প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন | ২৩ এপ্রিল, ২০১৭
প্রাচীন ভারতের চাণক্যের কূটনীতি, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ (চাণক্য এবং কৌটিল্য একজনই), পাণিনি’র ‘মহাভাষ্য’ এবং বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ জগৎবিখ্যাত। আধুনিক ভারতেও কূটনীতির প্রসঙ্গ এলেই ‘চাণক্য কূটনীতি’র কথা সকলের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে। সম্প্রতি শেখ হাসিনার ভারত সফরেও ‘চাণক্য কূটনীতি’ বহুল আলোচিত। সংক্ষেপে হলেও চাণক্য সম্পর্কে কিছু জানা দরকার।
চাণক্যকে প্রাচীন ভারতের এরিস্টটল বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। এরিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২ অব্দ) এবং চাণক্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০-২৮৩ অব্দ)প্রায় কাছাকাছি সময়ে জন্মেছিলেন। এরিস্টটল ছিলেন আলেক্সজান্ডারের শিক্ষা গুরু; পরবর্তীতে সেই আলেক্সজান্ডারই দিগ্বিজয় করেছিলেন। তেমনি চাণক্যও মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্থানে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনিও ছিলেন তরুণ চন্দ্রগুপ্ত’র শিক্ষা গুরু। মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য। চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত ও তাঁর পুত্র বিন্দুসারের রাজ-উপদেষ্টা ছিলেন।
কারো কারো মতে,চাণক্য হচ্ছেন-‘ভারতের মেকিয়াভেলি’। যদিও তিনি নিকোলো মেকিয়াভেলির ১৮০০ বছর পূর্বে জন্মেছিলেন। চাণক্যকে কৌটিল্য এবং বিষ্ণুগুপ্ত নামেও অভিহিত করা হয়। গুপ্ত রাজবংশের শাসনের শেষ দিকে রহস্যজনক ভাবে তাঁর রচিত গ্রন্থটি হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯১৫ সালে উক্ত গ্রন্থটি খুঁজে পাওয়া গেছে।
চাণক্যকে নিয়ে এত কথা কেন বললাম? প্রথমত সম্প্রতি শেখ হাসিনার ভারত সফর এবং বহুল আলোচিত চাণক্য কূটনীতি। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে-শেখ হাসিনা এই সময়ে সরকারি সফরে ভারত যাবেন,এটা পূর্ব নির্ধারিত ছিল। সফরের ফলাফল কি হবে? তাও মোটামুটি আগে-ভাগেই জানা ছিল। যদিও আওয়ামী লীগ সরকার গঙ্গা চুক্তির মতো তিস্তা চুক্তি করার জন্য অনেক দিন থেকেই যারপরনাই চেষ্টা তদবির করছে। নরেন্দ্র মোদী’র ঢাকা সফরের সময়েও একই রকম চেষ্টা-চরিত্র করেছিল। তখন নরেন্দ্র মোদী শেখ হাসিনাকে ভবিষ্যতের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাই সংগত কারণেই শেখ হাসিনা আশা করেছিলেন, এবার বোধ হয় দিল্লী সফরে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু সফরের যাওয়ার আগেই বোঝা গিয়েছিল,এবারও তিস্তা চুক্তি হবে না। আর তিস্তা চুক্তি না হলে শেখ হাসিনার ভারত সফর মোটা দাগে ফলপ্রসূ হয়নি বলেই বিরোধীরা দাবি করবে। অন্যান্য বাণিজ্যিক এবং সামরিক সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতাগুলোকে ‘দেশ বিক্রি হয়ে গেল’, ‘দেশ বিক্রি হয়ে গেল’ বলে ঢোল পিটাবে।
যদিও বিএনপি এখন একটি দুঃস্থ রাজনৈতিক দলের কাতারে আছে। এই দলটির কোথাও (মাঠে-ময়দানে-ফেইসবুকে-ব্লগে-মিডিয়ায়) কোনো ধরনের আধিপত্য নাই। তারপরেও এন্টি আওয়ামী লীগ ভোট কিংবা জনমতকে উপেক্ষা করার সাহস কিংবা অভিপ্রায় আওয়ামী লীগের নেই।
তাই হাইপোথিটিক্যালি যদি কেউ সমীকরণ মিলানোর চেষ্টা করে যে, ভারতের সাথে সামরিক চুক্তি/সমঝোতাকে ‘দেশ বিক্রি করে দিল’ প্রচারণায় বিরোধীদল হালে পানি পায়, তাহলে উপায়? উপায় প্রস্তুত করেই শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছেন। মুফতি হান্নানের বিচার প্রক্রিয়া কেন এই সময়েই শেষ করা হলো? তার মানে কি? যদি কোনো কারণে বিরোধীদল আন্দোলনের ডাক দেয়, তাহলে সেই আন্দোলনের সময় মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করলেই মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া যাবে।
যথারীতি বিএনপি ‘দেশ বিক্রি করে দিল’ ‘দেশ বিক্রি করে দিল’ বলে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। শেখ হাসিনা যে তিস্তা চুক্তি করতে পারবেন না, বিএনপি তা আগেই বুঝতে পেরে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। সুতরাং উভয় পক্ষ সব কিছু জেনে বুঝেই করেছে।
বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, ১০ এপ্রিল ২০১৭ শেখ হাসিনা দেশে ফেরার সাথে সাথে হঠাৎ করেই অপু বিশ্বাসের ঘটনা টেলিভিশন মিডিয়ায় চাউর হয়ে গেল। অপু বিশ্বাস-শাকিব খানের ঘটনাটি বিকেল চারটায় টিভিতে দেখানো হয়, অন্যদিকে শেখ হাসিনা বিকেল সাড়ে চারটায় সংবাদ সম্মেলন করেন। আবার বিএনপি’র সংবাদ সম্মেলনের দিনই শাকিব খানও সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন।
