প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
লীনা পারভীন | ০৫ মার্চ, ২০১৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম কিন্তু কখনো সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করি নি। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে অনেক বছর বন্ধ ছিলো সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এর মূল কারণ ছিলো ক্যাম্পাসে কোন স্বৈরাচার বা জোর করে ক্ষমতা দখলকারী কোন সামরিক শাসককে প্রবেশ করতে না দেয়া। যে চেতনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের মত একটি আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ রাখা হয়েছিলো সেই চেতনার কতটুকু এখন ধারণ করে আমাদের প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় সেটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠছে।
সারাদেশে চলছে এক ধরণের অস্থিরতা। সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক প্রতিটা ক্ষেত্রেই আজ আমরা ক্রান্তিকাল পার করছি। দেশে এখন মৌলবাদী রাজনীতির উত্থানের লক্ষণ স্পষ্ট। তৈরি হচ্ছে না কোন নতুন নেতৃত্ব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বাংলাদেশের জন্মদাতা। এই ক্যাম্পাসকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে আসছে আমাদের দেশের সকল মুক্তিসংগ্রাম। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ছাত্ররাজনীতির বড় আকাল চলছে।
আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এমনিতেই একজন মাটির কোল থেকে উঠে আসা মানুষ। একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদ। উনার বক্তব্যেও তার ছাপ থাকে বরাবর। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির দেয়া বক্তব্যকে ঘিরে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন অসাধারণ ছিলো, কেউ বলছেন হালকা বক্তব্য ছিলো। কেউ বা আবার তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও হাসিঠাট্টা করতে ছাড়ছেন না।
খুব বুদ্ধিমান হওয়া লাগে না তাঁর বক্তব্যকে বুঝতে গেলে। তিনি একজন চালু রাজনীতিজ্ঞ। তাই তাঁর ভাষা হবে রাজনৈতিক এটাই স্বাভাবিক। তবে তিনি একজন টিপিকাল রাজনীতিবিদের মত বক্তব্য রাখেন নি। সোজা সরল এবং কৌশলী ভাষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক উল্লেখ করেছেন।
১. মহামান্য রাষ্ট্রপতির একটি গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে যেটা তিনি তাঁর বক্তব্যেও উল্লেখ করেছেন। খেয়াল করবেন, তিনি একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন। নিজের আদর্শকে অন্যের মাঝে কীভাবে নিয়ে যেতে হয় তার একটা পরিষ্কার দিক নির্দেশনা আছে। উনার কথা শুনেই মনে পড়লো আমরা যখন ছাত্ররাজনীতিতে ছিলাম তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসতো বা যারা খোঁজ খবর নিতে বা ফর্ম কিনতে আসতো আমরা তাদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতাম।
আমি নিজে অনেকের ফর্ম ফিলাপ করে দিয়েছি। ফর্ম ফিলাপের প্রতিটা দিন একটা টেবিল নিয়ে আমরা বিভিন্ন পয়েন্টে বসে থাকতাম ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য। স্ট্যাপলার, স্কেল, কলম, পেন্সিল যাবতীয় লজিস্টিকস নিয়ে বসতাম। অনেকেই আসতো, ছাত্ররা আসতো তাদের অভিভাবকরা আসতো। আমরা চেষ্টা করতাম তাদের কাছাকাছি পৌঁছাবার। এভাবেই গড়ে উঠতো একটা সম্পর্ক। পরবর্তীতে দেখা যেতো এদের মধ্যে অনেকেই আমাদের সমর্থক বা কর্মী নিদেনপক্ষে আমাদের বন্ধু হয়ে উঠতো। ভর্তির পর তাদের হলে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়াও একটা কাজ। মোটকথা আমাদের টার্গেট থাকতো ছাত্রদের সাথে মানসিকভাবে একাত্ম হওয়া। রাজনীতির আগে তাদের সাথে একটা মানবিক সম্পর্ক স্থাপন করা। রাষ্ট্রপতি ছাত্রনেতাদের সামাজিক হবার একটি প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতির কথাই বলতে চেয়েছেন। উনার বক্তব্যে পরিষ্কার হতাশার ছাপ ছিলো। বিষয়টি ভেবে দেখার দাবি রাখে।
২. ছাত্রনেতাদের বয়স এবং বিয়ে নিয়ে উনি অনেক মজা করেই কিছু কথা বলেছেন। এর মধ্যে কী এক কঠিন এবং করুণ বাস্তবতাকে তিনি সামনে এনেছেন সেটা না দেখে যদি কেবল মজাটাই দেখি তাহলে মস্ত বড় একটা ভুল হয়ে যাবে। ছাত্রনেতাদের বিয়ে এবং বয়স নিয়ে অনেক বছর ধরেই আমরা কথা বলছি। অনেক লেখালেখি চলছে। রাজনৈতিক দলগুলি তাদের সংবিধানেও বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন কিন্তু বাস্তবে কী তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ছাড়া ক্ষমতা এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা যেসব ছাত্র সংগঠন আছে তাদের প্রায় প্রতিটা নেতাই ৪০ এর ঊর্ধ্বে বয়স। কারো কারো বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চাও বড় হয়ে গেছে।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি, সেটি হচ্ছে ছাত্রনেতাদের হতে হবে ছাত্রদের কাতারের। বয়সের সাথে সাথে প্রতিটা মানুষের আবেগ, অনুভূতি, প্রয়োজন এবং ব্যক্তিত্ব সবকিছুতেই আসে পরিবর্তন। ছাত্রনেতারা যদি ছাত্রদের আবেগকেই ধারণ না করতে পারে তাহলে রাজনীতি করবে কাদের নিয়ে? সংসার করা একজন মানুষের কাছে ছাত্রদের ইস্যুর চেয়ে তার ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়াটাই হবে বড় এটাই স্বাভাবিক।
