প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ০৩ মার্চ, ২০১৭
ব্রিটেনে এই সপ্তাহে গাড়ির চালকদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে দ্বিগুণ সাজার বিধান করে আইন চালু করেছে । যেখানে দুইশ পাউন্ড জরিমানা এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সে ৬ পয়েন্ট কেটে দেয়া হবে। এবং ঘোষণার সাথে সাথেই তা কার্যকর করা শুরু করে দিয়েছে দেশটির প্রশাসন। শুধু মাত্র দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতেই এই আইন চালু করেছে। ব্রিটেনে বেশির ভাগ পরিবারে কম বেশী এক/ দুইটা গাড়ি আছে, এবং কোন পরিবারে তার অধিক পরিমাণ গাড়িও চালক আছেন। কোথাও কেউ এই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করেন নি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তা মেনে নিয়েছেন।
বাংলাদেশে ঠিক তার উল্টো ঘটনা। বাংলাদেশে গত সপ্তাহে দীর্ঘদিন মামলা পরিচালনার পর, পক্ষে বিপক্ষে সাক্ষী প্রমাণাদি যুক্তি তর্ক ইত্যাদির পর বিজ্ঞ আদালত দুই গাড়ি চালকের যাবজ্জীবন ও অন্য এক মামলায় এক চালকের ফাঁসির রায় দিয়েছেন। প্রতিবাদে পরিবহন মালিক শ্রমিকরা সারা দেশের গণপরিবহন অচল করে দিলেন।
এমন একটি দিন নেই বাংলাদেশে কোন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেনা। গড়ে প্রতিদিন মানুষ মারা যায় এর একটা হিসাব হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু কতজন মানুষ পঙ্গু জীবনযাপন করে তার কোন হিসাব কিন্তু নেই। ২০১৫ সালের বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে গড়ে ২৪ জন মারা গেছেন।
২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৫৫ জন। এতে আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৯১৪ জন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের বর্বর হত্যাকাণ্ড ও ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড় ছাড়া এতো বিশাল পরিমাণ মানুষের মৃত্যুর কোন ইতিহাস নাই। অন্য আরেক জরিপে বলা হয়েছে দেশের হাসপাতালগুলোর বিছানার ২৫ভাগ দখল করে আছে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত রোগী। অন্যদিকে দেশে ১৪ ভাগ মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। আর সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।
আর এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ চালকদের অদক্ষতা, অসতর্কতা ও কোন ধরনের জবাবদিহি না থাকা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে বিশ্বের উন্নত দেশ সমূহেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থা এখনো উন্নত হয়নি দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। অতএব কোনটা ঘটনা আর কোনটা দুর্ঘটনা সেই বোধটুকু মানুষ , রাষ্ট্র, আদালত সবারই আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ দুইটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ যাত্রী উঠানোর কারণে লঞ্চ ডুবে গেলে এবং ধারণক্ষমতা সম্পন্ন যাত্রী নিয়ে প্রচণ্ড ঝড় তুফানে লঞ্চ ডুবে গেলে একই ধরনের দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি সড়কে ইচ্ছে করে বা মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে, মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া কোন ভাবেই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে না।
পরিবহন শ্রমিকরা এই দেশেরই মানুষ, আমাদেরই কারও আপনজন। সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ । কিন্তু কেন যেন তারা নিজেদের বাইরে ভাবতে চেষ্টা করেন। পরিবহন খাতে তাদের নিজস্ব একটা বলয় গড়ে তুলেছেন। সেখানে তাদের নিজস্ব আইন কানুন তৈরি করে ফেলেছেন এর মালিক ও শ্রমিকগণ। যার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের গণপরিবহনে এক ধরনের নৈরাজ্য বিদ্যমান। পরিবহন মালিক সমিতির নামে দেশের ১৭ কোটি মানুষকে তাদের কাছে জিম্মি করে রেখে দিয়েছে। শার্লস বোদল্যার এর একটি উক্তি আছে প্রগতি নিয়ে “সত্যকায় প্রগতির অর্থ হচ্ছে মানুষের নৈতিক প্রগতি এবং তা সাধিত হতে পারে শুধু ব্যাক্তির দ্বারা ব্যাক্তিরই মধ্যে”।