আজ মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

আমাদের কুকুর ক্যানি

ভায়লেট হালদার  

ঠাকুরদা’র আমল থেকে আমাদের বাড়িতে কুকুর পোষা হত। আমার বাবা তখন ছোট তার কুকুরের নাম ছিল হান্টার, দেখতে ছিল রাগী আর তেজস্বী, ঠিক বাঘের স্বভাব। হান্টার ছাড়া থাকলে কেউই বাড়ীর ভেতরে ঢুকতে পারতো না। আমার পিসিমার মুখে শুনেছি, হান্টারের লেজ থেকে পশম কেটে নিয়ে বাবা তুলি বানিয়েছিল, সেই থেকে তার ছবি আঁকার হাতেখড়ি। কোন একদিন প্রতিবেশীর দেয়া বিষযুক্ত খাবার খেয়ে হান্টার মারা যায়। এর পরে আমার বড়বোনও একটা কুকুর পুষতো। আপু তার নামও রেখেছিল হান্টার। আমরা দু’বোন তখন বেশ ছোট। হান্টারের গোসল করানো, খাবার দেয়া এসব দায়িত্ব আপু করতো।

হান্টারের পরে অনেকদিন আমাদের বাড়িতে কুকুর পোষা হত না। আমি ও ছোটবোন রাস্তা থেকে তুলে একটা কুকুরছানা বাড়িতে নিয়ে আসি। তখন ওর বয়স দুই কি তিন সপ্তাহ হবে। মা তো গেল ক্ষেপে। মা যতই রাগ প্রকাশ করছে ততই আমাদের মায়াদয়া ওর উপর বেড়ে যাচ্ছে। তখনও ছোটবোন আমাকে মেজদি বলে ডাকতে শুরু করেনি, আমরা দু’জন দু’জনকে ভাইয়া বলে ডাকতাম।

মা আমাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিল, ‘কুকুর পোষা চাট্টিখানি কথা নয়, বাচ্চাদের মত ওদেরও যত্ন করতে হয়, নিয়মিত গোসল করাতে হয়, পশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভ্যাক্সিন দিতে হয়। খাবার দেয়া ও নিয়মিত বাসন পরিষ্কার করতে হয়। ওর থাকার জন্য জায়গা দিতে হবে ও প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে, আমার পক্ষে তিনজনকে পোষা সম্ভব না। তাছাড়াও এটাকে বাড়িতে রাখলে তোমরা লেখাপড়া শিকেয় তুলে ওকে নিয়ে পড়ে থাকবে। সুতরাং যেখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে এসেছো সেখানেই ছেড়ে দিয়ে আসো।’

আমি আর ছোটবোন নাছোড়বান্দা। ইতোমধ্যেই আমরা ওর জন্য নাম ঠিক করে ফেলেছি। নাম দিলাম ‘ক্যানি’। দেখতে সাদা-কালো ছোপ ছোপ গায়ে, নাক ও মুখের পাশে পুরোটাই কালো রঙের, মুখ আদুরে ও মায়াবী। ক্যানি আসার পর থেকে আমাদের গা ঘেঁষে বসে আছে কোন ধরনের চিৎকার বা ডাক দিচ্ছে না। যেন মায়ের বলা কথাগুলো থোরাই কেয়ার করছে। ছোটবোন বলল, ‘ভাইয়া আমাদের তবু মা আছে, ওর তো কেউ নাই। ওকে ছেড়ে দিয়ে আসলে কি খাবে, এতটুকু শিশু কি মা ছাড়া বাঁচতে পারে!’

বললাম, ‘ঠিকই তো বলেছিস, মা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে, একটা কুকুর পুষলে কি এমন খাবার আমাদের ধ্বংস হবে!’ মা আমাদের লক্ষ্য করছিল আর আমাদের কথা শুনছিলো। জানিনা কি কারণে মায়ের মন কিছুটা নরম হলো।

এবার মা বলল, ‘তোমরা ওকে পুষতে পারো, তোমাদের খাবার আমি ওকে দিয়ে দেবো। হয় তোমরা খাবে না হয় তোমাদের কুকুর খাবে।‘ আমরা কোন কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম, `ওকে মা, আমাদের খাবার দরকার নাই; আমরা না খেয়ে থাকতে পারবো তবুও আমরা ক্যানিকে কিছুতেই ছেড়ে আসতে পারবো না। সেদিন সত্যি সত্যি মা দুপুরবেলার আমাদের খাবার ক্যানিকে খেতে দিয়েছিল আর আমরা দুবোন দুপুরের খাবার খেতে পাইনি, সন্ধ্যে অবধি থাকতে পেরেছিলাম, খুব ক্ষুধা পেটে তবুও মা’কে বলতে পারিনি খেতে দাও।