৩. নেতা তৈরি, ছাত্রদের ছাত্রনেতা হবার দাবিকে কেন্দ্র করে তিনি অত্যন্ত জোর দিয়েই বলেছেন “ডাকসু ইলেকশন ইজ মাস্ট”। কথাটা তিনি কিন্তু তার সরকারের এজেন্ডার বাইরে হয়তো বলেছেন কিন্তু এটাই যে তিনি বিশ্বাস করেন সেটা তাঁর প্রকাশভঙ্গিতেই স্পষ্ট ছিলো। এই একটা বিষয়ের উপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ নেতা তৈরি থেকে শুরু করে ছাত্ররাজনীতির হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা সহ অনেক কিছু। তিনি একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদ হিসাবেই জানেন কেমন করে দেশে রাজনীতির সুস্থ ধারা ফিরে আসে আর কেমন করে দেশে নেতা সৃষ্টি হয়। নেতৃত্ব শূন্য বা রাজনীতিকে বাদ দিয়ে দেশ আগাতে পারেনা। রাষ্ট্রপতির এই কথাটি হতে পারে সরকার এবং প্রশাসনের জন্য একটি মেসেজ। এই বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশী আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। হয়তো আবারো আমরা ফিরে পেতে পারি রাজনীতির একটি সুস্থ ধারা।
৪. রাষ্ট্রপতি তাঁর দেরি করে বিএ পাস করা বা ছাত্র খারাপ কী ভালো এ নিয়ে অনেকেই মজা করছেন। অনেকেই বলছেন একজন অমেধাবী ছাত্র কীভাবে দেশের প্রেসিডেন্ট হলেন? কথাটির উত্তর কিন্তু তাঁর বক্তব্যে তিনি দিয়েছেন। তখন তাদের কাছে পাস ফেইলের চেয়ে দেশের স্বাধীনতা আদায় করা ছিলো প্রধান। উনারা নিজের প্রতিষ্ঠার চেয়ে দেশকে প্রতিষ্ঠা করাটাকেই মনে করতেন দায়িত্ব। ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড় এই কথাটা তাঁরা প্রকৃতই বিশ্বাস করতেন এবং চর্চা করতেন। আজকের যুগে এই দেশপ্রেমের অভাব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যারা রাজনীতি করছেন তাদের বেশীরভাগেরই একটাই উদ্দেশ্য থাকে সেটা হচ্ছে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠা। আজকাল রাজনীতিকে বলা হয় অন্যতম সফল ব্যবসা। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে রাজনীতির প্রতি তাঁদের ডেডিকেশন এবং কমিটম্যান্টের কথাটা যদি না বুঝি তাহলে উলটা বুঝাটাই স্বাভাবিক।
৫. রাষ্ট্রপতি ছাত্রদের চেহারা দেখা, গাউন পরে থাকা এবং কনভোকেশনের টাইমিং নিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন শুনতে খুব ছোট মনে হলেও কথার পিছনে লুকিয়ে আছে একটি সঠিক পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা। টা খুব সত্যি কথা যে আপনি যখন বক্তব্য দিচ্ছেন তখন আপনাকে অবশ্যই অডিয়েন্সের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে বক্তাকে তার বক্তব্যের ডিজাইন ঠিক করতে হয়। একজন জাত বক্তা এটাই করে থাকেন। আর লিখিত বক্তব্যকে পরিহার করাটাও এর একটি পার্ট হিসাবেই ধরতে হবে। যে কোন কর্মসূচী ঘোষণা করার আগেই সঠিক পরিকল্পনাটি নির্ধারণ করতে হবে। রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন বলেই আশা করছি।
তাই রাজনীতির এই ক্রান্তিকালে আমাদের জন্য রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য হতে পারে অনেক দিক নির্দেশনামূলক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও আজকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকছেনা। ইতিহাস বিকৃতির মত ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে। এর পিছনে মূল কারণ সঠিক রাজনীতিক চর্চার অভাব। প্রশাসনের কোন কিছু নিয়ে প্রতিবাদের কোন ফোরাম আজকে আর নেই। ছাত্রদের অধিকার নিয়ে নেই কোন লড়াই সংগ্রাম। এই নিস্তেজ পরিবেশ আমাদের দেশের জন্য ভয়াবহ বার্তা নিয়ে আসছে। অবিলম্বে তাই রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের ধারাকে অবলম্বন করে দেশের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সুস্থ ধারাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক। আর সেটা একমাত্র ‘ডাকসু’ নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব বলে মনে করি।
আব্দুল হামিদের মতো রাজনীতিবিদেরা আজকাল হারিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের সময়কার লোকগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন। সেই শূন্যস্থান আর ভরাট হচ্ছেনা। দেশে আজ অনুকরণীয় চরিত্র নাই বললেই চলে। কী ভয়াবহ এক পরিবেশ সামনে আসছে সেটা হয়তো এখনো আমরা অনুমান করতে পারছিনা। এই অন্ধকার থেকে তোলে আনার মতো নেতা আমাদের চাই। আব্দুল হামিদরা যত মুখ বন্ধ করে রাখবেন ততই আমাদের জন্য ক্ষতিকর। তাই সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমাদের প্রত্যাশা তিনি আরো বেশী বেশী দিক নির্দেশনা নিয়ে আসেন। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে তিনি সরকারেও কথা বলবেন।
তিনি রাষ্ট্রের বড় কর্তা। তিনি চাইলেই অনেক কিছু সমাধান করা সম্ভব।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য