প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এনামুল হক এনাম | ০৩ মে, ২০১৫
আমরা ক্রিকেট দর্শকরা সবসময়ই জানতাম আমাদের সেই সামর্থ্য আছে, আমরা পারবো। জানতাম আমাদের দল নতুন, জানতাম তাদের সময় দিতে হবে। ৮৬সাল থেকে একদিনের ক্রিকেট আর ২০০০ সাল থেকে টেস্ট ক্রিকেট... পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। আমরা ধৈর্যচ্যুত হইনি। একের পর এক এক-দিবসের ক্রিকেটে হেরেছি, কালে ভাদ্রে এসেছে জয়! আমরা দমে যাইনি, আমরা জানতাম আমাদের সামর্থ্য আছে।
টেস্ট ক্রিকেটে ১৫বছর সময় খুব একটা বড় সময় নয়, তারপরও নিন্দুকেরা বার বার আমাদের সামর্থ্য, খেলার মান, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। একের পর এক ম্যাচ আমরা হেরেছি, তাও শুধু হারা হয় অধিকাংশই ইনিংস এর ব্যবধানে লজ্জায়। খুব বেশি ভাগ্য ভালো থাকলে বৃষ্টির কারণে ম্যাচ ড্র হতো কিংবা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের বিরুদ্ধে কদাচিৎ জয়।
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলাবলি করা শুরু করলেন আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস বাতিল করা হোক। ক্রিক-ইনফোতে পাকিস্তান কিংবা ভারতের মন্তব্যকারীদের মন্তব্য করতে দেখতাম, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নিয়ে আফগানিস্তানকে দিয়ে দেয়া হোক। মন্তব্য পড়ে মনে মনে বলতাম, সবুর কর বাছারা, কয়টা দিন সবুর কর, আমাদেরও সময় আসবে।
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছর যায়। আমাদের সময় আর আসে না!
তারপরও আমাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো আমরা পারবো। শুধু এই বিশ্বাসটা খেলোয়াড়দের মাঝে সঞ্চারিত হওয়া বাকি ছিলো। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর থেকে একে একে দলের বয়োবৃদ্ধ খেলোয়াড়রা চলে যেতে শুরু করলেন। তাদের কাজ তারা খুব ভালো ভাবে সমাপ্ত করেছিলেন। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে ১৯৯৯ সালের সেই বিশ্বকাপ এখনো স্মৃতিতে অম্লান। কিন্তু তাদের চলে যাওয়ার পর আমাদের দেশের ক্রিকেট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ওতো ভালো না হওয়ায় তাদের পরিবর্তে যে ভালোমানের খেলোয়াড় যোগান দিতে পারলাম না আমরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
দেশে ক্রিকেটের ভালো পাইপ লাইন না থাকায় ভালো মানের খেলোয়াড় পেতেও অসুবিধা হতে থাকলো। দু-এক জন ধূমকেতুর মত এসে হারিয়ে গেলেন। ২০০৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে নিজেদের চরম খারাপ খেলাটা খেলে কানাডার মত একটি শৌখিন দলের কাছে হেরে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করলাম। তারপরও আমরা হতাম হইনি। কারণ আমরা জানতাম আমরা পারবো।আমাদের সামর্থ্য আছে।
প্রথমবারের মত দলে একঝাঁক তারকা উঠে এলো ২০০৫ সালের দিকে। ২০০৭ সালে বলে-কয়ে হারিয়ে বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ থেকেই বিদায় করিয়ে দিয়ে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখলাম। আমরা জানতাম আমাদের সামর্থ্য আছে, আমরা পারি। শুধু ক্রিকেটারদের নিজেদের সামর্থ্যের উপর উপর বিশ্বাস জন্মানোর প্রয়োজন ছিলো।
