আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ফাঁক ও ‘উগ্রবাদ’ চর্চা

এস এম নাদিম মাহমুদ  

গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম, রাজধানীর একটি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেছিল। এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া এই শিক্ষার্থী গত ১৫ মে মাদারীপুরের নাজিমউদ্দিন কলেজের গণিতের শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর উপর চাপাতি হামলার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে। আঠার বছরের এই কিশোর পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।

শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে হাদি (পরিবারের ভাষ্যে মুকুল) সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া এই মেধাবী তরুণ গত বছর বইমেলার মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল বলে পুলিশের দাবি। আর সেই থেকে তিনিও কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।

আরও এক যুবক সুমন হোসেন পাটওয়ারী এক প্রকাশককে চাপাতিতে আঘাত করে পুলিশের দাবি। তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই যুবকও শিক্ষার্থী। শুধু ফাহিম, মুকুল কিংবা সুমন নয় এদের বয়সী অনেকে আজ দেশে সাম্প্রতিক ‘জঙ্গি’ হামলায় জড়িয়ে পড়েছে। উগ্রবাদী চেতনাকে ধারণ করে দেশে এদের হাতে একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, পুরোহিত, মন্দিরের সেবক, গির্জার ফাদার তাদের চাপাতির তীক্ষ্ণ আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে। স্কুল পেরিয়ে কলেজে প্রবেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত এইসব বিপথগামী যুবকদের রুখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। পথ হারানোর যুবাদের হামলায় গত কয়েক মাসে ৪৭ জন প্রাণ হারিয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

কৈশোর থেকে বেরিয়ে তারুণ্যের উন্মাদনায় যখন নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে মশগুল থাকা প্রয়োজন ঠিক তখনই তারা বিভ্রান্তির পথে পা দিচ্ছে। ওষ্ঠাগত করে তুলেছে সাধারণ মানুষের জীবন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তারা এই মৌলবাদী চিন্তাধারায় নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছে? কেন নিজেদের পরিবার-আত্মীয়-স্বজনের মায়া ত্যাগ করে ‘কথিত ধর্মাতলে’ প্রাণ বিসর্জন দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করছে না? কারা এদেরকে বাঁশি বাজিয়ে বশ করে ফেলছে?

আজকের এই লেখায় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করার চেষ্টা করবো। একের পর এক হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে থাকা কিশোরদের বিপদে কোন কোন অনুষঙ্গ লেপটে আছে তা টেনে বের করার অভিপ্রায়ও থাকবে।

২.
বাংলাদেশের জন্ম খুব বেশি দিনের নয়। পঁয়তাল্লিশ পেরুনো প্রো-পৌঢ় এক স্বাধীন দেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সামলে কূলে উঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ঠিক সেই মুহূর্তে বিভিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক উসকানিতে এই দেশটি পিছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো সামরিক শাসন, কখনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উশৃঙ্ক্ষলতায় আবার কখনো স্বৈরতন্ত্রে গণতন্ত্র হয়েছে ওষ্ঠাগত। এতো চড়াই উৎরাই পেরিয়েও বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যাদের বৈদেশিক রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলার ছেড়েছে। মহা সম্ভাবনাময় এই সবুজ বাংলার আকাশে আজ কালো মেঘ ঘিরে রেখেছে। ভ্যাপসা গরমে সবার যেমন অস্বস্তিতে ভোগে ঠিক তেমনি আমাদের আকাশে জমে থাকা এই মেঘরাশির বজ্রপাতে ঈষৎ তাপ লেগেছে সর্বত্র।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান বেশির দিন নয়। দুই দশকেরও কম সময়ে দেশে সংঘবদ্ধ এক গোষ্ঠি অস্থিরতা তৈরি করছে। এই জঙ্গিবাদী গোষ্ঠিতে সাধারণত দুই খোলসে ঢাকা। এরা হলেন:
১. মুল মদদদাতা বা হিডেন ফেচ
২. তৃণমূল কর্মী বা হামলাকারী।