মুফতি হান্নানের বিচার কার্য কিংবা ফাঁসির আদেশ কার্যকরের দিন-ক্ষণ এই মোক্ষম সময়ে কেন? অন্য কোনো সময় হলো না কেন? অপু বিশ্বাস-শাকিব খানের ঘটনাগুলি কি শুধুই দুর্ঘটনা নাকি কাকতালীয়? আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, মুফতি হান্নানের বিষয়টিতে না হয় সরকারের বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টতা আছে, কিন্তু অপু বিশ্বাস-শাকিব খানের ঘটনা তো সরকার ঘটায়নি। আমি আপনার সাথে একমত; তবে অপু বিশ্বাস-শাকিব খানের ঘটনা কি তিস্তা চুক্তিকে ছাপিয়ে যাবার মতো ইস্যু? প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সংবাদ সম্মেলনের চেয়ে নিশ্চয়ই বড় ইস্যু না।
যে টেলিভিশন চ্যানেলটি অপু বিশ্বাসকে বিকেল ৪টার সময় লাইভে নিয়ে আসল, তারা কি জানতেন না প্রধানমন্ত্রী আজ দেশে ফিরবেন? বিকেল চারটায় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন? অবশ্যই জানতেন। একই দিনে রাতের বেলা আরেকটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল অপু বিশ্বাস-শাকিব খানকে লাইভ কাভারেজ দেয়ার ব্যাপারে খুব মনোযোগী হয়ে গেল। কিন্তু কেন? এটা প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সাফল্য ব্যর্থতার আলোচনাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার কৌশল নয়?
নিরপেক্ষ যে কোনো পর্যবেক্ষকই বলতে বাধ্য হবেন, অপু-শাকিবের ঘটনাটি সরকারের জন্য বোনাস, কিন্তু কেলেঙ্কারি প্রচারের সময়ক্ষণ অবশ্যই কাকতালীয় নয়। মুফতি হান্নানের ফাঁসি এবং ‘তেঁতুল হুজুরদের’ গণভবনে আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ এর দিন-ক্ষণ পূর্ব পরিকল্পিত নয়? কওমি পাশ দেয়াদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রী ঠিক এই সময়েই কেন দিতে হবে?
হাইকোর্টের সামনের গ্রীক ভাস্কর্য থেমিসকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কিসের ইঙ্গিত করে? পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন রমেল চাকমাকে হত্যা করা হলো, তার প্রতিবাদে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন আবার হেফাজতে ইসলাম বায়তুল মোকাররমে থেমিসের ভাস্কর্য সরানোর দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে। কোথায় যেন বারবার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, তাই না?
গত শীত মৌসুমে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের অনেক এমপি, মন্ত্রীরা নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়াজ মাহফিল, জাতীয়-আন্তর্জাতিক কেরাত-হামদ-নাত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। এসব কি শুধুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা? দলীয় হাইকমান্ডের গ্রিন সিগনাল ছাড়া তারা এসব করেছেন? কোনোভাবেই তা সম্ভব নয়।
হেফাজতে ইসলাম তথা বাংলাদেশের ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে কিভাবে পকেটে পুরতে হয়? আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয়ভাবে এবং ওসমান ভ্রাতৃদ্বয় নারায়ণগঞ্জে স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রদর্শন করছেন। বাংলাদেশে সেনা এবং মৌলভী বাহিনীদেরকে সাথে রাখতে পারলে ক্ষমতায় থাকা কোনো সমস্যা না। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক সময় হাফেজ্জি হুজুর নামক এক ব্যক্তিকে রাজনীতির ময়দানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন। আজকের ‘তেঁতুল হুজুর’ মেলায় হারিয়ে যাওয়া হাফেজ্জি হুজুরের আপন ভাই।
এসব দেখে মনে হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে বাইরে রেখেই বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চা করার সম্ভাবনা আছে।
যদিও তেঁতুল হুজুরকে শেখ হাসিনার সাথে একই ফ্রেমে দেখে পলিটিক্যালি ভ্যাসেক্টমাইজড-লাইগ্রেটেড বামপন্থী-নামপন্থী-দিল্লীপন্থী-জাতীয়তাবাদীরা ‘গেল’ ‘গেল’ বলা শুরু করেছে। তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই, ২৬ বছর আগে শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদের সাথেও দেখা করেছিলেন। একই ফ্রেমে ছবি তুলেছিলেন। দোয়া-আশীর্বাদও নিয়েছিলেন। সেই সব যুদ্ধাপরাধীদের কিন্তু শেখ হাসিনার আমলেই ফাঁসি হয়েছে। সুতরাং অধৈর্য হবার সময় আসেনি। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো না কোনো পরিকল্পনা আছে।
বুঝতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এই সরকারের মধ্যে এক অথবা একাধিক চাণক্য আছেন। তা ছাড়া এমনটি হবার কথা নয়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য