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রগতি হচ্ছে পোশাকে পরিচ্ছদে প্রগতি হচ্ছে কিন্তু নৈতিক প্রগতি ঘটছে না। দেশের আইন, আদালত মানার বোধটুকু আমাদের মাঝে নেই। আদালত কি দেশের বিপক্ষ শক্তি? আদালতের রায় মানতে প্রস্তুত নয় কেউই। জামায়াত বলুন, হেফাজত বলুন কেউই মানতে রাজি নয়। যে দেশে আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয় সপরিবারে জাতির পিতার হত্যার রায়। সেই দেশে আদালত যখন রাজাকার আল বদরদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে, সংবিধানের সংশোধনী ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ অবৈধ ঘোষণা করে মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। রাজন হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। ঢাকায় নলকূপের পাইপে পরে মৃত্যুবরণকারী জিহাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী ২ জনকে ১০ বছরের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। সেই একই আদালত যখন সাভারে গাড়িচাপায় খুন হওয়ার ডায়ে ফাঁসির রায় দিয়েছেন, তারেক মাসুদ ও মিশুক মনিরের মামলায় যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করেছে তখনই বেঁকে বসেছে দেশের পরিবহন শ্রমিক। তাদের অবরোধে বিপর্যস্ত জনজীবন । ঢাকায় পুলিশের ভ্যানে আগুন জ্বালানো হয়েছে। গাবতলিতে এক শ্রমিকের মৃত্যুও ঘটেছে।
মীরেরসরাই ট্রাজেডির কথা মনে আছে?
স্কুল ফুটবলের ফাইনাল শেষে ট্রাকে ফিরছিল স্কুল ছাত্ররা। ট্রাকের ড্রাইভারের হঠাত শখ হয়েছিল মোবাইলে কথা বলার। চালকের এই মোবাইলে কথা বলার শখ মিটাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাক উল্টে পাশের পানিতে ভরা খাদে পড়ে যায়। কাঁদার মধ্যে গেঁথে যায় ট্রাকের কিনারা। ভেতরে পানিতে দম বন্ধ হয়ে মারা যায় ৫০ জন শিশু। এই ঘটনাগুলো ঘটনা না দুর্ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হবে?
ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এখন হামলার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছে গাড়ি বোমা, বাস ট্রাক। ফরাসিদের বাস্তিল দিবসে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় নিস শহরে একটি ট্রাকের চালক জনতার ওপর দ্রুতগতির ট্রাক উঠিয়ে দেওয়ার পর অন্তত ৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেটা কি দুর্ঘটনা ছিল?
বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ, কিংবা শাহবাগে নানা রকম প্রতিবাদ কর্মসূচিতে কিংবা বইমেলায় যদি কোন চালক গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করে আইনত কিন্তু সে দুর্ঘটনা বলে নিজেকে নির্দোষ দাবী করতে পারে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে “কাঁচাতে না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাস ঠাস’’।
ধরে নিলাম পর্দার পিছনের কাহিনী আমরা জানিনা। পরিবহন মালিক সমিতির নেতা ও শ্রমিক নেতা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকার পরেও শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে যখন ব্যর্থ হয়েছেন তাদের উচিৎ হয় সরকারী দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া অথবা পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠনের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া।
পরিবহন মালিক শ্রমিক পক্ষ সেই ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিয়েছে। এদের মাথাটা এখন আইন দিয়েই নোয়াতে হবে। সরকার, আদালত ও জনগণ তিন পক্ষই এক জায়গায় দাঁড়িয়েছেন। পরিবহন মালিক শ্রমিকদের আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। পরিবহন খাতে নৈরাজ্য রুখে দেয়ার এখনই সময়। কোন ভাবেই মানুষ হত্যার লাইসেন্স তাদের হাতে তুলে দেয়া যাবেনা। আদালত নিশ্চয় দুর্ঘটনা হলেই চালককে ধরে এনে যাবজ্জীবন কিংবা ফাঁসি দিয়ে দিচ্ছে না। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সাজা নিশ্চিত করবে।
কোনটি ঘটনা আর কোনটি দুর্ঘটনা বিজ্ঞ আদালত অবশ্যই সেই জ্ঞান রাখেন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য