উগ্রবাদী মদদদাতারা সাধারণত পর্দার আড়াল থেকে ‘জঙ্গিবাদী হামলার’ নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই গোষ্ঠিতে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতা আর আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী বা অর্থদাতা। বিভিন্ন সময়ে মাঠ পর্যায়ে বিপথগামী তরুণদের গ্রেপ্তার পর তারা ‘বড় ভাইয়ের’ কথা বলে আসছে। সাধারণত এই বড় ভাইয়েরা বিভিন্ন প্রলোভন আর মস্তিষ্কে ধবল-ধোয়ানি দিয়ে উগ্রবাদী চেতনার তরুণদের তাদের দলে ভেড়াচ্ছে। এরা চতুরতার সাথে সমাজে মিশে থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আদৌও তাদের বিচারের সামনে আনতে পারেনি। এদের একটি অংশ ধর্মীয় নেতা কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ার তথ্য বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ হয়েছে। দেশে অস্থিরতার ফায়দা লুটে ‘কিছু আন্তর্জাতিক’ সন্ত্রাসী গোষ্ঠির সাথেও যোগসাজশ রয়েছে।

আর দ্বিতীয় ধাপে থাকা কর্মীরাই ভয়ংকর। বর্তমানে জঙ্গিবাদ তথা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া অধিকাংশই শিক্ষিত। পড়ালেখার মাঝখানেই ঢুকে পড়ছে ‘সাম্প্রদায়িক চেতনায়’। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশ্বে তাদের চিন্তাধারার যে বিবর্তন হয়েছে তার জন্য ‘ধর্মীয় অপব্যাখ্যা’ স্বীয় অংশে দায়ী বলে মনে করি। ‘ধর্মীয় উগ্রবাদ ভাবধারায় একদল কৈশোর পার করা সদ্য যুবক সাম্প্রতিক হামলার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাচ্ছে, এই দেশ ‘তাদের স্বীয় বসবাসের যোগ্য নয়। ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাসের ওজনশূন্যতায় সাতার কাটা এই গোষ্ঠি মানুষ মেরে তাই স্বর্গান্বেষায় ভুগছে। যাদের মস্তিষ্ক মুক্তচিন্তার ভাগাড় হওয়ার কথা তাদের সেই খুলিতে কেবল ‘খুন, খুন আর খুন চেপেছে। একের পর এক নিরিহ মানুষকে হত্যা করে তারা ‘নিজেদের মতো করে দেশ’ গড়ার অনুসন্ধিৎসায় নেমেছে। কিন্তু কেন তারা এই পথ বেছে নিয়েছে? আসলেই কি তারা এই অন্ধকার পথে পা বাড়িয়ে ছিল নাকি তাদেরকে ‘কোন অলৌকিক শক্তি পাইয়ে দেয়া হচ্ছে?

৩.
আজকের প্রবন্ধের বিষয় এই বিপথগামী শিক্ষিত জনগোষ্ঠিকে নিয়ে। আমার কাছে দৃশ্যত স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে ‘আমাদের ছাতা তুল্য ‘রাষ্ট্র’ এইসব উগ্রবাদকে উসকে দিচ্ছে। রাষ্ট্রের নিয়ামকগুচ্ছের ভুলের খেসারতে আজ তরুণদের এই অংশটি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এইজন্য রাষ্ট্রও আদালতের বিচারকে বুদ্ধাঙুলি দেখিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ করে নিজের জঞ্জাল মেটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতো সব কিছুর পরও কি দেশে মৌলবাদ কিংবা উগ্রবাদী গোষ্ঠির লালসা রুখতে পারবে?

আমার উত্তরে আসবে ‘না’। কৃষকদের ক্ষেতে এক ধরনের আগাছা (কেল্লা ঘাস) জন্মায় যা মাথা কেটে দেয়ার পর ফের মাথা গজিয়ে দেয়। তাই গোড়াৎপাটন না করা পর্যন্ত এই আগাছা কখনো এই ক্ষেত থেকে নির্মূল হয় না। ঠিক তেমনি, ধর্মীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত এই গোষ্ঠির শিকড় উপড়ানো না হলে ‘এইসব কথিত ক্রসফায়ার’ আরো বেশি বিপথগামীদেরকে উসকে দিবে।

তাহলে কি সেই শিকড়? কোথায় থেকে লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে সাম্প্রদায়িক শক্তি? মৌলবাদ যদি জঙ্গির জননী হয় তবে অন্ধত্ববাদ তার জনক। সেই উপসংহারে মিলবে এই উত্তর।

আগে এক সময় দেশে খুন খারাবিতে পারদর্শী ছিল ‘অশিক্ষিত ও বখাটে ছেলেরা। আর সেই খুনগুলো ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক রেষারেষির ফল। কিন্তু বর্তমানে যেসব নিরিহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে তারা কেউ ব্যক্তিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের বলি হয়নি। সবাইকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিকল্পিতভাবে খুন করা হচ্ছে। খুনের পর পুলিশের অভিযানে যারা ধরা পড়ছে তারা সবাই শিক্ষিত সমাজের অংশ।

