প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ আঙিনায় আবার ফিরে এলো সেই চেনা সুর, চেনা গন্ধ। উন্মুক্ত বিশাল চত্বর জুড়ে হালকা হিমেল বাতাসে উড়ছে নতুন বইয়ের গন্ধ। নতুন বইয়ের টানে হাজারো মানুষ ঘুরছে, স্টলে স্টলে ঘুরে সদ্য প্রকাশিত বইটি দেখছে; কিনছে প্রিয় লেখকের বই। বই কেনার ফাঁকে মেতে উঠছে আড্ডায়। শুধু বই ঘিরে মানুষের এমন সম্মিলনের দৃশ্য সত্যিই বিরল। বলা বাহুল্য, এ দৃশ্য বাঙালির প্রাণের উৎসব অমর একুশে বইমেলার।
১ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় বইমেলা। এরপরই লেখক-প্রকাশক-পাঠকের পদচারণায় বইমেলা হয়ে ওঠে জমজমাট, প্রাণবন্ত। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙে একুশের আবহযুক্ত এ মেলা ২০১৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সম্প্রসারণ করা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বিশাল এলাকাজুড়ে স্থাপিত হয়েছে মনকাড়া প্যাভিলিয়ন ও স্টল। নানা রং আর বর্ণের স্টলের সঙ্গে নতুন বইয়ের মাতাল গন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে যেন অন্য রকম করে তোলে।
যে বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অনন্য উৎসবে পরিণত হয়েছে, বিশ্ববাসীর কাছে এক ঈর্ষণীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, সেই বইমেলা কেমন চাই? আগে যেমন হত সেরকম? নাকি এখন যেমন হয় এরকম? নাকি আগে যেমন হত তেমন নয়, আবার এখন যেমন হয় তেমনও নয়, অন্যরকম কিছু?
সব ব্যাপারে আমরা যেমন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাই, একদল ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’পন্থী; আরেক দল আছেন ‘এই বেশ ভালো আছি’পন্থী। কিছু মানুষ এখনকার কোনও কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। এরা হল ‘আমাদের সময়’ পার্টি। কথায় কথায় ‘আমাদের সময়’ আর ‘আমাদের সময়’। এই পার্টি বলে, এখনকার গরুরা আর খাঁটি দুধ দেয় না, খানিকটা জল মিশিয়ে দেয়। আলুর চপে সেই টেস্ট নেই। এখনকার ছেলেমেয়েগুলো মহাপাজি। মনে মোটে ভক্তিশ্রদ্ধা নেই। ঈশ্বর পর্যন্ত কেমন যেন হয়ে গেছেন আজকাল। হাজার মাথা ঠুকলেও কিছু দিতে চান না। সে ছিল বটে ‘আমাদের সময়’। আহা! দুধ, ঘি, মাখন আকাশ থেকে ঝরে ঝরে পড়ত। আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেই হত। ‘আমাদের সময়’ আম্বালার বালুসাই মুখে দিলে মনে হত যেন বেহেস্তি কিসমিস খাচ্ছি। মনটা ভরে যেত। আমরা বড়দের দেখলেই মাথা নোয়াতাম। টেনে তোলা যেত না। তখন স্বয়ং ঈশ্বরও ছিলেন সদয়। কত কিছু যে চেয়ে পেয়েছি। সুখ, শান্তি, মোক্ষ, প্রাপ্তি!
‘আমাদের সময়’ পার্টির বিপরীতে রয়েছে আরেক পার্টি, যাদের বলা যায় ফেসবুক-সেলফি পার্টি। যারা নিজেদের ‘টেক স্যাভি’ বলে জাহির করে। সত্যি ‘টেক স্যাভি’ নয়, বানানো ‘টেক স্যাভি’। এই পার্টি হল ‘হামবড়াই পার্টি’। হাবভাব হল ‘হেভি আইটি আছি’। ফেসবুক করি, সেলফি তুলি, ইনফো নামাই। এত ব্যস্ততার মধ্যে বাবা–মাকে দেখতে পারি না। বন্ধুদের ভুলে যাই। প্রতিবেশীদের বিপদে পড়লে চিনি না। বিশ্বের ‘ইনফো’ নামাতে এত ব্যস্ত থাকি যে পাশের মানুষটার দুঃখ–কষ্টের ইনফরমেশন জানতে সময় পাই না। কোনও বিষয়ের গভীরে জ্ঞান অর্জনে মন নেই। টাকা রোজগার করি