আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

দুঃখিনী শেখ হাসিনা, অচেনা শেখ হাসিনা!

চিররঞ্জন সরকার  

তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়া, অপরাধ ছাড়া!

পরিবারের ছোট্ট শিশুটিকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। রেহাই দেওয়া হয়নি সন্তান-সম্ভবা নারীটিকেও। শুধু দুইজন দেশে না থাকার কারণে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট!

ইতিহাসের এই জঘন্য ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যতটা প্রতিবাদ হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। দলের অনেক নেতা, কেউ বা ভয়ে চুপ থেকেছেন, কেউ ক্ষমতার লোভে খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন!

এর পর ক্ষমতার মঞ্চে এক সামরিক জেনারেলের আবির্ভাব। তিনি একে একে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সবটুকু প্রগতিশীল আদর্শ বিসর্জন দিলেন। জনকের হত্যাকারীদের দিলেন পুনর্বাসন ও প্রটেকশন।স্বাধীনতাবিরোধীদের দিলেন রাজনীতি করার অধিকার। বাংলাদেশের মোড়কে প্রতিষ্ঠা করলেন নব্য-পাকিস্তান! রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে, পদ-পদবি ও বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন সেক্টর থেকে লোক ভাগিয়ে নিয়ে করলেন দল গঠন। দেশে খুনি, সুবিধাবাদী, দেশবিরোধী, মৌলবাদী শক্তি প্রাতিষ্ঠানিকতা পেল এই জেনারেলের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে।

এর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ১৯৮১ সালের ৩১ মে সেই জেনারেলও খুন হলেন। নিহত এই জেনারেলের নাম জিয়াউর রহমান। মঞ্চে আবির্ভাব ঘটল আরেক জেনারেলের।তাঁর নাম এরশাদ।তিনি নিহত জেনারেলের ‘রাজনৈতিক আদর্শকে’ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে সামরিক গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় খুললেন নতুন দল।

এদিকে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এলেন সেই ‘সপরিবারে খুন হওয়া’ ভাগ্যহত পরিবারের এক সদস্য। এসে দলের হাল ধরলেন। তাঁর নাম শেখ হাসিনা। আর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী ১৯৮৩ সালের মার্চে দলের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।

নিজ চেষ্টা ও যোগ্যতায় শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের এবং বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় আসেন। ১৯৯৫ সালে আসেন শেখ হাসিনা। ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় বসেন বেগম জিয়া। এবার তাদের ক্ষমতার দোসর হয় স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী। মন্ত্রীত্ব পায় নিজামী ও মুজাহিদ।

আওয়ামী লীগ-বিএনপি বা হাসিনা-খালেদার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সব সময়ই ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় থাকার এই মেয়াদে তা চরম শত্রুতায় পরিণত হয়। এসময় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। বাংলাদেশে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। যে হামলায় ২৪ জন নিহত হয় এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়। শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার এই চেষ্টা দেশের রাজনীতিকে বদলে দেয়। বদলে যান শেখ হাসিনাও!

বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে এই হামলার ঘটনার জন্য স্বাভাবিকভাবেই দায় চাপে বেগম জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানের উপর!

শেখ হাসিনা বেগম জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলেন। বেগম জিয়া পছন্দের লোকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বসালে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় দুই দলের মধ্যে শক্তি প্রয়োগের রাজনীতি। এমন এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে ক্ষমতার মঞ্চে আসে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিনের সরকার। দুই নেত্রীকে আটক করা হয়। চেষ্টা করা হয় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার্যকর কিছু করতে না পেরে এই সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা।

ক্ষমতার মেয়াদ শেষে শেখ হাসিনা নিজের মতো করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঘোষণা করেন। বিএনপি সহিংস আন্দোলন দিয়ে সেই নির্বাচনকে বানচাল করার চেষ্টা করে।কিন্তু বিএনপির সহিংসতা, সন্ত্রাসকে অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে যান।

২০০৯ থেকে ২০১৭, এই আট বছরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার করছেন। সাকা চৌধুরী, নিজামী, মীর কাশেমের মত মহাক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন।

সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেছেন তা হলো, যারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, যারা তাঁর পিতার হত্যাকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়-প্রটেকশন দিয়েছিল, তাদের প্রতি ‘রাজনৈতিক প্রতিশোধ’ নিয়েছেন! (সদ্য ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের জবানবন্দি অনুযায়ী, সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার নীলনকশা সাজানো হয়েছিল হওয়া ভবনেই। ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট একান্ত গোপনীয় সেই বৈঠকে অংশ নেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভূমি উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একজন মেজর নূর, জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও জঙ্গি সংগঠন আল মারকাজুল ইসলামীর এক নেতা। পরবর্তীকালে দফায় দফায় মিটিং করে হামলা নিশ্চিত করা হয় এবং বাবরের তত্ত্বাবধানে গ্রেনেড সরবরাহ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে আর বাঁচতে দেওয়া হবে না। তাকে মারতেই হবে! সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

তিনি অত্যন্ত কৌশলে আদালতের নির্দেশনা মেনে বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়া (ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি) করেছেন। তাঁর দুই ছেলেকে দেশ ছাড়া করেছেন। বিএনপিকে সংসদ ছাড়া করেছেন। বিএনপির নেতাকর্মীদের দৌড়ের উপর রেখেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ‘সুচারুভাবে’ চলতে দিয়ে নিশ্চিত দণ্ডের খাঁড়ার নিচে রেখেছেন।

শেখ হাসিনা পদ্মা-সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংককে ঘোল খাইয়েছেন। আমেরিকাকে উপেক্ষা করেছেন। ‘সমুদ্রবিজয়ে’ কুশলী ভূমিকা পালন করে ভারতের সমীহ আদায় করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছেন। মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে তাঁকে প্রভাবিত করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তাড়িয়েছেন! জঙ্গিদের যমে পরিণত হয়েছেন! দেশের সব সমালোচনাকারীকে ‘ভেড়া’ বানিয়েছেন।

যিনি ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন, তিনি বেপরোয়া হবেন, যারা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হবেন, যাঁরা তাকে অপমান করতে চেয়েছে, তাদের প্রতি নির্দয় হবেন-এ সব কিছুরই ব্যাখ্যা আছে। যুক্তিও আছে। কিন্তু তিনি কেন হেফাজতমুখী হচ্ছেন? কেন তাদের রাজনীতিকে আত্তীকরণ করছেন?

এটা কি দেশের প্রগতিবাদীদের দেখে নেওয়া? প্রগতিবাদীরা তাঁর প্রতি ‘নিঃশর্ত সমর্থন’ দিচ্ছে না বলে প্রতিশোধ গ্রহণ?

এই শেখ হাসিনাকে আমার অচেনা মনে হয়! হয়তো আমার মত আরও অনেকের কাছেই!

হ্যাঁ, আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা! দুঃখিনী শেখ হাসিনা! যিনি জীবন ভর দুঃখ ও যন্ত্রণা সয়েছেন। শোকের সাগরে ভেসেছেন। প্রতিনিয়ত খুন হওয়ার শঙ্কা নিয়ে বেঁচে আছেন। প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে টিকে আছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা!

প্লিজ, আপনি আমাদের কাছে ‘অচেনা’ হবেন না!

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