তাহলে কি ‘শিক্ষা নেয়া’ এই শিক্ষার্থীরা ভুল শিক্ষা গ্রহণ করছে? তার উত্তরে বলবো, হ্যাঁ। বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষানুষঙ্গের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা ‘সাম্প্রদায়িক’ চেতনার উপাদান ‘উগ্রবাদী’দের খাদ্যের পিরামিডিয় নীতির প্রথম স্তরে নিয়ে গেছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে পোষক ধরে ‘ধর্মীয় উগ্রবাদ’ বহুদিন থেকে চর্চিত হয়েছে। যে শিক্ষা পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করবে, যে শিক্ষা মৌলিক চিন্তা শক্তিকে শাণিত করবে সেই ‘পাঠ্যপুস্তকের’ বেশ কিছু নিয়ামক আমাদের এই তরুণদেরকে দিকভ্রান্ত করছে বলে আমার বিশ্বাস।

মারাত্মক সব আলোচনা রয়েছে পাঠ্যপুস্তকে যা কিনা ‘জঙ্গিবাদ’ চেতনার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। তিন দশক ধরে চলে আসা শিক্ষা ব্যবস্থার এই ভুলগুলোর খেসারত গুণতে হচ্ছে ‘সাম্প্রদায়িক খুনে’।

৪.
বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ‘ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র,গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই হবে সংবিধানের মূলনীতি। আর সেই আলোকে একাত্তর পরবর্তী অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাকে লালন-পালন করা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের শামিল।

বাংলাদেশের সাত স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল স্তম্ভ ধরা হয়। এই শিক্ষায় আলোকিত একটি শিশু পরবর্তীতে নাগরিকতার শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তাই এই পর্যায়টাকে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা নেয়ার সিঁড়ি বলে মনে করি। কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় তা নেয়ার সুযোগ নেই বলেই চলে।

কিন্তু না, আমরা ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনার শিক্ষা দিতে পারিনি। ‘শিক্ষা যেমন কোন জাতিকে উচ্চাসনে নিয়ে যায় ঠিক তেমনি ভুল শিক্ষায় তা অধঃক্রম অনুসরণ করে। আমাদের দেশের একটি শিশুর শিক্ষার গোড়াতে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদ শব্দে ভোগে। একজন সদ্য অক্ষর বর্ণ শিখতে যাওয়া শিশুকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় স্বীকৃতি দিতে প্রয়োজন পড়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ফরম পূরণ। আর এই কাগুজে ফরমে সেই অক্ষরজ্ঞানহীন শিশুর তথ্যকণিকায় চাওয়া হয় বর্ণ কিংবা ধর্ম কি? আর সেই তথ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার পথ উন্মুক্ত করে দেয় সেই শিশুর অভিভাবকরা।

এই নার্সারি শিক্ষা থেকে শুরু হওয়া বর্ণবাদী শব্দগুলো চলে কর্মজীবনে চলা চাকুরি আবেদন পর্যন্ত। যে শিশুর মানসিক বিচার হওয়ার কথা ‘উদারতা’ কোন সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে নয় কিন্তু তারা গোড়াতে হয়ে উঠেছে ‘ধর্ম বিদ্বেষী। এক ধর্মের শিশু অন্য ধর্মের শিশুকে ‘বিধর্মী’ নামে চিনছে। কথাগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত; বাংলাদেশ সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিকও বটে। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শাসকগোষ্ঠি বিষয়টিকে ‘অস্পৃশ্য’ এবং সংবেদনশীল বলেই চালিয়ে দিচ্ছে। যার ফল ভোগ করছি এখন।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উদারতার যে চিহ্ন তা উপরের কয়েকটি বাক্যে আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এই উদারতা যে সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী চেতনাকে কতটা ধারালো করেছে ‘যা বর্তমানে চাপাতির’ আঘাতগুলো বলে দিচ্ছে।

৫.
সংবিধানের সুরে সুর মেলানো ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’-তে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক ও নৈতিকতা শিক্ষা দিতেই ধর্মীয় বই সিলেবাসগুলোতে রয়েছে। এই নীতির গোড়ার দিকে ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অনুচ্ছেদের ৭ নম্বর পরিচ্ছেদে ‘অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার’ প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের তিনটি ধাপ (সাধারণ, মাদরাসা ও কারিগরি) সরাসরি এই সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষার গন্ধ পাওয়া যায়। ২০০৫ সালে দেশব্যাপী জঙ্গি হামলা ও পরবর্তী এক দশকের বিভিন্ন ‘জঙ্গি’ হামলার সম্পৃক্ততায় দেশের মাদরাসা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেয়া ‘বিপথগামী’-দের বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হতে দেখা গেছে। অভিযোগ, মাদরাসা শিক্ষার অন্তরালে ‘উগ্রবাদী’ চেতনার সোপান রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পার করা শিক্ষার্থীরাও এই জঙ্গি হামলাগুলোতে জড়িয়ে পড়েছে। আমরা সেই প্রসঙ্গে আসবো। তার আগে মাদরাসা শিক্ষায় যে সাম্প্রদায়িকতার চর্চাভাণ্ডার খুলেছে তার বিষয়টি আলোকপাত করা যাক।

