আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ বনাম শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

জুয়েল রাজ  

মুক্তিযুদ্ধের আগে ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় মানুষ শ্লোগান দিত তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব, এক নেতার এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। মুজিব হত্যার পরিণাম বাংলা হবে ভিয়েতনাম, সর্বশেষ এই শ্লোগান দিয়েছিল আমাদের প্রজন্ম। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে নিজের জীবন তুচ্ছ করে কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা।

সারাদেশে বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে তুলে দেয়া হয়েছে পাঠ্যবই। বিগত কয়েক বছর ধরেই এই প্রচেষ্টা চলছে। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এই কার্যক্রম। পৃথিবীর কোন উন্নত দেশে এই ব্যবস্থা আছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু সেই শুভ কাজটিকে অশুভ করে তুলছে এর সাথে জড়িত গোষ্ঠী। পাঠ্য বই জুড়ে অগণন ভুল, বদলে দেয়া হচ্ছে কবিতার লাইন। শিশুদের জন্য বর্ণ শিক্ষার বই তো ইসলামী শিক্ষার বইয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লেখা ‘‘শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’’ বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনাকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর এই পায়তারা কেন?

আপাতদৃষ্টিতে এই কথায় কোন সমস্যা নেই। শেখ হাসিনার আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে আজকের শিশুরাই নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, সুদূরপ্রসারী দুষ্ট পরিকল্পনা থেকে এই কাজটি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছে এরা। একটা উদাহরণ যদি দিই, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর বয়স যাদের বিশ ত্রিশ বছর বা তারও বেশি একবার স্মরণ করার চেষ্টা করুন আপনার ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত কবিতাগুলো মনে করতে পারেন কিনা? দেখবেন বেশীরভাগ কবিতাই এখনো আপনি মুখস্থ বলে দিতে পারবেন। এবার চেষ্টা করে দেখুন মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টি কবিতা আপনি মনে করতে পারেন? দেখবেন মনে করতে পারছেন না বা পারলে ও দুচার লাইনের পরে ভুলে গেছেন। স্মৃতিশক্তি গঠনের সময়ের শিক্ষাগুলো আজীবন থেকে যায়।

আজকের শিশুদের যে শিক্ষা দেয়া হবেই সেটাই আজীবন সে বয়ে নিয়ে বেড়াবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি আমরা দেখেছি ৭৫ পরবর্তী সময়ে। একটা প্রজন্ম এখন মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভুল তথ্যই বিশ্বাস করে। একটা প্রজন্মকে আবার ও বিভ্রান্ত করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হিসাবেই শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নামক এমন শ্লোগানের উৎপত্তি। আর বঙ্গবন্ধুর নামের পাশে শেখ হাসিনাকে জুড়ে দেয়া হয়েছে, যাতে করে কোন বিতর্ক করার অবকাশ না থাকে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পরিবর্তনের একটা প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছিল সাদাকালো ভাষণ রঙিন করার নামে। পাঠ্যবইয়ে, কবিতায়, নাটকে গল্পে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ ছিলেন, তখনো এই ধরণের কমিটি ছিল। গোলামী করতে করতে, জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর করতে করতে এদের মেধা মনন পচে গেছে। অন্যদিকে আরেক দল আছেন যারা প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার রাজনীতির কথা বলেন। এদের রাজনৈতিক মতাদর্শ আর কট্টর জামায়াতি রাজনীতির মৌলিক খুব বেশী পার্থক্য নেই। আওয়ামী বিরোধিতা করা, বঙ্গবন্ধুকে কোন না কোন ভাবে চামে চিপায় সাধারণের কাতারে নিয়ে আসা। আর সর্বোপরি ভারতের বিরোধিতা করা। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ও আছেন। আর ব্যতিক্রম কখনো নিয়মের ভেতরে পড়েনা।

আগামীতে যখন জাতীয় সঙ্গীত বদলে দিবে, ৭ মার্চের ভাষণ বদলে দিবে, সংবিধান বদলের নমুনা তো বাংলাদেশ বয়ে বেড়াচ্ছে। ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে পারেনি বাংলাদেশ। ধর্ম নিরপেক্ষতা এখনো সন্নিবেশিত করা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে বলেছিলেন আমার বাংলাদেশ, আমার মানুষরা তাঁর তাঁর ধর্ম নিঃসংকোচ চিত্তে নির্বিঘ্নে আনন্দের সহিত পালন করবে। কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতার একটা চারা রোপণ করেছি, কেউ যদি এই চারাটি উপড়ে ফেলতে চায় বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। সেই সংকটে আজকের বাংলাদেশ। লালন ভাস্কর্য, বলাকা ভাস্কর্য কিছুই আমরা রাখতে পারিনি, এবার হাইকোর্টের সামনে থাকা ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে ফেলার দাবী তুলেছে একদল ধর্মান্ধ ।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ে যদি ছাপার ভুল থাকত ভয় ছিলনা। ইচ্ছাকৃত বিকৃতি ভয়টা বাড়িয়ে দিয়েছে। সংশোধন করা যেত। কিন্তু পাঠ্যবই কার্যক্রমের নেপথ্যে যারা বসে আছেন তাদের মানসিক বিকৃতি কি ছাপাখানায় সংশোধন যোগ্য? ভয়টা সেখানেই। তাদের মনন ও মানসিকতার একটা বার্তাই তারা বাংলাদেশকে পৌঁছে দিলেন। হিন্দু লেখকের লেখা রাখা যাবে না, হুমায়ুন আজাদের মত বিশ্ববরেণ্য ভাষাবিদের কবিতা পড়ানো যাবেনা। তারপর একদিন দাবী তুলবে বাংলা হিন্দুয়ানী ভাষা, বাংলায় বই ছাপানো যাবে না, আরবিতে রচিত বই পড়াতে হবে।