দু’বোন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার মা’কে বলবো আমাদের একবেলার খাবার ক্যানিকে দাও, আরেকবেলার খাবার আমরা খাবো। মা’কে আর বলা হয়নি, সন্ধ্যের পরপরই মা আমাদের ডেকে খাবার দিল। একবেলা না খেয়ে থাকার কষ্ট সেদিন বুঝছিলাম। মা জেনে শুনে বুঝেই সেদিন আমাদের খেতে দেয়নি অনেক পরেই তা বুঝতে পেরেছিলাম। আমাদের ক্যানির প্রতি ভালবাসা কতটুকু মা হয়তো দেখছিলেন। পরেরদিন সকালে মা একটা সাবান, পুরানো একটা গামছা দিয়ে বলল ক্যানিকে স্নান করিয়ে কিছুক্ষণ রোদে রাখতে, আর স্নানের সময় জল যেন ক্যানির কানের মধ্যে না ঢোকে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে। সপ্তাহে দুইদিন ক্যানিকে স্নান করাতাম। পুরোনো জামা কেটে ওর জন্য জামা বানাতাম। ক্যানির জন্য একটা থালা খাবারের জন্য আর একটা মাটির শানকি জলপানের জন্য দেয়া হলো। আর লাকড়ির ঘরের একপাশে ওর থাকার জায়গা হলো। পাটের চটের ছালা পুরনো কাপড় এসব দিয়ে বানানো হল বিছানা। আমরা যা খেতাম সে একই খাবার তাকেও দেয়া হত। খাবারের পরে তার বাসন আমি আর ছোটবোন পরিষ্কার করতাম। আমাদের সাথে বিকেলবেলা খেলতো। তবে বাড়ির মধ্যে কারো ঢোকা খুব মুশকিল ছিল তার ভয়ে যদি না আমরা তাকে আটকাতাম। কামড়াতো না তবে লাফ দিয়ে ঘাড়ে উঠতো মানুষের আর তার শক্তিশালী ঘেউ ঘেউ ডাকে মানুষ ভয় পেয়ে যেত। যেন ও ছিল একমাত্র বিশ্বস্ত পাহারাদার আর পাহারা দেয়াই ছিল ওর কাজ।

আমরা কেউই ক্যানিকে শিখাইনি যে রাত জেগে থেকে ওকে বাড়ির চারপাশ ঘুরে ঘুরে পাহারা দিতে হবে। এভাবেই কেটে যায় কয়েকটি বছর। হঠাৎ একদিন দেখি ক্যানির মুখ থেকে লালা ঝরছে, বুঝতে আর বাকি রইলো না, কেউ ওকে বিষ দিয়েছে। বিদায় নিল ক্যানি। এরপর থেকে আমাদের বাড়িতে আর কেউ কোনদিন কুকুর পোষেনি।

সময়ের ব্যবধানে আমাদের পোষা ক্যানি, হান্টারদের বিষ দিয়েই হত্যা করা হয়েছে। আমার সাদা-কালো ভাবনায় জগতে ক্যানি একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে আছে।

কয়েকদিন আগে খবরে দেখলাম, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কুকুর হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। একের পর এক আমাদের পোষা কুকুরের মুখগুলো ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। ওরা তো কারো ক্ষতি করেনি। কেউ তো ওদের দায়িত্ব পালন করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠেনি। ওরা তো ঠিকানাবিহীন ঘুরে বেড়ায়। কেউ খেতে দিলে খায়, নয়তো চুপচাপ রাস্তার পাশে শুয়ে থাকে করুণ চোখে অভিযোগহীন। তবুও ওদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো কেন? নাকি কুকুর নিধনের মধ্য দিয়ে শুরু হলো পশু নিধন! বাদ যাবে না সুন্দরবনের পশুরাও।

যেখানে প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে, মানবিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, সে দেশে পশুপাখি-বান্ধব ও পরিবেশ-বান্ধব পাবো কোথায়?

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৪ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