আমাদের পবিত্র ধর্ম ‘ইসলাম’ শান্তির পথে আহ্বান করে। উপমহাদেশের যে কয়েকটি দেশ ‘মুসলিম অধ্যুষিত তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই দেশে বিভিন্ন সময়ে সুফি সাধকদের তীর্থক্ষেত্রও ছিল। আর সেই কথা বিবেচনা করে দেশে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। ১৯০৬ ও ১৯০৯ সালে তৎকালিন মুসলিম শিক্ষা সমাবেশে এই অঞ্চলে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব দেয়া হয় (তথ্য সূত্র: মাদরাসা শিক্ষার পর্যবেক্ষণ-মুজিব মেহেদী)। এরপর ১৯১৪ সালে চূড়ান্তভাবে সরকার মাদরাসাভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চালুর অনুমতি দেয়, কিন্তু সেটিও অগ্রসর হয়নি।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের কিছু আগে মাদরাসা শিক্ষায় সিলেবাস প্রণয়ন কমিটির প্রধান মাওলানা মোয়াজ্জেম হোসেন অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু নিয়ে দ্বিধা বিভক্তিতে ভোগেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে ড. কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন মাদরাসা শিক্ষায় প্রগতিশীল চেতনা ধরে রাখতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিলেন। এইগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল:

  • মাদরাসা শিক্ষার সিলেবাস অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতই হবে
  • বাংলা হবে শিক্ষা মাধ্যম
  • ধর্মীয় শিক্ষা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি বাধ্যতামূলক করা হবে
  • মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘ধর্মীয় শিক্ষা’ কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া যাবে
  • আট বছরের প্রাথমিক শিক্ষায় কেবল তিন বছর (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম) ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে
  • নবম-দশম শ্রেণি থেকে বাংলা, বিজ্ঞান ও ইংরেজিকে আবশ্যিক করা

পরবর্তী সময়ে এই সুপারিশের আলোকে তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফরের নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালের শিক্ষা কমিশন বিতর্ক শুরু হয়। সেই সময়ে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করেন। এরপর তার উপদেষ্টা আব্দুল মজিদ খান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আরবি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। এরপর থেকে দেশে মাদরাসা শিক্ষায় ‘মূলত ধর্মীয়’ শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়।

আর সেই আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতির-২০১০ ষষ্ঠ ধাপে মাদরাসা শিক্ষা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের তৃতীয় পরিচ্ছেদে ইসলামের মর্মবাণী জানা ও তা আদর্শের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোথাও মানবিক শিক্ষার বিষয় উল্লেখ নেই। এবতেদায়ি, দাখিল, আলিম কিংবা কামিল পর্যায়ের মাদরাসা শিক্ষার সাথে বিশ্বায়নের সাথে সন্ধির কোন ছিটেফোঁটা নেই। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষার পাশাপাশি নিজেদেরকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে যে প্রাসঙ্গিক শিক্ষা প্রয়োজন তার সম্ভাবনা নেই তাদের সিলেবাসে। আধুনিক শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেবল গণ্ডিবদ্ধ কিংবা সনদনির্ভর হয়ে গেছে। হয়ে উঠছে ‘সাম্প্রদায়িক চর্চার’ সূতিকাগার।

৬.
বর্তমানে দেশে পনের হাজারেরও বেশি কওমি মাদরাসা রয়েছে। এইসব মাদরাসায় কোন কোন বিষয় পাঠ করানো হয় তার হিসেব সরকারের কাছে আজও মেলেনি। কিন্তু এই কওমি মাদরাসায় শিক্ষায় যে ‘সাম্প্রদায়িকতার’ চর্চা চলছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ; অত্যন্ত কষ্টের।

দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় সাংবাদিকতা করার সুবাদে দেশে ‘বিভিন্ন সময়’ জঙ্গি সম্পৃক্ততায় গ্রেপ্তার হওয়াদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ‘জিহাদি’ বই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এই বইগুলো নিষিদ্ধ হলেও ‘দীর্ঘদিন থেকে’ মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় চর্চা হওয়া ‘জিহাদি’ পড়াশোনার অনুষঙ্গ দেখে অনেক ভয়ই পেয়েছি। কিভাবে এই বৈধ বইয়ে জিহাদি আলোচনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয় সেই বিষয়টি আলোকপাত করলে ‘পাঠক আপনারদের শরীরেও এক ধরনের শিহরণ তৈরি হবে।

মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্যতম একটি পাঠ্যপুস্তক হলো ‘ফিকাহ শাস্ত্র’। কুরআন, হাদিসের সমন্বয়ে গড়া ফিকাহ শাস্ত্র আমাদের মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় গ্রন্থও বটে। দীর্ঘদিন থেকে এই গ্রন্থটি আরবি ভাষায় লিখা হলেও সম্প্রতি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম আত তুইজিরির লেখা ‘কুরআন ও সুন্নাহ আলোকে ইসলামী ফিকাহ’ বই দ্বিতীয় খণ্ডে ৭৮৫ থেকে ৮১৫ পৃষ্ঠাজুড়ে জিহাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। যার বেশি অংশ জুড়ে কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যার পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ‘মতামত’ই প্রাধান্য পেয়েছে।

যেমন ৭৮৬ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র যারা বিরোধিতা করে এবং কুফরির উপরেই অটল থাকে তাকেই হত্যা করা জায়েজ। অথবা যে মুরতাদ হয়ে যায় কিংবা জুলুম বা সীমালঙ্ঘন করে কিংবা মানুষকে ইসলামে প্রবেশ করতে বাধা প্রদান করে।

জিহাদকে চার ভাগে ভাগ করে ৭৯৭ পৃষ্ঠায় সরাসরি লেখক বলেছে, মুরতাদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে তাদেরকে ফিরে আসার, না হয় হত্যার।

পবিত্র কুরআন শরীফের কিংবা সহীহ হাদিসের রেফারেন্স ছাড়া এই বক্তব্য দ্বারা ‘কোমলমতি মাদরাসা ছাত্রদের শুধু সাম্প্রদায়িক হামলা উসকে দিয়েছেন লেখক মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম।

বর্তমান সময়ে জিহাদের গুরুত্ব কতটুকু তা বলা শোচনীয় কিন্তু আমাদের ধর্মের প্রথম দিকে ‘রাসুল্লাহ (সা.) যে জিহাদ করেছিলেন তা কেবল দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য। আর যেহেতু ইসলাম পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম সেহেতু এই বিষয়গুলো সেই সময়ে গুরুত্ববহন করে।

কিন্তু এই বইয়ের ‘বাক্যগুলো জিহাদি আলোচনার চেয়ে ‘সন্ত্রাসবাদী’ চিন্তার প্রসার ঘটেছে বলে মনে করি। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় ‘মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠি ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস) যৌনদাসীদের জোরপূর্বক যে ধর্ষণের খবর বের হয়েছিল ঠিক একই কথাগুলো ৮১১ পাতায় বর্ণনা করা হয়েছে। উগ্রবাদী চেতনা কেমনে মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে প্রবেশ করে দেয়া হচ্ছে তা কয়েকটি লাইনে বলে দিচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক হিসেবে স্বীকৃত এই পাতায় বলা হয়েছে, ‘মহিলা যুদ্ধবন্দি হওয়ার সাথে সাথে তাদের বিবাহ বাতিল হয়ে যাবে। আর গর্ভবতী হলে বাচ্চা প্রসব ও এক ঋতু পর তাদের সাথে সহবাস করা জায়েজ হবে।

একই পাতায় গণিমতের মাল কিভাবে বণ্টন করা সেই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। যা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এইসব লেখকের নিজস্ব মতামত নাকি কোরআনের তা কিছুই উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিয়ে আমি বেশ কয়েকজন আলেমদের সাথে কথা বলেছি। সৌদি আরবের বাদশাহ সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক আমাকে বলেছেন,যে ইসলামে যৌনদাসী প্রথা বাতিল হয়ে গেছে। আর তা করা হারাম। এই ব্যাখ্যা যারা দিয়েছে ‘তা মূলত ধর্মান্ধতার’ ফসল।

বর্তমানে বিপথগামী তরুণদের সুড়সুড়ি দেয়া এই লেখা ‘জঙ্গিবাদ’-কে উৎসাহ দিচ্ছে। ইসলামে জিহাদ যে সময় হয়েছিল সেই সময়ে পরিবেশ আর বর্তমান পরিবেশ রাত-দিন তফাৎ। মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুবিধা লাভের আশায় এই ধরনের লেখা বলে তিনি মনে করছেন।