কেনিয়া, জিম্বাবুয়েকে আমরা তখন পাত্তা দেই না। হোক দুর্বল ভাঙ্গাচোরা তারপরও "ওয়েস্ট-ইন্ডিজ", ঐ দলকেও তাদের দেশে গিয়ে ধবল ধোলাই করি। নিউজিল্যান্ডকে নিজেদের দেশের ধবল-ধোলাই করে নাম দেই "বাংলাওয়াশ"। তাও একবার নয় দুই-দুইবার। বিশ্বকাপ সহ একদিনের ম্যাচে মাঝে মধ্যেই হারাতাম বড় দলগুলোকে, সবাই বলতো "আপসেট"। আমরা বলতাম তাই সই।
স্মরণীয় খেলাগুলোর মধ্যে নিজেদের চেনা, জানা আর সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস জন্মানোর খেলা ছিলো এশিয়া-কাপে। ভারত, শ্রীলংকাকে হারিয়ে ফাইনালে অনাকাংখিতভাবে হেরে গেলাম পাকিস্তানের সাথে। সাকিব, তামিম আর মুশফিকদের অশ্রুসিক্ত ছবি শেয়ারিং হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পাকিস্তানীরা এ নিয়ে কি হাসাহাসি! ক্রিকেট তাদের জন্য শুধুই একটি খেলা। আমাদের জন্য খেলার চেয়ে একটু বেশি কিছু। আমরা জানতাম আমাদের দিন আসবে, আমরা পারি, আমরা পারবো। শুধু আমাদের খেলোয়াড়রা নিজেদের চেনার প্রয়োজন ছিলো।
সদ্য সমাপ্ত ক্রিকেট বিশ্বকাপে নকআউট রাউন্ডে তো খেলেছিই সবচেয়ে ভালো লেগেছে খেলোয়াড়দের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। ক্রিকেটে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অনেক বড় একটি ব্যাপার। সদ্য সমাপ্ত ক্রিকেট বিশ্বকাপে আমাদের খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাষাই বলে দেয় আমদের ক্রিকেট কতদূর এগিয়েছে।
পাকিস্তান যখন এবার সিরিজ খেলতে এলো, তখন সাকিব আগ বাড়িয়ে বলে দিলেন এই সিরিজে আমরাই ফেভারিট। অনেকেই ভ্রুকুটি করেছেন। এক-দুটি ম্যাচ হয় নয় নিজেদের পুরো ফেভারিট দাবী করার মত সাহস বাংলাদেশে কবে কোন খেলোয়াড় দেখিয়েছিলেন, তাও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তা গবেষণার বিষয়। আমরা দর্শকরা অনেক আগে থেকেই জানতাম আমরা পারি, আমরা পারবো! শুধু আমাদের খেলোয়াড়দের নিজেদের চেনার বাকি ছিলো, নিজেদের সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস আনা বাকি ছিলো, বুঝলাম লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি আমরা।
প্রথম ম্যাচেই চমকে গেলো পাকিস্তান। ক্রিকেট দুনিয়ার অনেক নিন্দুকে বললো এটা আপসেট। দ্বিতীয়, তৃতীয় ম্যাচে পাকিস্তানকে আউটপ্লে করলো আমাদের দল। নিন্দুকের সবার মুখে তালা। তারপরও অনেকেই মিনমিন করে বলতে থাকলেন, পাকিস্তান নতুন দল, অনভিজ্ঞ, এজন্য এমন হয়েছে। টি-২০ তে জনাব আফ্রিদি আসছেন। সিনিয়র খেলোয়াড়রা খেলবে, পাকিস্তান টি-২০ তে অসম্ভব শক্তিশালী দল, বাংলাদেশের খবর আছে। খেলা শেষ হলো ষোল অভাবের ভিতরে, সাত উইকেটে জিতলো বাংলাদেশ। ক্রিক-ইনফো তে এক পাকিস্তানীর মন্তব্য ছিলো, আফ্রিদিকে ভুল আউট না দিলে ম্যাচের ফলাফল অন্য রকম হতে পারতো। সেখানে এক বাংলাদেশীর মন্তব্য আমার চমৎকার লাগলো, খেলা হেরে গেছো রে! ২২ বল হাতে রেখে ৭উইকেটে জিতেছি, বাকি থাকা ২২ বল তোর আফ্রিদির জন্য উপহার।
পাকিস্তানের বিভিন্ন চ্যানেলে বার বার বলা হচ্ছিল এই সিরিজের জন্য তাদের দল প্রস্তুত হয়, দল নতুন, বয়সে তরুণ, অনভিজ্ঞ। তবে এক সমালোচকের কথা চমৎকার লাগলো, পাকিস্তান দলের গড় বয়স প্রায় ২৮বছরের বেশি, এই দলকে কি আমরা আরো ১৫-২০ বছর খেলিয়ে বুড়ো করে তারপর অভিজ্ঞ হবো!! বাংলাদেশ দলেও একাধিক নতুন মুখ আছে, পাকিস্তান দলেও আছে। এইসব কোনো অজুহাত হতে পারে না। আমরা খারাপ খেলেছি তারা ভালো খেলেছি। দিন শেষে আমর হেরেছি।
টেস্টে নাকি পাকিস্তান ভালো দল, বাংলাদেশকে ধুয়ে দেবে!
