প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
দেবজ্যোতি দেবু | ১৮ মার্চ, ২০১৭
মাত্র বছর কয়েক আগে ২০১৩ সালে আমরা দেখেছিলাম বিদেশি বারের ছবি ফেসবুকে আপ্লোড দিয়ে বলা হয়েছিল সেটা শাহবাগের ছবি! উদ্দেশ্য ছিল শাহবাগের গণআন্দোলনকে কলঙ্কিত করা। কাবাঘরের ইমামের গিলাফ চড়ানোর ছবি এডিট করে রাজাকার সাঈদীর মুক্তির জন্য মানববন্ধন করার ছবি বলে চালানো হয়েছিল! উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে মুক্ত করার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। দেখেছি প্রগতিশীল বিভিন্ন অনলাইন এক্টিভিস্টের নামে ভুয়া আইডি করে বিভিন্ন আজেবাজে পোস্ট ফেইসবুকে প্রচার করা! উদ্দেশ্য ছিল এক্টিভিস্টদের সাধারণ মানুষের কাছে বিতর্কিত হিসেবে উপস্থাপন করা।
কিছুদিন আগেও দেখেছি রসরাজ নামের হিন্দু সম্প্রদায়ের এক জেলের ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে তার আইডি থেকে বিতর্কিত ছবি আপ্লোড করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের ঘটনাও। উদ্দেশ্য, সাম্প্রদায়িক সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা। এর সবকিছুই ছিল ছবি এডিট করে সাধারণ মানুষের চোখে ধূলা দেয়ার অপচেষ্টা। দিনশেষে সবকিছুই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এ বছর দোল পূর্ণিমায় (১২ মার্চ) পুরান ঢাকায় শাঁখারীবাজারে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অংশগ্রহণে উৎসব মুখরভাবে দোল উৎসব পালন করা হচ্ছিল। এক পর্যায়ে কিছু বখাটে এই রঙ খেলায় ঢুকে গিয়ে পথচারী ও অফিসগামী বিভিন্নজনকে রঙ মাখিয়ে লাঞ্ছিত করে। এমনকি রিক্সায় চলমান নারীদের গায়ে মুখে রঙ লাগিয়ে নানা কুরুচীপূর্ণ মন্তব্য ও অঙ্গভঙ্গী করে। এর ফলে সেখানে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। টিভিতে যমুনা নিউজে এই ফুটেজ দেখে আঁতকে উঠি। এগুলো কখনোই সভ্যদের কাজ না। কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিংবা কারো অনুমতি ছাড়াই তাকে রঙ লাগানো অন্যায়। সেটা বুঝতে হবে। শালীনতা বজায় রেখেই আনন্দ করা সভ্যতা। তাহলে এমন অসভ্যতা কেন? মনের মধ্যে তাৎক্ষণিক কিছু প্রশ্ন জাগে।
১) জানা মতে এমনটা আগে কখনোই হয়নি। তাহলে এই বছর কেন হচ্ছে?
২) ঘটনাটা কি পূর্ব পরিকল্পিত?
৩) সারা দেশেই তো দোল উদযাপন হচ্ছে। এমনকি ঢাকায়ও অনেক জায়গায় হচ্ছে। অন্য কোথাও এমনটা হলো না। এখানেই কেন হলো? তাহলে কি সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়েই সেখানে ঐ কাজটি করা হয়েছে?
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে যাই। ঘটনার গভীরে পৌঁছার চেষ্টা করি। গত কয়েক বছর ধরে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যেভাবে দেশের সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় উৎসবের পিছনে লেগেছে তাতে করে যেকোন ধরনের নেতিবাচক ঘটনা ঘটাতে তারা বদ্ধপরিকর। পহেলা বৈশাখের নোংরা ঘটনাটাও এর একটা উদাহরণ হতে পারে। তারা চায় না বাঙ্গালি জাতি উৎসবে মেতে থাকুক। তারা চায় না বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচুক। তাই প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে বলে তারা বাংলাদেশকে 'সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র' প্রমাণ করার চেষ্টায় মেতে আছে।
আমার ধারণামতে এটা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে করা হচ্ছে। রঙ খেলার আনন্দটা যাদের সহ্য হয় না, যারা এই সংস্কৃতি থেকে বাঙ্গালিদের দূরে সরাতে চায়, তারাই পরিকল্পিত ভাবে মানুষের মনে রঙ খেলা নিয়ে ভয়ের সঞ্চার করতেই এমনটা করেছে। এই নেক্কারজনক ঘটনা যত প্রচার হবে মানুষের মনে দোল পূর্ণিমা এবং হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্মাবে। মানুষ এমন উৎসব থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখবে। সেই সুযোগে চাপ প্রয়োগ করে একদিন এই দোল উৎসব বন্ধ করে দেয়া যাবে!