বিষয়টি বিতর্ক তৈরি করে কি না তার একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ১৯৯৬ থেকে মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকের ইসলাম শিক্ষায় জিহাদ বিষয়ে আলোকপাত ছিল। সেই বইয়ের ৫৩ পাতায় জিহাদকে দুইভাগে ভাগ করলেও ‘ফিকাহ শাস্ত্রের’ ওই বইয়ে চার ভাগে ভাগ করেছে। জঙ্গিবাদী গোষ্ঠি এইসব বিতর্কিত ব্যাখ্যার বইকে আঁকড়ে ধরে হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহরীর, জামায়াতুল মুজাহিদিনের জন্ম দিচ্ছে। মাদরাসায় কুসংস্কারগুলোকে সংস্কার না করে তাতে আরো বেশি কুসংস্কার ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের পবিত্র ধর্মীয়গ্রন্থ কোরআনে কোথাও এই ধরনের ব্যাখ্যা নেই। অথচ এই দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠি উগ্রবাদীদের লালসায় পরিণত হচ্ছে।

শুধু মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় নয় সাম্প্রদায়িক চেতনা তৈরি হচ্ছে সাধারণ শিক্ষালয়গুলোতেও। নবম-দশম শ্রেণির ইসলাম শিক্ষার ওই সংস্করণগুলোতে দীর্ঘদিন থেকে ‘বন্ধু নির্বাচন’ বিষয়ক একটি অনুচ্ছেদ পাঠদান করা হচ্ছে। ইরানের খোরসান তুসে জন্ম নেয়া ইমাম গাজ্জালি (রহ.) কয়েকটি বাক্য সাম্প্রদায়িক চেতনায় ফুয়েল হিসেবেই কাজ করেছে। ৭৪ পাতায় বলা হয়েছে, কোরআন ও সুন্নাহের পরিপন্থি কাজে লিপ্ত তাদের ত্যাগ করতে বলেছেন।

আর এই কথায় স্পষ্ট হচ্ছে যে, আমাদের বন্ধু হবে কেবল মুসলমানই। অন্য কেউ হতে পারবে না। কোমলমতি শিক্ষার্থী একজন দার্শনিকের এই মতামতকে কেমন প্রাধান্য দেবে তার একটি গল্প তুলে ধরা যাবে।

আমাদের সময়েও এই পাঠ্য ছিল। আমার এক ক্লাসমেটের খুব কাছের বন্ধু ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী। বলতে গেলে ওরা এক সাথে খায়, খেলাধুলা করে, ঘুমায়। আমাদের যেদিন এই পড়াটি ছিল, সেদিন শিক্ষকের পড়ানোর সময় আমার ক্লাসমেটকে বেশ হতাশ হতে দেখেছিলাম। এর দুই দিন পর শুনি, সে আর তার হিন্দু বন্ধুর সাথে কথা বলে না। এমনকি তাদের বাড়িতেও যায়ও না। এই কথা সে বলতে না চাইলেও তার বাবা-মা আমাকে বলেছিল। পরবর্তীতে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সে বললো, জান্নাত পেতে গেলে তো বিধর্মীদের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবেই না। আর মায়া না বাড়িয়ে বন্ধুত্ব ইতি টেনেছি।

কথাগুলো এক যুগ আগে আমাদের বেলায় ঘটলেও এই কয়েকটি বাক্য যে কতজনের মনে ‘সাম্প্রদায়িকতার তীর বসিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

সাধারণত কারও গায়ে স্পর্শ হলে আমরা যেমন দুঃখিত বলে নিজেদের অনুতাপটা প্রকাশ করি, কিন্তু এই জঙ্গিবাদী গোষ্ঠি নিরপরাধ মানুষকে চাপাতি দ্বারা খুন করছে।

পাঠক একবার ভাবুন তো, আপনি অপরিচিত কোন ব্যক্তির গালে একটা চড় দিতে পারবেন কি না? অথচ তারা খুন করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে।

বর্তমান বিশ্ব হলো সম্পর্ক তৈরির বাতিঘর। যোগাযোগ না থাকলে উন্নতির পথগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে, এটাই স্বাভাবিক। কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যার চেয়ে একজন ইসলামিক চিন্তাবিদের দার্শনিক বক্তব্য কখনো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হতে পারে না। যদি বিধর্মীদের সাথে সম্পর্ক না রাখা যেত তাহলে আরব সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষাধিক সৈন্য রাখার জন্য সৌদি সরকারকে কয়েকশ মিলিয়ন ডলার গুনতে হতে না। বিশ্বের এক দেশ আর এক দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি হতো না।