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ একটু ধীর ছিলো, স্বাভাবিক। সবার স্মরণ রাখা উচিত কত বিরতি দিয়ে আমরা টেস্ট খেলছি। আমাদের ৩৩২ রানের বিপরীতে পাকিস্তানের ৬২৮, ২৯৬রানের লীড। দ্বিতীয় ইনিংসে আমরা ভালো খেলি না। কি হয় কি হয়! সব দুশ্চিন্তা দূরে সরিয়ে তামিম আর ইমরুল খেললেন অবিস্মরণীয় ইনিংস। প্রায় ৩০০রান পিছিয়ে থেকে ৪র্থ দিনে ব্যাটিং এ নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে কোন দল কবে ২৫০+ লীড নিয়েছে ৫ম দিন পর্যন্ত একটানা ব্যাটিং করে। তাও ওপেনিং এ রেকর্ড, তামিম ২০৬ আর ইমরুল ১৫০!!! এইসব তো আমরা দর্শকরা স্বপ্নে দেখতাম।
পাকিস্তান দল ভেবেছিলো ২৯৬ রান পিছিয়ে থেকে ইনিংস শুরু করে বাংলাদেশ ২৫০-৩০০ এর আশে পাশে অল-আউট হয়ে যাবে। ২য় বার ব্যাটিং এ নামা নাও লাগতে পারে। খুব দরকার পড়লে ২০-৩০ রানের টার্গেটে খেলতে হতে পারে... ইনিংস এর ব্যবধানে কিংবা ১০উইকেটে জয় নিশ্চিত। কিন্তু বিধিবাম, দিন বদলেছে রে ভাই। এ সব বাংলাদেশ আর সেই বাংলাদেশ নেই।
খেলা শেষে আমি ইউটিউবে পাকিস্তান এর বিভিন্ন চ্যানেলের ম্যাচ এনালাইসিস দেখি। গত কাল ড্র হয়ে যাওয়া টেস্ট ম্যাচে সাকিব এবং ওয়াহাব রিয়াজের চোখা চোখি আর আর আঙ্গুল তোলা নিয়ে পাকিস্তানী একটি চ্যানেলে আলোচনা হচ্ছিলো। আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন সাবেক ক্রিকেটার রমিজ রাজা এবং ইউসুফ ইউহানা (মোহাম্মদ ইউসুফ) বলছিলেন, এ কোনো দেখা লাগছে রে ভাই! কই বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের সাথে একটি ফটো তোলার জন্য উদগ্রীব থাকতো, একবার হাই হ্যালো বললে নিজেকে ধন্য মনে করতো! আর এখন চোখে চোখ রেখে কথা বলে, মাঠে আঙ্গুল তোলে কথা বলে!!! পাকিস্তান ক্রিকেটের এমন দিন দেখা লাগবে জীবনে ভাবিনি।
আমরা বলি, শুধু পাকিস্তান ক্রিকেট নয়, এখন থেকে আমাদের খেলোয়াড়রা ক্রিকেটের সকল মোড়লদের সাথেই চোখাচোখি করে কথা বলবে। আঙ্গুল তোলে কথা বলবে। আমরা দর্শকরা অনেক আগেই জানতাম আমরা পারি, আমাদের সামর্থ্য আছে। অপেক্ষা শুধু ছিলো তা প্রমাণের। দিন বদলেছে, এখন আমাদের দলের খেলোয়াড়রা জানে। নিজেদের চিনে, জানে তারা সুন্দর বনের বাঘ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে, সামনে! এটা তো শুধু বাঘের হুংকার ছিলো, যাতে কাপড় ভিজিয়েছে পাকিস্তান, তাণ্ডব এখনো বাকি...
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য