ফুর্তিতে দিন কাটাব বলে। ভেতরে ফোঁপরা হলেও বাইরেটা চকচকে। স্মার্ট ফোনের মতো নিজেকে স্মার্ট রাখব। স্মার্ট ফোনের মতোই নিজেকে ঘনঘন বদলাব। চ্যাটসর্বস্ব জীবনযাপন। ভক্তি টু প্রেম সব চ্যাটে। এই নিজেকে নিয়ে মাতোয়ারা পার্টি যে–কোনও হুল্লোড়েই খুশি। বইমেলায় কেন ঘাস কম, কেন এত টিভি সিরিয়ালের নায়ক–নায়িকার ভিড়, কেন খাবারের এত এলাহি আয়োজন, কেন বইয়ের বদলে অন্য ব্যবসার দিকে ঝোঁক বাড়ছে, কেন বই পড়ার প্রতি উৎসাহ কমছে— এইসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবার সময়ই নেই। সব ঠিক আছে। মাস্তি হলেই হল। বইমেলায় ঢুকে বই পাই না–পাই সেলফি পাব তো? ব্যস। ফটো তুলেই ঝটপট ফেসবুকে।
এরা যে যে–কোনোরকম বইমেলাকে বাহবা দেবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখনকার বইমেলাকেও দেবে।
বইমেলাকে এই দুরকম চোখে দেখলেই গোলমাল হয়ে যাবে। আগের বইমেলা খুব ভালো ছিল। ‘ঘাসে আঁকা, বেশিটাই ফাঁকা/ মোবাইলহীন, ঝালমুড়ি খাওয়ার দিন’ ফিরে আসুক বলে কপাল চাপড়ালে কোনও লাভ হবে না। সময় বদলেছে। মানুষের ধ্যানধারণা বদলেছে। টেকনোলজিতে আমরা হুড়মুড় করে এগোচ্ছি। মিথ্যে টেক স্যাভিরাই নয়, সত্যি টেক স্যাভিরাও অনেক আছে। যারা শুধু ‘চ্যাট ম্যাট ঘ্যাঁট’ করে না, অনলাইনে প্রচুর বই কেনে। কম্পিউটার খুলে দুনিয়ার খবর রাখে। তাদের বইমেলায় নিয়ে আসতে হলে, মেলাকে প্রযুক্তিবান্ধব করতে হবে। গোটা দুনিয়াতেই স্থায়ী মেলার মাঠ হয়ে গেছে। সেখানে খুব একটা ঘাস থাকে না। ধুলো থাকে না। ফলে এই বইমেলা কেন ঘাসহীন, কেন কংক্রিট বেশি— এই নিয়ে চোখের জল ফেলে লাভ নেই। ঘাস থাকলে মেলায় যেতাম, বই কিনে ঘাসে বসে বাদাম খেতাম— এসব মিথ্যে কথা।
আসলে বইমেলায় ‘আমাদের সময়’ পার্টি আর ‘সেলফি-ফেসবুক’ পার্টি উভয়ের মেলবন্ধন দরকার। বইমেলাটা বইপ্রেমীদের জন্যই রাখতে হবে। বইমেলায় আমি আসল জিনিস চাই। মুগ্ধ হওয়ার মত বই চাই। শুধু গল্প–কবিতা নয়, সমাজ, ইতিহাস, লোককথা নিয়ে ভালো ভালো সব কাজ চাই। অনেক গবেষণা, অনেক পরিশ্রম দিয়ে তৈরি কাজ চাই।
এজন্য আমাদের মন-মানসিকতা বদলাতে হবে সবার আগে। বই কেনার, বই পড়ার অভ্যেস বাড়াতে হবে। আমরা যারা বড় বড় বুলি আওড়াতে প্রসিদ্ধ আমরাও যদি সামর্থ্য অনুযায়ী অল্প কিছু পত্রিকা, বই কিনি তাহলেও কিন্তু স্টলগুলো মুখর থাকার কথা। এমনকি লেখকরাও আমাদের দেশে বই কেনে না। লেখকরা বেশিরভাগই পকেট থেকে পয়সা বের করে না। নব্বই শতাংশ কবি–সাহিত্যিকই মেলায় আসেন নিজের জন্য। কবি–সাহিত্যিক-লেখকরা অনেকে ভালো ভালো চাকরিও করে। তবু তারা বই কেনে না। একটু সিনিয়র হয়ে গেলে খালি ফ্রিতে নেওয়ার ধান্দা।
আমি চাই এমন একটা বইমেলা, যেখানে প্রত্যেকে যেন অন্তত একটা করে বই কেনে। নিজের মনের তাগিদে। যার যেমন সামর্থ্য, যার যেমন পছন্দ। এই মেলায় সবাই প্রতিজ্ঞা করুক বই না কিনে ফিরব না। মেলায় ধুলা কতটুকু, কতটা ঝামেলা পোহাতে হয়, সেসব নিয়ে কথা কম হোক। বইমেলায় বইটাই আসল। বইয়ের কেনাকাটা হলে তবেই মেলা বাঁচবে। এতে শুধু প্রকাশক, লেখক, ছাপাখানা, প্রুফ রিডার, বাইন্ডার, ভ্যান রিকশা চালক বাঁচবে না, একটা জাতি বাঁচবে। সেই বইমেলা আমি চাই। আমি জানি, আপনিও চান। আসুন আমরা সবাই তা চাই।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য