শুধু ইসলাম ধর্মেই উগ্রবাদ জন্ম নেয়নি। হিন্দু ধর্মেও যে উগ্রবাদ রয়েছে তা আরো বেশি ভয়ানক। এই ধর্মের মানুষ এখনো জানার পরিবর্তে শোনাকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। ধর্মীয় উগ্রবাদী চিন্তা থেকে ১৯৯৫ সালে ভারতের বাবরি মসজিদে যে নৃশংসতা হয়েছিল তা ভুলে গেলে হবে না। সম্প্রতি ওই দেশে ‘গো-মাংস নিষিদ্ধ করার যে আন্দোলন হয়েছে তাও ‘ধর্মীয়’ উন্মাদনার ফসল।


পাঠক তাহলে, এই উগ্রবাদ বন্ধে কিছুই কি করণীয় নেই? তার উত্তরে বলবো, হ্যাঁ অনেক কিছুই রয়েছে। ‘জঙ্গি’ কখনো দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানে যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুগে যুগে যে উগ্রবাদ লালন করা হয়েছিল তাতে ‘ঘেঁটু’ করে দিয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি।

  • একটি শিশুর অঙ্কুরোদগম ঘটে প্রাথমিক শিক্ষায়। আর এই শিক্ষাটি যদি ‘উদার মানবতার’ তাহলে পরবর্তীতে তাকে সাম্প্রদায়িকতার সব অনুষঙ্গ গুলে খাওয়ালেও তার পথভ্রম হবে না। জাপানে দুই বছরের পর থেকে প্রাথমিক শিক্ষার আগে ‘হৈয়তুন’ নামক একটি স্কুলে শিশুদের ভর্তি করানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত আমাদের দেশে ডে-কেয়ার মতো। তারা শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য ‘প্রথম প্যারামিটার’ হিসেবে কাজ করে। একটি শিশুর নিজে নিজে কিভাবে ব্যক্তিগত কাজ করবে, অন্যের সাথে ব্যবহার করবে, রাষ্ট্রের নিয়ামক গ্রহণ করবে আবার তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে তার পুরোটাই হৈয়তুন থেকে পেয়ে যায়। তাই স্ব-শিক্ষা দিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করা জরুরি বলে মনে করি।
  • আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হয়। সদ্য অক্ষর জ্ঞান পাওয়া শিশুদের ধরে দেয়া হচ্ছে ‘বিভিন্ন ধর্মের বই’ যা ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের এই শিশুদের মানসিক বিকাশে অন্তরায়। অবশ্যই শিশুকে তার স্বীয় ধর্মের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে আর এই জন্য পরিবার হয়ে উঠতে পারে অন্যতম কেন্দ্রে। উদারতার শিক্ষা না পেলে ভবিষ্যৎ এই ‘মতবাদকে’ সুপ্রিম ডমিনেট মনে করে তারা বড় হয় যা পরবর্তীতে কিছু বুঝে উঠার আগে ‘উগ্রবাদ’ এর শিকার হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের দেশের সাথে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ১৯৪৪ সাল থেকে ইংল্যান্ডে ধর্মীয় শিক্ষা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তারা বলেছে, একটি ধর্মীয় বই পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস, ধর্মীয় নেতা ও তাদের নৈতিক শিক্ষার বিষয় আছে। এমনকি শিক্ষার্থীদের বাবা-মা চাইলে সেই ধর্মীয় শিক্ষা থেকে তাদের সন্তানকে বিরতও রাখতে পারে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)। বর্তমানে তারা সেটাই অনুসরণ করছে যা তাদের ‘বিশ্বাসে’ আঘাত হানতে পারছে না। অবশ্যই চরিত্র ও নৈতিকতাবোধ তৈরি করতে ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কোরিয়া, নরওয়ে ও স্কটল্যান্ডে। তারা ধর্মীয় শিক্ষা বলতে বিভিন্ন ধর্মের নৈতিক শিক্ষাটুকুকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছে। লেবানন স্কুল, কলেজগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়ে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছে। আর এই শিক্ষা পদ্ধতিগুলোই মূলত অসাম্প্রদায়িকতার। তবে সেটা হতে হবে উদার। দার্শনিক ব্যাখ্যা কখনো ধর্মীয় গ্রন্থের অংশ নয় সেই বিষয়টি পরিষ্কার করে তুলে ধরতে হবে।
  • মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে। সৌদি আরবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ধর্মীয়’ বিষয়ের সাথে সাথে আধুনিক শিক্ষার সব অনুষঙ্গ যোগ করা হয়েছে। আমাদের দেশে মাদরাসা শিক্ষকরা এখনো ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ব্যবহারকে পাপের চোখে দেখে। আপনার যখন চোখই থাকবে না তখন আপনার কাছে ‘হীরাও যা মার্বেলও তা। সুতরাং চিন্তাধারার পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। তাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ না করে পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধই অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্তম্ভ।
  • জঙ্গিবাদী চেতনা তখনই হয় তৈরি হয়, যখন দেশে বিচার ব্যবস্থা লুণ্ঠিত হয়। আর আইনের শাসন থাকলে যেকোনো অপরাধী জন্ম নেয়ার আগে নিজেদের পরিণতি সম্বন্ধে ভাববে। সেটা না হলে উগ্রবাদীরা সুযোগ নিয়ে ‘ধর্মের’ অপব্যাখ্যা করে মানুষ মারতে দ্বিধা করবে না। সুতরাং আদালতের শাসন ধরে রাখার সংস্কৃতি বলবত হওয়া জরুরি।
  • সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে উদারতা চর্চা করতে হবে। সন্ত্রাসবাদ কখনো ‘ধর্ম’ সমর্থন করে না। আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোন খুনিকে জান্নাতে দিবে না। ইসলাম এইসব হত্যাকে কখনো সমর্থন করে না। এই কথাগুলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিতে হবে। আর এই এজন্য রাষ্ট্রকেই হতে হবে উদার। কেবল ‘ভোট পাওয়ার আশায়’ নিদিষ্ট গোষ্ঠিকে সুড়সুড়ি দেয়ার চর্চা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই যারা করছে, তারা মূলত একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠির লালসার শিকার হচ্ছে।
  • ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তকে বিতর্কিত ও অসমর্থনযোগ্য মতাদর্শ যেগুলো দেশে শাসন ব্যবস্থাকে হুমকিতে ফেলে তা পরিহার করা। হোক সেটা ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান ধর্মে। ধর্মীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে কেবল ‘নৈতিক ও চরিত্র গঠনের সোপানঘর হবে। এখান থেকে উগ্রবাদ প্রবাহ করে এমন তথ্য থেকে বিরত থেকে সকল ধর্মেও মানুষের প্রতি সহমর্মিতা তৈরির পাঠচর্চা করা যেতে পারে।
  • ধর্মকে পুঁজি করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা প্রয়োজন। ধর্ম কখনো পুণ্য নয়, এটা কেবল নৈতিকতার মুক্তির ডানা মেলে ধরে আর তার সাথে রাষ্ট্রীয় বিষয় জড়িত হতে পারে না।

