আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আত্মঘাতি সিলেটি!

হাসান মোরশেদ  

'আত্মঘাতী বাঙ্গালী' লিখেছিলেন নিরদ সি চৌধুরী। আরেকটু গভীরে গিয়ে লেখা সম্ভব 'আত্মঘাতি সিলেটি'। না, সাম্প্রতিক বেঙ্গল ফাউন্ডেশন- সিলেটি ইজম নিয়ে কথা বলছি না।

বেঙ্গলের কর্ণধার আবুল খায়ের লিটু যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, এতো বড় ব্যবসায়ী এবং আয়োজক হয়ে তার মুখে মানায় না। এটা একেবারে রাস্তার ভাষা। একদিন পর লিটু দুঃখ প্রকাশ করে নিজের মর্যাদা সমুন্নত করেছেন।

কিন্তু সিলেটি ইজমওয়ালারা? যারা 'জিমাইল গান' এর বদলে 'নাইচ' এর গানের দাবীতে 'অইতো অইতো' বলে অনুষ্ঠানস্থল হয়ে একেবারে ফেসবুক পর্যন্ত মাতিয়ে তুলেছিলেন? তারা কি দুঃখ প্রকাশ করেছেন? তাদেরকে তা করতে হবে না। কারণ তারা চমৎকার ভাবে বিষয়টিকে চিরাচরিত 'সিলেটি ভার্সাস বেঙ্গলি'তে নিয়ে যেতে পেরেছেন।

ঠিক এই জায়গাতেই সিলেটিরা আত্মঘাতি। ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। প্রাগৈতিহাসিককালের বৃহৎ বাংলার হরিকেল এই সিলেট। মোঘল আমলের 'সুবে বাংলা'র সবচেয়ে বড় রাজস্বদাতা সিলেট- বছরে ১৬৭০০০ হাজার রুপি। এই সেদিন মাত্র বৃটিশরা তাদের প্রশাসনিক সুবিধায় নতুন প্রদেশ গঠন করলো আসাম- ১৮৭৪সালে। পাহাড় জঙ্গল সভ্যতা বিবর্জিত প্রদেশ, রাজস্ব আর প্রশাসনের প্রয়োজনে সিলেটকে বাংলা থেকে আলাদা করে জুড়ে দিলো তারা আসামের সাথে। সেদিন সিলেটের বাঙালিরা আন্দোলন করেছেন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, সিলেট বাংলার বাইরে যাবে না। আসাম প্রদেশের প্রশাসন, শিক্ষা দখল করলো শিক্ষায় অগ্রসর সিলেটিরা।

আসামের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল পরিষ্কার করে আবাদ করার জন্য কৃষকদের নেয়া হলো বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে। বৃটিশরা এই প্রান্তিক মানুষদের তুচ্ছার্থে 'বেঙ্গলি' ডাকতো। বৃটিশদের দেখে শিক্ষিত সিলেটিরা ও নিজেদের ভাইদেরকে ডাকা শুরু করলেন 'বেঙ্গলি' । উপনিবেশের প্রভাবে সেই যে আত্মপরিচয় ভুলে আত্মঘাতের শুরু- সিলেটিদের কেউ আর ফেরাতে পারেনি।

১৯৩৭ সালে আসাম এসেম্বলিতে আন্দোলন করে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করে নিয়েছে সিলেটিরা, ১৯৪৭ সালে ঢাকার আগে সিলেটে বাংলা ভাষা আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সিলেট একমাত্র ব্যতিক্রম যারা দেশ ভাগের সময় নিজেরা গণভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পূর্ব বাংলায় ফিরে আসার। মুক্তিবাহিনীর চীফ, ডেপুটি চীফ সিলেটি।তৎকালীন জেলা ভিত্তিতে মুক্তিবাহিনীর গণযোদ্ধা সংখ্যায় বেশী বৃহত্তর সিলেটের। ষাট এর দশকে মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধু লন্ডন ছুটে গিয়েছে প্রবাসী সিলেটিদের কাছে তার ছয়দফার মন্ত্র নিয়ে, সিলেটিরা উজাড় করে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে।

সিলেটিরা বাংলাকে ধারণ করে বাংলাদেশে, আসামে-মেঘালয়ে, লন্ডনে-নিউইয়র্কে।

যে সিলেটিরা বেঙ্গল- বাংলার জন্য এতকিছু, সেই সিলেটিরাই আবার নিজেদের ভাবে 'সিলেটি' আর অন্যদের 'বেঙ্গলি'- তাও তুচ্ছার্থে! ঐ যে বৃটিশের তৈরি করে দেয়া কলোনিয়াল মাইন্ডসেট।

নানা জাতের তত্ত্ব মিলে বাতাসে- সিলেটিরা নাকি বাঙালি না, আলাদা জাতি। সিলেটি আসলে বাংলা ভাষায় ডায়ালেক্ট না- ঐটা আলাদা ভাষাই। প্রমাণ! আমাদের নাগরি আছে না? অথচ এটা কোন ভাষা নয়, এটা একটা লিপি। মোগল আমলে দাপ্তরিক কাজে সিলেট আসা তুর্কী, আফগান, পাঠান, ইরানী লোকজনের সুবিধার জন্য কমন একটা লিপি তৈরি করা হয়েছিলো যা দিয়ে দলিল দস্তাবেজ ও পুঁথি লেখা হয়েছে শ তিনেক বছর।

তারপর স্বাভাবিকভাবেই ওটা মারা গেছে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে। নাগরির আগে সিলেটিরা যেনো কথা বলতোনা!

অথচ বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত সিলেটিরা আলাদা কিছু নয়- সিলেটি, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালি- সব মানুষকে নিয়েই বাঙালি। প্রত্যেকটা অঞ্চল নিয়েই বাংলাদেশ। ভাষার ক্ষেত্রে ও তাই। প্রত্যেকটি আঞ্চলিক ভাষাই বাংলা ভাষার এক একটা রূপ। এইসব রূপ নিয়েই আমাদের বাংলা। স্বকীয়তা সুন্দর, সংকীর্ণতা বিশ্রী।

সিলেটিদের আত্মঘাতের সীমা-পরিসীমা নেই। আসাম-বেঙ্গলের সবচেয়ে শিক্ষিত, রুচিশীল জনগোষ্ঠি '৫০ এর দশক থেকে মেতে উঠেছিলো লন্ডন গমনে। প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত রাজপ্রাসাদ গড়ে উঠেছে আর মাঝখান থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি নাই হয়ে গেছে। এখন লন্ডনীদের তৃতীয় প্রজন্মে এসে আর সিলেটকে পাত্তা দেয় না, দুনিয়া বদলে গেছে। উনিশ শতকের শিক্ষিত সিলেটী একদিন তুচ্ছার্থে যে কৃষকশ্রেণিকে 'বেঙ্গলী' ডেকেছে, সেই বেঙ্গলীরা এখন শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থ বাণিজ্যে ছড়ি ঘোরাচ্ছে।

আর আত্মঘাতি সিলেটি এখনো মেতে আছে 'অইতো নি? অইতো!' তে।

তো হবে। সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক সবাই মিলেই যখন আত্মঘাতি তখন পরিণতি এই-ই হবে।

হাসান মোরশেদ, লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