সন্দেহটা আরো দৃঢ় হয় যখন পরের দিনই ড. তুহিন মালিক নামে একজনের ফেসবুক আইডি থেকে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক পোস্ট আসতে দেখি। ঐ লোকটা কে এবং তার রাজনৈতিক মতাদর্শ কি সেটা আজ আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। সকলেই আশা করি সেটা জানেন। দোল পূর্ণিমা নিয়ে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে নোংরা মন্তব্য করে ('মালু সন্ত্রাসী', 'হিন্দু পতিতার বাচ্চা' ইত্যাদি) এমনকি শাঁখারিবাজারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানান বিভ্রান্তি এবং উস্কানিমূলক কথা বলে এই ভিডিও ফুটেজ তিনি শেয়ার করেন এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেটা ভাইরাল হয়ে যায় ফেইসবুকে। তার সাথে যোগ দেন পিনাকী ভট্টাচার্য নামের আরেক এক্টিভিস্ট। শুরু হয় নানান সাম্প্রদায়িক গালাগালি, হুমকি-ধামকি, এমনকি বেশিরভাগ পোস্ট থেকেই দোল উৎসবকে 'হিন্দুদের উৎসব' আখ্যায়িত করে তাতে অংশগ্রহণ করতে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকদের নিষেধ করা হয়!
প্রশ্ন জাগে, উৎসবতো সার্বজনীন। এতে সকল ধর্মের মানুষ সমানভাবে অংশগ্রহণ করবে। তাহলে এখানে সাম্প্রদায়িক দেয়াল তোলার উদ্দেশ্য কি?
বছর দুয়েক আগে বৈশাখী উৎসবেও টার্গেট করা হয়েছিল নারীদের। টিএসসি এলাকায় ঘটানো হয়েছিল নেক্কারজনক ঘটনা। উদ্দেশ্য ছিল বৈশাখী উৎসবকে কলঙ্কিত করা। এর আগের এবং পরের মৌলবাদীদের অপপ্রচার প্রমাণ করেছিল নববর্ষ উদযাপন বিরোধীরাই ঐ অপকর্মের সাথে জড়িত। দোল উৎসবের ঐ অপ্রীতিকর ঘটনাও যে ভিন্ন কিছু না সেটা প্রমাণ হয়ে যায় দু'দিন পরেই। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয় যে, কোতয়ালী থানার শাঁখারীবাজারে দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনায় ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে কোতয়ালী থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো মো. আকাশ (১৯), মো. সিফাত (২০) ও মো. মামুন (১৮)। খবরে প্রকাশ, ঐ বখাটেরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ঐ উৎসবে উপস্থিত হয়েছিল।
লক্ষ করুন, বখাটেরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঐ উৎসবে অংশ নিয়েছিল। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগে কি ছিল তাদের উদ্দেশ্য? বখাটেপনা করার জন্য বেছে বেছে বোরখা পরিহিত মেয়েদেরই কেন তারা টার্গেট করেছিল? এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে আবার ফিরে যাই তুহিন মালিকের সেই উস্কানিমূলক পোস্টে। দেখি, তুহিন মালিক খুব কৌশলে ঐ বখাটেদের 'হিন্দু' এবং বোরখা পরা মেয়েদের 'হিন্দুদের আক্রমনের শিকার' বলে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। মানে বাংলাদেশে হিন্দুদের হাতে মুসলিম নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন, এমনটাই উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে! সেক্ষেত্রে বোরখা পরা মেয়েদের টার্গেট করা হয়েছে কারণ হিন্দু মেয়েরাতো আর বোরখা বা হিজাব পরে না। তাই ঘটনাটাকে একটা সাম্প্রদায়িক উস্কানির পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে এটাই মোক্ষম অস্ত্র। মুখে রঙ মাখা থাকলে হামলাকারীদের সহজে সনাক্ত করা যাবে না। আর এই সুযোগে সম্পূর্ণ দোষ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলার পরিবেশ সৃষ্টি করা যাবে খুব সহজেই।
একদিন আগেও যারা শাঁখারিবাজারের ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের একবাক্যে গালি দিয়ে যাচ্ছিলো, উস্কানি দিচ্ছিলো, হঠাৎ করেই তারা চুপ হয়ে গেল! কেন? আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে ভয় লাগলো বলে? তুহিন মালিকের পোস্টগুলোও আর পাওয়া গেল না। ঘটনার সত্যতা জানার পরেও পূর্বের নোংরা পোস্টগুলোর জন্য তার কোন ধরনের দুঃখপ্রকাশও চোখে পড়লো না! তার মানে কি দাঁড়ায়? তিনি যা লিখেছেন বা প্রচার করার চেষ্টা করেছেন সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে এবং উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই করেছেন। তিনি সম্ভবত আশা করেননি পুলিশ প্রশাসন এই ঘটনায় জড়িতদের এতো দ্রুত গ্রেফতার করে ফেলবে। তাই এই যাত্রায় তার কূটকৌশল সফলতার মুখ দেখেনি। অবাক লাগলো, অনুভূতিপ্রবণ জাতির কাছে অনুভূতিতে আঘাত লাগার অপরাধে রসরাজের মাথার দাম নির্ধারণ হয়ে যায় খুব সহজে আর তুহিন মালিকের পোস্ট শেয়ার হয় হাজারে-বিজারে। প্রশ্ন জাগে, সভ্য একটা জাতির কাছে মানুষের মূল্যায়ন হয় কিসের ভিত্তিতে?