ইসলামিক দেশ হিসেবে উপরে থাকা মিশরের প্রাথমিক শিক্ষায় মানসিক, শারীরিক, ভাষাগত এবং সৃজনশীল শিক্ষার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। কয়েকশ বছর আগে এই দেশের মসজিদগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হলেও এখন আধুনিক ও বিশ্বায়নের মিলনের পাঠচর্চা রীতিতে পরিণত হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে চলা মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। তার ধর্মীয় শিক্ষাকে আদর্শিক শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করলেও এদের প্রতিষ্ঠাগুলোর সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজ্ঞানের সঠিক চর্চা কিংবা ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো স্পষ্ট করা প্রয়োজন। ন্যানো সেকেন্ডের এই তথ্য দুনিয়ায় আর কুনো ব্যাঙ হয়ে ঘরে বসে থাকা নয়। কুসংস্কার চর্চা নয়। এই থেকে বের হয়ে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার আলোয় মানবিক গুণাবলী চর্চা ও মানবিক হওয়ার শিক্ষা দেয়া ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের উন্নয়নের সিঁড়ি বলে মনে করি।

আমরাও স্বপ্ন দেখি সেই অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার। প্রাতিষ্ঠানিক মুক্তবুদ্ধি চর্চা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার। আমরা পারবো ধর্মীয় নৈতিকতার শিক্ষা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। তাহলেই বাংলাদেশ একদিন বিশ্বভুবনে হয়ে উঠবে উদারতা ও মুক্তচেতনাধারী নাগরিকদের প্রতীক। এই প্রত্যাশা জাতির প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে রোপিত হোক।

তথ্যসূত্র
বিডিনিউজ
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০
শিক্ষা আইন
বিডি ল
শিক্ষা তথ্য
মিশরের শিক্ষাব্যবস্থা
উইকিপিডিয়া
ইসলামী ফিকাহ

এস এম নাদিম মাহমুদ, গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