দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের চরম উত্থান প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৬ সালে।

১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান হোটেল জঙ্গি হামলায় ১৮ জন বিদেশী নাগরিক, ২ পুলিশ কর্মকর্তা, ৫ জঙ্গিসহ মোট ২৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। পুরো বছরই ছিল বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার এবং জঙ্গিদের পুনঃ-উত্থানের বছর। শিক্ষিত তরুণের পাশাপাশি বাংলাদেশের নারীদের এ বছর জঙ্গিবাদে জড়িত হবার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গি-গোষ্ঠী যেমন ইসলামিক স্টেট বা আইএস, আল কায়েদার উপস্থিতি বা তাদের অনুসারী বাংলাদেশে রয়েছে বলে সারা বছর নানান সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। গোটা বছরে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গি হামলায় বিদেশী নাগরিক, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যাজক-পুরোহিত, শিক্ষক, লেখক, ব্লগার হত্যাসহ ভিন্ন ধর্মাবলীদের উপাসনালয়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।

পাশাপাশি বাংলাদেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গেল বছরে একটি নতুন ধারা যোগ হয়েছে৷ পুলিশের এসব জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নব্য জেএমবি নেতা তামিম চৌধুরীসহ অন্তত ৩৫ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় ছিল যে, এসব জঙ্গিদের মধ্যে তরুণ বয়সী জঙ্গি ছাড়াও নারী জঙ্গি ছিল। এখনো পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকলেও নব্য জেএমবির ‘চিন্তা গুরু' মেজর জিয়া এবং নতুন প্রধান মুসা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। গোটা বছর এসব জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলার কারণে দেশের অর্থনীতি যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

গোটা বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন উল্লেখযোগ্য অস্থিরতা না থাকার কারণে কিছুটা রাজনীতিহীন নিস্তরঙ্গতায় কেটেছে ২০১৬ সাল। তবে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কাউন্সিল অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনের এক ধরনের প্রস্তুতির লক্ষ্য স্থির করেছে এ বছরে। বছরের শেষ-পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনটি ছাড়া ২০১৬ সালে সারা দেশে অনুষ্ঠিত পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ নির্বাচনগুলো ছিল নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৬ সাল ছিল স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় দুর্বৃত্তায়নের চরম অশুভ উদ্যোগ। বলা যায়, স্থানীয় নির্বাচনও এ বছর জাতীয় নির্বাচনের মত বিতর্কিত হয়ে গেল!

ইতোপূর্বে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংঘটিত বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে ২০১৬ সালে যুক্ত হয়েছিল স্বয়ং বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ লোপাটের ঘটনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা এ বছর দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। শেয়ার বাজার কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও শেয়ার বাজারের প্রতি ভোক্তার আস্থাহীনতা এখনো দূর হয়নি। জিনিসপত্রের দাম ছিল বছর জুড়েই উর্ধ্বমুখী। যদিও সরকারি তরফে সাবসিডি দিয়ে কম দামে চাল বিক্রির প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে তা ছিল নগণ্য!

২০১৬ সালে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের জন্য এ বছর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চূড়ান্ত চুক্তি সম্পাদন ও মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু বড় বড় প্রকল্প গ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। কাগজে কলমে এ বছর বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে বিদেশী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্কে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে এ বছর চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে’র বাংলাদেশ সফর ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আগস্ট মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি'র ঢাকা সফর দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়া বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বান কি মুন এ বছর বাংলাদেশ সফর করেছেন। তবে বছরের শেষ-পর্যায়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে সৃষ্ট নতুন সমস্যা বাংলাদেশকে কিছুটা কূটনৈতিক চাপে রেখেছে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক ছিল না। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো বছর জুড়েই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বছর জুড়েই খুন, হত্যা, গুম, জোর করে উঠিয়ে নেয়া, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুসহ মানবাধিকার পরিস্থিতির নানান ক্ষেত্রে অবনতির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ছিল বছর জুড়েই খুব আলোচিত ঘটনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলা এবং গাইবান্ধায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের উপর হামলা ছিল চরম ন্যক্কারজনক। এসব হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও এখনো কোনো বিচার পাওয়া যায়নি।

আগের বছর একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর চলতি বছর অপর যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর ছিল বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। পাশাপাশি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা ছিল বছরের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ড। আর বছরের শেষ দিন (৩১ ডিসেম্বর ২০১৬) গাইবান্ধায় সরকারি দলের সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন নিজবাড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নতুন প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

সব মিলিয়ে ২০১৬ সালটি বাংলাদেশের জন্য একদিকে ছিল জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের চরম উত্থান ও মোকাবেলার বছর। অন্যদিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে অর্থনীতি কিছুটা গতিশীল থাকলেও বছর জুড়ে বিদেশী বিনিয়োগ খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারেনি বাংলাদেশ। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে চীন ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া তেমন কোনো অগ্রগতি নজরে পড়েনি। ব্যাংকিং সেক্টরের চরম একটা হতাশার বছর গেছে ২০১৬ সালে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির টাকা আংশিক ফেরত পেলেও এখনো বেশিরভাগ টাকা ফেরত পাবার মত প্রত্যাশা তৈরি হয়নি। যে কারণে ২০১৬ সালটি বাংলাদেশের জন্য ছিল সত্যিকারভাবেই এক চরম উদ্বেগ ও হতাশার বছর। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, সরকার যদি ২০১৭ সাল আরো দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন করে অস্থির হওয়ার আশংকা থাকবে নতুন বছরে।

রেজা ঘটক, সাহিত্যিক, নির্মাতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৪ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন