আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অভিজিৎ রায়: রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী ‘উর্বর’ হয় না

ফরিদ আহমেদ  

ফোনটা এসেছিলো ঠিক দুপুরের দিকে, ভয়ংকর এক অশুভ সংকেত হয়ে। ফোনের স্ক্রিনে নাম্বার দেখেই টের পেয়েছিলাম বাংলাদেশ থেকে এসেছে। হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে ভেসে আসে আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের পরিচিত কণ্ঠ।“আপনার জন্য একটা খারাপ খবর আছে। অভিজিৎ রায় খুন হয়েছে। তাঁর ওয়াইফও আহত।

“তার সঙ্গে আমার আর কী কী কথা হয়েছিলো, কিছুই মনে নেই এখন আর। ফোনটা রেখেই তড়িৎ গতিতে প্রথম আলো খুলেছিলাম আমি। মন বলছে, এ সবের কিছুই সত্যি নয়। কিন্তু, খুলে দেখি সত্যি সত্যিই ঘটেছে এটি। অভি নিহত, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে তাকে। বন্যাও গুরুতরভাবে আহত। সে বাঁচবে কি না, কেউ জানে না।
ফোন রেখে দিয়ে দীর্ঘ সময় স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম আমি। দশ বছরের কতো স্মৃতি, কতো হাস্য রসিকতা, কতো স্বপ্ন, কতো পরিকল্পনা, কতো কিছু দুজনে এক সাথে। দুজনে বললেও ভুল হবে, আমার আসলে বলা উচিত তিনজনে মিলে। বন্যাও জড়িত থাকতো প্রায় সবকিছুর সাথেই ওতপ্রোতভাবে।

দশ বছরে আমাদের সামনাসামনি দেখা হয়েছে মাত্র একবার। কিন্তু, প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে আমাদের, প্রতিদিনই হয়েছে চিন্তার আদান প্রদান। আমাকে যে পরিমাণ ইমেইল অভি করেছে, আমার মনে হয় না যে, এতো বিপুল পরিমাণ ইমেইল ও আর কাউকে করেছে। আমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বার ইমেইল করেছি অভিকেই। সেই অভি আর নেই। ঘাতকের চাপাতির কয়েকটা আঘাতে এই সময়ের অন্যতম সেরা এক প্রতিভা ঝরে গেলো অকালে। শুধুমাত্র মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা ছিলো না সে, বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো অনলাইনে তার পুরোধা ছিলো সে। যুগে যুগে তাকে স্মরণ করা হবে তার এই ভূমিকার জন্য।

বিজ্ঞান লেখক হিসাবেও সে অনন্য। সে শুধু তার সময়েরই সেরা নয়, বাংলা ভাষায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক সে। তার মতো করে এমন সাহিত্যসমৃদ্ধ সুললিত ভাষায় বিজ্ঞানের একেবারে সর্বশেষ এবং প্রান্তিক বিষয়গুলো নিয়ে এমন সুখপাঠ্য বই আর কেউ লেখে নি কখনো। জনপ্রিয়তা সব সময় শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, কিন্তু অভির ক্ষেত্রে এই দুইয়ের সমন্বয় হয়েছিলো অসাধারণভাবে।

দুই বছর আগে বইমেলায় গিয়েছিলো বন্যা আর অভিজিৎ সেদিন। বইমেলাকে সবাই বলে প্রাণের মেলা। অভিজিৎ এর মতো অতিমাত্রায় পড়ুয়া একজন মানুষের জন্য এটা প্রাণের মেলার চেয়েও বেশি কিছু। বই-ই ছিলো তার স্বপ্ন আর ভালবাসা। সেই ছোটবেলা থেকে বইয়ের প্রেমে পড়েছে সে। সেই থেকে গোগ্রাসে গিলে চলেছে বই। এর কোনো ক্ষান্তি নেই যেনো। আমি ওকে মাঝে মাঝে বলতাম যে, তুমি কোন কোন বই পড়েছো, সেটা বলার চেয়ে কোন কোন বই পড়ো নাই, সেটা বলাই বরং ভালো। এবার অবশ্য বই পড়ার চেয়েও অন্য তাগিদ ছিলো বেশি। অভিজিৎ এর দু’দুটো বই প্রকাশিত হয়েছিলো সেই বারের বইমেলায়।‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ আর ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে’। দুটোই অসাধারণ মানের বই। মেলার প্রথম দিন থেকেই বিক্রি হয়েছিলো দুরন্ত গতিতে।

বইমেলা থেকে ফিরে আসার পথে টিএসসির সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকের ফুটপাতে আক্রান্ত হয় তারা। প্রেমিকার প্রেমিকার মতো উচ্ছলতা নিয়ে বইমেলা থেকে বের হয়ে এসেছিলো দুজনে। আচমকাই ঘাতক এসে হামলে পড়ে তাদের উপরে। দুটো ছেলে চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিজিৎ এর উপরে। মাথার পিছনে পেশাদার খুনির দক্ষতায় নিখুঁতভাবে তিনবার আঘাত করে তারা। অভিজিৎ -কে বাঁচাতে এগিয়ে যাওয়া বন্যাও আক্রান্ত হয় নিষ্ঠুরভাবে। মাথা এবং ঘাড়ে কোপ খায় সে। আঙুলগুলো তার ঝাঁঝরা হয়ে যায় চাপাতির ধারালো আঘাতে। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল হাত থেকে ছিন্ন হয়ে পড়ে যায় ফুটপাতে।

মাত্র দুই মিনিটের প্রবল আক্রমণ শেষ করে দুই ঘাতক নিশ্চিন্তে চলে যায় দুই দিকে। নিথর দেখে অভিজিৎ পড়ে থাকে ফুটপাতের উপর। আর, বন্যা, বনপোড়া এক হরিণীর মতো আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে তাকে বাঁচানোর জন্য।

প্রতিটা যুগেই, মুক্তচিন্তা যাঁরা করেছেন, সমাজকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন সামনের দিকে, গাঢ় অন্ধকারকে দূর করতে চেয়েছেন প্রদীপ জ্বেলে, প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থপর গোষ্ঠী তাঁদের সহ্য করতে পারে নি। নৃশংসভাবে হামলে পড়েছে মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তাকে রুদ্ধ করতে, ভয়ানক আক্রোশে ঝাঁপিয়েছে আলোর মশালকে নিভিয়ে দিতে। আলোর চেয়ে অন্ধকার এদের বেশি পছন্দ, মুক্ত বাতাসের চেয়ে দমবন্ধ করা গুমোট পরিবেশই এদের বেশি কাম্য। তাঁদের এই আক্রোশে, নৃশংস হামলায় রক্ত ঝরেছে মুক্তচিন্তকদের। তাঁদের শরীর থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়েছে রুক্ষ মাটিতে। বন্ধ্যা মাটি সেই রক্তে হয়ে উঠেছে উর্বর। মুক্তচিন্তকদের রক্তবীজ থেকে বের হয়ে এসেছে আরো অসংখ্য মুক্ত চিন্তার মানুষ।

প্রহসনের এক বিচারের মাধ্যমে সক্রেটিসকে হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে প্রাচীন গ্রিসে, হাইপেশিয়াকে আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে, ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, গ্যালিলিওকে বন্দি করা হয়েছে অন্ধকার কারাকক্ষে, অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে, বন্যা আহমেদ মারাত্মক আঘাত নিয়ে পর্যুদস্ত। কিন্তু, তারপরেও মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল আন্দোলনকে থামানো যায় নি কখনো, যাবেও না। যায় না আসলে।

সমাজের নিয়মই হচ্ছে যে, এটি সামনের দিকেই এগুবে। পিছন থেকে একে যতই টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেনো এর সম্মুখ গতি সাময়িকভাবে ব্যাহত হলেও একেবারে কখনোই থেমে যাবে না। প্রতিক্রিয়াশীলরা এটা জানে। তাই, সবসময়ই তারা থাকে মরিয়া। যতোখানি সম্ভব অঙ্গহানি ঘটিয়ে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করে সমাজের চাকাকে।

প্রতিক্রিয়াশীল আর প্রগতিশীলের এই দ্বন্দ্ব তাই সবসময়ই রক্তক্ষয়ী। তবে, এই রক্ত ঝরে শুধু প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো খুন, জখম, মারামারি-কাটাকাটি করার মতো মানসিকতা তাঁদের নেই। অস্ত্রের চেয়ে কলমের শক্তিতেই বেশি বিশ্বাস তাঁদের। প্রতিটা আন্দোলনে তাই রক্ত দিতে হয় ভূমিকে। রক্ত দেয়া ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফল হয় না। তাই তো অভিজিৎ লিখেছিলো,

“যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি। জামাত শিবির, রাজাকারেরা নির্বিষ ঢোড়া সাপ না, তা একাত্তরেই আমরা জেনেছিলাম। আশি নব্বইয়ের দশকে শিবিরের রগ কাটার বিবরণ আমি কম পড়িনি। আমার কাছের বন্ধুবান্ধবেরাই কম আহত হয় নাই।”

বাংলাদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেটাই হত্যাকারীদের উৎসাহ দিয়ে চলেছে অবিরাম। হত্যা করার পরে যেহেতু খুব সহজে আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে সটকে পড়া যায়, সে কারণে হত্যা, গুম কিংবা কিডন্যাপে অংশ নিতে ষণ্ডা-পাণ্ডাদের খুব একটা ভয়ের কিছু থাকে না। স্বাধীন একটা দেশে আপনাআপনিতেই অপরাধের তদন্ত হবে, বিচার হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, বাংলাদেশে যেনো ঘটছে উলটো ঘটনা। এখানে অপরাধ ঘটানো সুলভ, বিচার পাওয়াটা দুর্লভ। দুই বছর হয়ে গেছে অভি-র হত্যাকাণ্ডের। আজো পুলিশ এর কোনো সুরাহা করতে পারে নাই। পারবে কিনা, তাও কেউ জানে না। একজন লেখক প্রকাশ্যে, জনারণ্যে খুন হয়ে গেলো, অথচ তাঁর হত্যাকারীদের ধরার কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না, দুই বছর চলে যাবার পরেও তদন্ত আলোর মুখ দেখছে না, এর চেয়ে লজ্জাকর আর কী আছে আমাদের জন্য?

মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রগতির চাকাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের আত্মদান বৃথা যায়নি। এঁদের রক্তে উর্বর হয়েছে পৃথিবী। কোনো এক বিচিত্র কারণে রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী উর্বর হয়নি কখনো। তারপর সেই উর্বর মাটিতে ফলেছে সবুজ ফসলের বিস্তীর্ণ সমাহার। সেই সবুজে সিক্ত হয়েছে অনাগত দিনের অগুনতি মানুষেরা।

ফরিদ আহমেদ, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