আচ্ছা, ঐ তিনজন যদি সত্যিই হিন্দু সম্প্রদায়ের হতো তাহলেও কি এই উস্কানি এবং গালাগালি যৌক্তিক হতো? সাম্প্রদায়িক হামলা হলে, সেটাও কি যৌক্তিক হতো? দোল পূর্ণিমা উৎসবটাও কি খারাপ কোন উৎসব হয়ে যেত? গুটিকয়েক জঙ্গির জন্য পুরো সম্প্রদায়কে দোষ দিতে যারা নারাজ, তারাই বা আজ কোন যুক্তিতে গুটিকয়েক বখাটের (পরিচয় জানার পূর্বে) অপকর্মের জন্য অন্য সম্প্রদায়ের দিকে আঙুল তুললেন?
কেউ কেউ বলছেন, নিজেদের উৎসবে অন্য ধর্মের লোকদের সম্পৃক্ত করার কারণেই এমনটা হয়েছে! এটাও কিন্তু এক ধরনের বোকামি। উৎসব সার্বজনীন। এখানে সকলের অংশগ্রহণই উৎসবকে সুন্দর করে তোলে। এটা সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকা উচিৎ। কিন্তু সেই সাথে নিজেদের চোখ কান খোলা রাখা উচিৎ যেন অন্য কেউ কোন ধরনের নোংরামি করার সুযোগ না পায়। সেদিন উপস্থিত সকলের উচিৎ ছিল নোংরামি করা ছেলেদের সাথে সাথেই ধরে পুলিশে দেয়া। সেটা না করার ফলেই বিষয়টা এতো জঘন্য রূপ নিয়েছে। তাই বলতে পারি, আনন্দ উদযাপনে নিজেরা সতর্ক থাকুন, শালীনতা বজায় রাখুন। নাহলে উৎসব বিরোধীরা এই সুযোগে সবাইকে উৎসবের বিরুদ্ধে নিয়ে দাঁড় করাবে আর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ানোরও সুযোগ পাবে।
একটা সভ্য, শিক্ষিত সমাজের অংশ হয়েও এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে, লিখতে লজ্জা লাগে। যেখানে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির ছবি প্রচার হবার কথা, বিশ্বের দরবারে একটি সভ্য দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কথা, সেখানে এমন অসভ্যতা নিয়ে কথা বলতে হয় ভেবে লজ্জা লাগে! দেশের স্বার্থে, দেশের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে, অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমুন্নত রাখার স্বার্থে, এমন নোংরা অপপ্রচার চালানোর দায়ে ড. তুহিন মালিক এবং পিনাকী ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানাই। এমন উস্কানিমূলক পোস্ট দেয়ার কারণ অনুসন্ধানের দাবি জানাই। তাদের বিচারের দাবি জানাই।
ভাল থাকুন, ভাল রাখুন। উৎসবের আনন্দ সকলে মিলে উপভোগ করুন। মৌলবাদীদের উস্কানি, অপপ্রচার শক্ত হাতে দমন করুন। মন থেকে সাম্প্রদায়িক কলুষতা দূর করে আমাদের দেশকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করুন। জয় হোক মানুষের।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য