প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ১৮ মার্চ, ২০১৭
এখন সুদিন।
বঙ্গবন্ধুর নামে এখন দেশে মুহুর্মুহু স্লোগান দেয়ার মানুষের অভাব নেই। যে বা যারা কখনোই কোনদিন আওয়ামীলীগ করেননি, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে আস্থা রাখেননি তারাও এখন বঙ্গবন্ধুর নামে সুবিধাবাদী গলির মুখ থেকে বের হওয়া মিছিলের অগ্রসেনানী, দলের কাণ্ডারি।মূল ও স্বীকৃত অঙ্গসংগঠন বাদেও দোকান খুলে বসা অজস্র সংগঠনের স্বার্থান্বেষী ব্যানারে ছেয়ে গেছে দেশ। দুধের মাছি আর বসন্তের কোকিলে ভরা এই ফাগুন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির আদর্শ, লক্ষ্য, স্বপ্ন, সংগ্রাম ও ত্যাগের মহিমায় বিশ্বাস করা, আস্থা রাখা ও চর্চা করা মানুষের এখনো বড়ো অভাব। বঙ্গবন্ধুর ৯৭তম জন্মদিনকে সামনে রেখে চারদিকে রমরমা রঙিন উৎসব আয়োজন, ঢাক-ঢোল, বাদ্যি-বাজনা, কাঙালি ভোজ, প্রচার প্রচারণা দেখে তাই মনে পড়ে।
অথচ এদিনে লোক দেখানো, নেতাদের নিজের ঢোল পেটানো এসব উৎসবের চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি, বাংলাদেশের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা, বিকাশ ও অগ্রগতির পর্যালোচনা, আগামীর করনীয় বা দিক নির্দেশনা ঠিক করা নিয়ে আলোচনা। সেরকম কিছু কোথাও আজকের দিনে হয়েছে বলে চোখে পড়েনি।
পাকিস্তান বা ভারতবর্ষের জমিদার, নবাব, সামন্ত-প্রভুদের দখলে থাকা রাজনীতির অভিজাততন্ত্রের শেকল ছিঁড়ে তদানীন্তন ফরিদপুরের সম্পন্ন এক কৃষক পরিবারের সন্তান কিভাবে এ অঞ্চলের হাজার বছরের বঞ্চিত মানুষের বুকের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নের আগুন ছড়িয়ে দিলেন তা নিয়ে এখানে প্রাতিষ্ঠানিক নির্মোহ আলোচনা খুব দুর্লভ।
নদী-বিধৌত বাঙলার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, মধুমতী নদী তীরের উর্বর পলি মাটির কোমল-কঠিনে গড়া বঙ্গবন্ধু মুজিব একাত্তরের আগে সক্রিয় রাজনীতির ৩২ বছর জীবনের ৪০ শতাংশ সময় জেলে কাটালেন, জীবনের ৪৮ শতাংশ সময় কাটিয়েছিলেন মিটিং মিছিল, সভা-সমিতি আর বক্তৃতায় - মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে (“বঙ্গবন্ধু – সমতা- সাম্রাজ্যবাদ”, আবুল বারাকাত)। আজকের নেতাদের স্মরণে ও কল্পনায় এসব আত্মত্যাগের কথা আসে না।
হাজার বছরের এ শ্রেষ্ঠ বাঙালি ছিলেন রাজনীতির কবি।
কবিতার সুসামঞ্জস্য শব্দের কাজ হলো মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করা, জাগানো ও নতুন স্বপ্নলোকে উদ্বেলিত করা। তিনি তাই করতে পেরেছিলেন। আমরা দেখি, পৃথিবীর ইতিহাসে সময়ের উজ্জ্বল অনেক নায়কেরা তাঁর আশাহীন জাতির মানুষের সামনে অনেক যুগান্তকারী ভাষণ দিয়েছেন। যা ইতিহাসকে পালটে দিয়েছে, নতুন গতিপথ নির্ধারিত করেছে। রচনা করেছে এক নতুন যুগান্তর। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, ১৯৬৩ সালের লিঙ্কন মেমোরিয়াল হলে মার্টিন লুথার কিং আমেরিকার বর্ণ বৈষম্যের শিকার, শোষিত, নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলছেন, “I have a dream that one day this nation will rise up(আমার একটি স্বপ্ন আছে এ জাতি একদিন জেগে উঠবে, ঘুরে দাঁড়াবে ...) সে ভাষণ, সে ডাক আজ ইতিহাসে আজ অমর।
স্থানিক ও কালিক পার্থক্য বাদে একটু ভিন্ন সমান্তরালে লক্ষ লক্ষ আশাহীন মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া পৃথিবীর আরেক শ্রেষ্ঠ ভাষণের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি।
৭ মার্চ, ১৯৭১।
ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল, বিক্ষুব্ধ জলরাশির মত সামনে লক্ষ লক্ষ উন্মুখর অধীর জনতা। রাজনীতির মহাকবি আসছেন পৃথিবীর ইতিহাসে রচিত তাঁর অনবদ্য কবিতাখানি নিয়ে। যে কবিতার নাম হবে বাংলাদেশ। শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মত দৃপ্ত পায়ে হেটে। জন সমুদ্রের জোয়ারে গণ-সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে তিনি শোনালেন সেদিন তাঁর অমর কবিতাখানি, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম "। স্বপ্ন নয়, কোন আশ্বাস নয়, তিনি সিংহের সাহস বুকে নিয়ে গর্জন করে বললেন,“আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।”
“কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।” - পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে বড়ো সাহসী, শক্তিমান উচ্চারণের তুলনা বিরল, দুর্লভ। নানা সময় পাল, সেন, মোঘল, ইংরেজ, পাকিস্তানীদের শোষণের শিকার বাঙালি জাতিকে এরপর আর কেউ দাবায়া রাখতে পারেনি। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবের জীবনের সবচেয়ে বড়ো অর্জন। তিনি ছিলেন আমাদের মতো উৎপীড়িতের, শোষিত আর বঞ্চিতের জনপদে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।
তাঁর সময়ের রাজনীতিবিদরা জনগণের জন্য ত্যাগের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। এখন নেতারা ভোগের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লেও দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু এক জায়গায় মওলানা ভাসানী প্রসঙ্গে লিখেছেন, “মওলানা অনেক বিষয়ে অনুদার ছিলেন। কিন্তু তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাই তাকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম।”
বঙ্গবন্ধু আরো লিখছেন, “যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত না তাঁরা জীবনে কোন ভালো কাজ করতে পারে নাই - এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ করতে হবে এদেশের জনগণকে সুখী করতে হলে। ”
আমৃত্যু তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। তাঁর চেয়ে বড়ো ত্যাগ এদেশে কেউ করে নাই। পৃথিবীর ইতিহাসেও এমন আত্মত্যাগ বিরল।বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বারবার পরিষ্কার করে বলেছেন, “আমারা চাই শোষিতের গণতন্ত্র, শোষকের গণতন্ত্র চাই না।” আমাদের গণতন্ত্র যেন শোষকের না হয়, শোষিত মানুষের পক্ষে হয়।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের “বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ”বইয়ে আরেকবার উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখছেন,“বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এ দেশের গণ মানুষের সুখ সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন।”
ভাগ্য বিড়ম্বিত, শোষিত বাঙালি জাতির ভাগ্যোন্নয়নে সে সংগ্রাম তিনি আমৃত্যু জারি রেখেছিলেন। কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সোনালী যৌবনের শ্রমে, ঘামে আর রক্তে ভেজা বাংলাদেশে শ্রদ্ধাবনত চিত্তেই তাকে আমাদের স্মরণ করা উচিত। নতুন প্রজন্মকে তাঁর রাজনীতির দর্শনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া আজ বেশি জরুরী। তাই বঙ্গবন্ধুর নামে স্বার্থান্বেষী স্লোগান দেওয়ার চেয়ে বঙ্গবন্ধু জীবন রাজনীতির পাঠ আজকের সময়ে বেশি জরুরী।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য