এই পাঠ্যবই সংশোধনের কথা উঠলেই এখন আবার ৯০ ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের বিতর্ক চলে আসবে, ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করবে নিশ্চিত। সরকার ভোটের রাজনীতিতে সেই দাবী মেনে নিলে ও কিছু করার থাকবেনা। অতীতে এইভাবেই উগ্র ধর্মীয় সংগঠনগুলো তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে।

সরকারে আওয়ামী লীগের বর্তমান শক্ত অবস্থানের মূল কারণ হিসাবে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অনেকেই বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন, জঙ্গিবাদ রোধে শেখ হাসিনার সরকারের সফলতাই মূল কারণ। কারখানা চালু রেখে বাজার থেকে যেমন পণ্য সরানো যায়না, তেমনি জঙ্গি নিধন করে জঙ্গি সমস্যা নিরসন সম্ভব নয়। জঙ্গির কারখানা বন্ধ করতে হবে। যেখান থেকে উৎপন্ন হচ্ছে জঙ্গিবাদ সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। হেফাজত চরমোনাই পীরের দেখানো ইসলামী বাংলাদেশ হবে, নাকি বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের ত্যাগ তিতিক্ষার স্বপ্নের বাংলাদেশ হবে তা আবার নতুন করে ভাবতে হবে।

মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের জন্মের ইতিহাস অনেকেই জানেন, মথুরার রাজা কংস দৈববাণী শুনেছিলেন তাঁর বোন দৈবকীর ঔরসজাত সন্তানই তাকে বধ করবে। কংস বোন ও বোনের স্বামীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন। তাদের সন্তান প্রসব হওয়া মাত্র সেই সন্তানকে কংস হত্যা করত। দৈবকী এবং বাসুদেব দম্পতির অষ্টম সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হয়, ঝড় বৃষ্টির কালো রাতে, দৈববাণী হলো, “বাসুদেব, তুমি এখনই গোকুলে যেয়ে নন্দের স্ত্রী যশোদার পার্শ্বে তোমার ছেলেটিকে রেখে এসো এবং এই মুহূর্তে তার যে কন্যা শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তাকে এনে দেবকীর কোলে শুয়ে দাও। আমার মায়ায় পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এখন গভীর ঘুমে অচেতন, যার ফলে কেউ কিছুই জানতে পাবে না।” সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে নিয়ে বাসুদেব ছুটতে লাগলো নন্দের বাড়ীর দিকে। কিছু সময়ের মধ্যে বাসুদেব তার ছেলেকে যশোদার কোলে রেখে যশোদার কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এল। সকাল বেলা কংস খবর পেল দেবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে চলে এসে দেবকীর কোল থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিয়ে একইভাবে পাথরের উপরে আছাড় মারতেই মেয়েটি শূন্যে উঠে যেয়েই যোগমায়া মূর্তি ধারণ করে। মহাশূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বে কংসকে বলে গেলো, “তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বেড়েছে সে”।

এখন শ্রীকৃষ্ণের সেই দ্বাপর যুগ নাই। কলিকাল চলছে, দৈববাণীর অবকাশ নেই কোন যোগমায়াও জন্ম নেবেনা। তাই যা কিছু করতে হবে শেখ হাসিনাকেই করতে হবে। এই কংসমামাদের বধ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি বিলুপ্ত করে দিয়ে এদের জবাবদিহির মুখোমুখি করুন। শেখ হাসিনার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ে উঠুক। বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কোন বিষয় পূর্ণতা পাবে না। আর এটাই বাস্তবতা এটাই ইতিহাস।

আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি বিশ্বের এক নম্বর নেতা ও হয়ে যান, তাও বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা মেধায়, মননে রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুকে পিছনে ফেলে সামনে চলে গেছেন। তাই বলে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড় নন নিশ্চয়। তাই শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ শিক্ষা দেয়া হউক শিশুদের।

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