আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিভাগের নামকরণ কি শুধু নামেই সীমাবদ্ধ?

আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল  

নামকরণ নিয়ে এদেশে যা হয়েছে তার নেপথ্যে কোনো না কোনোভাবে সাম্প্রদায়িক ইস্যু কার্যকর ছিল এবং সেটি মোগল আমল থেকেই। বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রায় সকলেই এ ব্যাপারে অবগত। রাজনৈতিক কারণও কার্যকর ছিল যেমন: ফিরোজপুরের নাম পিরোজপুর করা। অন্যদিকে চন্দ্রদ্বীপের মতো একটি নান্দনিক নামকে বরিশাল করার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না!

পাকিস্তান আমলের পর জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে নামকরণ নতুন মাত্রা পায়। পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানে শিশু পার্ক স্থাপন করে জিয়া বলেছিলেন, "পরাজয়ের চিহ্ন মুছে দিলাম।" এরশাদ আমলে জমিদার জয়দেবের জয়দেবপুর হয় কুস্তিগির গাজীর নামে গাজীপুর, বিক্রমপুর থেকে মুন্সীগঞ্জ হয়েছে। আবার ময়মনসিংহকে মোমেনশাহী করা যায়নি; কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সুকৌশলে বিবাড়িয়া করার চেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

বৃহত্তর কুমিল্লার কথা বিবেচনা করলে কুমিল্লা এবং নোয়াখালী দুটি বিভাগই হওয়া প্রয়োজন, কারণ দাউদকান্দি থেকে নোয়াখালী-ফেনী পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর বিভাগীয় প্রয়োজনে চট্টগ্রামে যাওয়া কষ্টকর; এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের পক্ষেও এতগুলো জেলার জনগণের সেবাদান জটিলতাপূর্ণ ও কঠিন।

বিভাগ বাস্তবায়নের ক্রমে কুমিল্লা এখন আলোচিত। কুমিল্লা বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবি বহু বছরের। একে বিভাগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয় ১৯৬২ সালে কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮৮/৮৯ সালে 'কুমিল্লা গণফোরাম' নামের সংগঠনের ব্যানারে, পরবর্তীতে সংগঠনের নাম 'কুমিল্লা গণদাবি পরিষদ' নামকরণ করে বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়। এছাড়া আরো কয়েকটি সংগঠনও বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবিতে কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। অথচ ইতোমধ্যে আরও কয়েকটি বিভাগ ঘোষিত হলেও কুমিল্লাকে বিভাগ করা হয়নি।

সাধারণত বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দিষ্ট আর্থিক বরাদ্দ প্রয়োজন। এ বিবেচনায় কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়ন সবচেয়ে সহজ একটি কাজ। এখানে বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় সকল অবকাঠামো ও দপ্তর আছে; বিভাগ ঘোষণার জন্য প্রয়োজন শুধু একজন বিভাগীয় কমিশনার ও ডিআইজি নিয়োগের।

সম্প্রতি বিভাগ করার ক্ষেত্রে ময়নামতি নাম ঘোষণা করায় কুমিল্লাবাসী যেসব আপত্তি জানাচ্ছে তাতে অনুভূতির একটি বিষয় অবশ্যই আছে, তবে যুক্তিও রয়েছে।

ইতিহাস প্রসঙ্গ
কুমিল্লা নামকরণ নিয়ে ইতিহাস টানলে বলা যায়, ঢাকাকে কি সোনারগাঁও করা হবে? আইন-এ-আকবরিতে মমেনশাহি আছে, ময়মনসিংহ নাম কি পরিবর্তনের দাবি তোলা যায়? চন্দ্রদ্বীপ, গৌড়, পুণ্ড্র, হরিকেল, বরেন্দ্র - এসব নামকে কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয় হচ্ছে - আগামীতে নোয়াখালী বিভাগের নাম কি সুধারাম বা ভুলুয়া হবে?

বিভাগের নামকরণ প্রসঙ্গ
১. ময়নামতি বিভাগ করতে হলে বর্তমান ময়নামতি, ময়নামতি ইউনিয়ন, রেলস্টেশনসহ যা কিছু আছে সেগুলোর নাম পরিবর্তন করতে হবে। অন্যথায় একই নামে ইউনিয়ন ও বিভাগ থাকা হাস্যকর বিষয় হবে।

২. কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন, কুমিল্লা বোর্ডসহ সরকারী যে প্রশাসনিক ইউনিট ও দপ্তরগুলো আছে সেগুলোর নাম কি হবে?

৩. বর্তমান ময়নামতি ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন না করে একে বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারকে বড় অংকের আর্থিক বরাদ্দ দিতে হবে কারণ সেখানে বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট-দপ্তর স্থাপনসহ বিভাগ সংশ্লিষ্ট অনেক কাজ সম্পন্ন করতে হবে। শুধু নাম পরিবর্তনের জন্য এ অতিরিক্ত খরচ কি আদৌ প্রয়োজন আছে নাকি এটি যৌক্তিক?

৪. গুরুত্বপূর্ণ কারণটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের ভাবমূর্তি এবং প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্পর্কিত। নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কুমিল্লা সফরের সময় কুমিল্লা বিভাগ ঘোষণার গুঞ্জন ছিল, ঘোষণার নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু তিনি মহাসমাবেশে কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। শুধু তাই নয়, নাম কি হবে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত জনগণকে প্রশ্ন করেছিলেন এবং কুমিল্লা নামকরণের নিশ্চয়তা সেই মহাসমাবেশেই দিয়ে আসেন। এখন যদি সেই‌ প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় ঘটে তাহলে শুধু প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ হবে না, জনগণের প্রত্যাশা ও আশ্রয়ের স্থানটিকে বিতর্কিত করা হবে।

৫. অনেকে কুমিল্লা বিভাগের প্রশ্নে অন্যান্য জেলার অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রসঙ্গ আনছেন, উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ার যুক্তি দিচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে এ দায়িত্ব সাংসদের, অতঃপর যোগাযোগমন্ত্রীর। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে এতগুলো জেলা রয়েছে যে বৃহত্তর কুমিল্লা-নোয়াখালীর জেলাগুলো শেষের তালিকায় আসে। তাই শুধুমাত্র প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য নয়, জেলাগুলোর উন্নয়ন নিশ্চিত ও সহজতর করতেও বিভাগ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।

৬. দেশের প্রতিটি বিভাগই প্রধান জেলার নামানুসারে হয়েছে। কুমিল্লার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলে জনমনে অনেক প্রশ্নের উদয় হবে যা সরকারের একটি শুভ প্রচেষ্টায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ এটি সকলের কাছেই অনুমেয় যে কুমিল্লা বিভাগের নতুন নামকরণের কারণ অন্তর্দলীয় বিভক্তি, ব্যক্তিগত কৃতিত্ব এবং প্রভাব প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। কুমিল্লার ৫৫% ভোটার আ'লীগের সমর্থক। তারপরও যতবার হেরেছে তা শুধুমাত্র চরম গ্রুপিংয়ের কারণে। উপরন্তু সহজ পন্থার পরিবর্তে অতিরিক্ত ব্যয়ের খাত সৃষ্টি করলে জনমনে প্রশ্ন ওঠা কি স্বাভাবিক নয় যে, জনগণের টাকা নিজেদের ইচ্ছায় ব্যয় করার নেপথ্যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রয়েছে!

অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে বৃহত্তর নোয়াখালীবাসীর অনেকে প্রয়োজনে চট্টগ্রামে যেতে রাজি, তবু কুমিল্লায় নয়। কুমিল্লা বিভাগের বিরুদ্ধে চৌমুহনীতে মানববন্ধন হয়েছে। কুমিল্লা বিভাগ হবে এমন সংবাদ বহুবার সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, কেউ আপত্তি তোলেনি। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কুমিল্লা নামেই বিভাগ প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পরও এর বিপক্ষে কেউ কোনো কথা বলেন নি। এখন যদি কোথাও গুটিকয়েক মানুষের সমাগমে প্রতিবাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তাহলে ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নেয়ার চিত্রটিই জনগণের কাছে আরও স্পষ্ট হবে।

আওয়ামী লীগকে গণমুখী ও ভোটের রাজনীতি করতে হলে কুমিল্লা বিভাগের নাম কুমিল্লাই রাখতে হবে, ময়নামতি নয়। জনগণের স্বার্থে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ধারাবাহিকতায় কুমিল্লার পর নোয়াখালীকেও বিভাগ করা উচিত যা অন্যান্য বিভাগের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণে মোটেও অযৌক্তিক নয়। নামকরণ সম্পর্কে কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে না পারলে সরকারের জন্য বিভাগ ঘোষণা স্থগিত করাই হবে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।

কিন্তু কুমিল্লা বিভাগের নাম ময়নামতি নামকরণ করা হলে তা শুধু অদূরদর্শী ও জনমতবিরোধীই হবে না, এর মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিতর্কিত করাসহ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সকল অর্জন ও সাফল্য ম্লান ও বিতর্কিত করে দিতে পারে।

আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল, সাবেক ছাত্রনেতা ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